সময়টা ছিল ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাস। যশোর থেকে কিছুদিন হলো ঢাকায় এসেছি। রাজধানী শহরে প্রায় সবই অচেনা। সারাদিন ঘুরে বেড়াই। কাজ করি দৈনিক সংগ্রামে। মেসের পাতলা ডাল আর খাওয়া-দাওয়ার হাজারো অনিয়মে অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলাম। এক সকালে উঠে দেখি ছোট খালা আর খালু কান্নাকাটি করছেন। আব্বা মা তাদের নানানভাবে সান্ত্বনা বাক্য শোনাচ্ছেন। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে শুনলাম খালার বড় ছেলে, জামাতা আর তার এক ভাই মাসাধিককাল ধরে জেল খাটছে। শুধু তাই নয়, জেলখানায় তাদের পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়েছে। মাসে একবার নিকটজনেরা দেখতে যেতে পারে। তাও হাজারো বিপত্তি। উকিল ধরেও কোনো লাভ হচ্ছে না। তারা সাফ বলে দিয়েছেন, এ কেস হাইকোর্ট ছাড়া কেউ জামিন দিতে পারবে না। যশোরের কোর্টে কোনো উকিলই মামলা নিতে চাচ্ছেন না। ডিটেনশন কেস।
আমার আব্বা ও মা দুজনই আমাকে বলতে লাগলেন, দেখ কিছু একটা করা যায় কি না। ছোটবেলা থেকেই দেখছি বাড়িতে নানা কিসিমের সমস্যা নিয়ে মানুষ আসে। কিন্তু এ জাতীয় সমস্যা কোনোদিন শুনিনি। ছোট খালার কান্না দেখে আমার খারাপই লাগল। কিন্তু আমি কী করতে পারি! আমি রিপোর্টার। বড়জোর পত্রিকায় একটি রিপোর্ট করতে পারি। তাতে কি এই গ্রামের সহজ সরল মানুষের কোনো উপকার হবে? তার ওপর আব্বা ও মায়ের বারবার তাগাদা আমার ভেতরে এক ধরনের যাতনা ও উদ্বিগ্নতা তৈরি করল। খালুর কাছ থেকে সবিস্তার শুনলাম। আলোচিত তিনজনই সতীঘাটার পাশে মনিরামপুরের কোনো এক গ্রামে রাতে নতুন আত্মীয়তা শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। সন্ধ্যার পর মনিরামপুর রুটে কোনো বাস না পেয়ে তারা হেঁটে রওনা হন। টহল পুলিশ তাদের তিনজনকেই আটক করে এবং ডাকাত সন্দেহে চালান দেয়। শুধু তাই না, কোনো রকম তদন্ত ছাড়াই তাদের ডিটেনশন দেয়। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ করে গ্রামের সহজ সরল খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এখন আইনের মারপ্যাচে তাদের জীবনাশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
আমি জানি তরিকুল ভাই রাশভারি টাইপের লোক। চলাফেরা বাঘের মতো। প্রচণ্ড দেশপ্রেমিক ও সাহসী মানুষ। কিন্তু হাসতে মানা করার কারণ আমার কাছে ছিল দুর্বোধ্য ও দুশ্চিন্তার। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে হলুদ সোডিয়াম বাতিগুলো সন্ধ্যার রাজধানী শহরকে অদ্ভুত বর্ণের করে তুলেছে। তারই মাঝ দিয়ে সড়কের বুক চিরে বেইলি রোড ধরে আমরা সিদ্ধেশ্বরী পৌঁছলাম।
আমার মন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। ঢাকায় ফিরে এসে দুয়েকজন সিনিয়রের সাথে পরামর্শ করলাম। কোনো অভয় বাক্য পেলাম না। আমি আমার পিতামাতার অবাধ্য কখনো হইনি। বারবার মনে হতে লাগল আব্বার কথা। ভাসতে লাগল আমার দুখিনী মায়ের মুখ। ছোট খালার রোদন ধ্বনি আমাকে ব্যথিত করল। সিদ্ধান্ত নিলাম, তরিকুল ভাইয়ের কাছে যাবো। কিন্তু তিনি আমার মতো অখ্যাত পুচকে ছোকড়াকে কতটা গুরুত্ব দেবেন? তিনