মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

তসলিমা নাসরিনকে দেখে কিছু শেখার নেই

মাসকাওয়াথ আহসান
প্রকাশিত: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১০ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

চান রাতে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে প্রথমবারের মতো ঈদের সংগীত আসর বসেছিলো। একটা ভিডিওতে দেখলাম শীলা আহমেদ সেখানে হাতে মেহেদি পরছেন। অধ্যাপক আসিফ নজরুল পাশে বসে চমৎকার একটা টিভি ইন্টারভিউ দিলেন। ঈদকে ঘিরে আনন্দের এই সময়টাতে ঐ সুন্দর দৃশ্য দেখে কলতলায় বসে তসলিমা নাসরিন অনধিকার চর্চা করে বসলেন। কলতলার ধর্মই হচ্ছে অন্যের ফ্রিডম অফ চয়েস বা ইচ্ছার স্বাধীনতাতে নাক গলানো। তিনি শীলা আহমেদ-এর পোশাকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলেন। অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে ঐ পোশাকের জন্য দায়ী করে ধর্মবাদী রাজাকার তকমা দিলেন।

শীলা আহমেদের দাদা ও নানা শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। তার বাবাকে সবাই চেনেন। মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। দাদী ছিলেন গ্রন্থকার। শীলা নিজেও অর্থনীতির মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। পেশাগত জীবনে খুবই সফল। 


বিজ্ঞাপন


আমার তখনই খুব বিরক্ত লাগে যখন নতুন শিক্ষিত ও নতুন অ্যাফ্লুয়েন্স পাওয়া লোকেরা উপযাচক হয়ে পুরোনো শিক্ষিত ও অ্যাফ্লুয়েন্ট মানুষকে আধুনিকতার জ্ঞান দিতে আসে। তসলিমা ডাক্তার হয়েছেন, দু’চারটে কবিতা-উপন্যাস লিখেছেন; বিতর্কিত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন; এর মানে তো এই নয় উনি এনলাইটেনমেন্টের অথোরিটি পেয়ে গেলেন।

খোদ ভারতেই শীলা আহমেদের মতো পুরোনো শিক্ষিত ও অ্যাফ্লুয়েন্ট পরিবারের যে মেয়েরা রয়েছে তারা ওয়েস্টার্ন আউটফিট পরলেও তা নতুন শিক্ষিত ও অ্যাফ্লুয়েন্ট পরিবারের মেয়েদের মতো অতো প্রগলভ হয় না। ধর্ম এখানে কোনো ফ্যাক্টর নয়। হিন্দু-খ্রিস্টান-ইহুদি পুরোনো শিক্ষিত ও অ্যাফ্লুয়েন্ট পরিবারের মেয়েরাও পরিশীলিত পোশাক পরে। কারণ সে তো নতুন শিক্ষিত ও অ্যাফ্লুয়েন্ট নয় যে, কারো সামনে নিজের আধুনিকতা প্রমাণ করতে হবে। আর পোশাক মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা। কে হিজাব পরলো, কে স্কার্ট পরলো; তা নিয়ে মন্তব্য করার অধিকার অন্য কারো নেই। এই প্রাথমিক সিভিক সেন্স যার নেই; সে অবশ্যই অনগ্রসর চিন্তার মানুষ।

তসলিমা তার ক্লিশে চিন্তার স্টেরিওটাইপিং-এ অনুমান করলেন, আসিফ নজরুল শীলা আহমেদের পোশাক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আসিফ নজরুল একজন শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক ও অ্যাক্টিভিস্ট; সফল ও ব্যস্ত পুরুষেরা কখনও স্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন না। আর শীলা আহমেদও নতুন নতুন আধুনিক হচ্ছেন না যে, প্রেমিক বা স্বামীর ইচ্ছায় শাড়ি পরে খোপায় গাঁদা ফুল দিয়ে বইমেলায় ঘুরবেন অথবা শর্টস পরে কিছু একটা হয়ে ওঠা প্রমাণ করবেন। শিক্ষিত ও ব্যক্তিত্বশালী মেয়েরা নিজের যা ভালো লাগে; সেই অনুযায়ী পোশাক পরে। পোশাক কেনার সময় স্বামী বা পার্টনার সঙ্গে থাকলে বড় জোর রঙ কিংবা নকশা পছন্দে সাহায্য নেয় মেয়েরা।

আমি তসলিমা নাসরীনের নির্বাসিত জীবনের প্রতিবাদে লেখালেখি করেছি। শুধু লেখার কারণে একজন লেখক নির্বাসিত জীবন কাটাবেন; এটা হতে পারে না। ভারতে আশ্রয় নিয়ে হিন্দুত্ববাদকে সমর্থন করে তার ইসলামোফোবিক লেখালেখিকে স্টে পারমিটের জন্য কোলাবরেটরের ভূমিকা পালন বলে অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। নিজে ভারতের কোলাবরেটরহুড বেছে নিয়েছেন বলে; আগেভাগেই আসিফ নজরুলকে ধর্মবাদী রাজাকার বলে ইকুয়ালাইজ করেছেন। ফেসবুকে এরকম অসংখ্য ভারতের কোলাবরেটর ইকুয়ালাইজার রয়েছে যারা আগেভাগেই যত্রতত্র অন্য লোককে রাজাকার বলে বেড়ায়।


বিজ্ঞাপন


যেসব মেয়ের মা শিক্ষিত- মা তাদের লাইফ স্টাইল প্রসঙ্গে গাইড করবেন।  যাদের মা স্বশিক্ষিত কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন; কিংবা যারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢাকা শহরে পড়ালেখা করতে এসেছে; তাদের লাইফ স্টাইল নির্ধারণে এই তসলিমা নাসরিন ধরনের নতুন স্মার্ট আর নতুন ধার্মিক হিজাবি আপ্পিদের এড়িয়ে চলতে হবে। লাইফ স্টাইল নির্ধারণে যারা এক্সট্রিম লিবেরেল আর যারা এক্সট্রিম রেলিজিউয়াস; এরা আসলে উদ্দেশ্যহীন মানুষ। জীবনে গভীর শূন্যতার কারণে এরা লিবেরেল পুরোহিত ও ধর্ম মোল্লা হয়ে উঠেছে। ফেসবুকে সিপি গ্যাং-এর যে মহিলা শাখা চ-বর্গীয় গালাগাল করে; লোকজনকে পট করে শুয়োর, বেজম্মা, ছোট লোক ইত্যাদি গালি দেয়; এরা আসলে নতুন ফর্সা কাপড় পরে ছাপড়ি থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার সাজার চেষ্টা করছে। পোশাক আশাকের ক্ষেত্রে ললিতাদি অপর্ণা সেনকে ও সুফিয়া আপা সোফিয়া লরেনকে কপি করার চেষ্টা করছে; কিন্তু মানাচ্ছে না। আর কট্টর ইসলামি শাখার রাবেয়া আপা সৌদি রাজবংশের মেয়ে সেজে ঘোরার চেষ্টা করছে; কিন্তু মানাচ্ছে না। কাজেই কপি ক্যাটের জীবন থেকে সরে এসে বাংলাদেশের মৌলিকত্ব অনুসন্ধানই নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব।

আমি বিস্মিত হয়েছি ঈদের এই আনন্দের মাঝে নতুন প্রজন্মের তিনটি ছেলে একজন নারী সাংবাদিককে নিঃগৃহীত করেছে। যে সমাজে নারী নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারে না; সে সমাজ সভ্য নয়। পৃথিবীর যেসব সমাজ অর্থনীতি-শিক্ষা-গণতন্ত্র-মানবাধিকারে এগিয়ে আছে; সেখানে নারী নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে। নারীর প্রতি সহিংসদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সমাজ সংশোধনের একমাত্র পথ বলে মনে হচ্ছে।

ফেসবুকে কিছু নতুন পোশাক মওলানা দেখতে পাই, যারা নারীর ছবির নীচে গিয়ে সিপি গ্যাং স্টাইলে মন্তব্য করে। ফেসবুকে নারী সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য চালু করেছিলো সিপি গ্যাং। ৫ অগাস্ট পরবর্তী সময়ে যে-ই নারীর ছবির নীচে অশ্লীল মন্তব্য করবে; আমরা ধরে নেবো সে ফ্যাসিজমের দোসর। যে নারী সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে জুলাই বিপ্লবে নতুন বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছে; সেখানে নারীর প্রতি সহিংসতা ও অশালীন আচরণের কোনো জায়গা নেই। 

হাসিনাতসির পনেরো বছরে যারা ফেসবুকে নারীর প্রতি অশালীন আচরণ করেছে; তারা ব্যক্তিগত জীবনে প্রেম-বিয়ে কোনো ক্ষেত্রে সফল হয়নি। কেসস্টাডি ধরে ধরে খোঁজ নিলে বুঝতে পারবেন কিভাবে সব হারিয়ে রিক্ত হয়েছে নারী নিগ্রহকারীরা। ফেসবুকে একটি অশালীন মন্তব্য সারা জীবনের জন্য অপছন্দনীয় করে তুলে একজন মানুষকে। নতুন প্রজন্মের সামনে যেহেতু পুরো জীবনটা পড়ে আছে; তাই প্রতিটি শব্দ চয়নে সাবধান হতে হবে। নইলে ফেসবুক দেখে চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান চাকরি দিতে রাজি হবে না; বিয়ের সম্বন্ধ তৈরি হলে, ফেসবুকে অশালীন আচরণ দেখে কন্যা না বলে দেবে। তখন হতাশা আর ক্ষয়ে যাওয়ার জীবন হবে।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন


News Hub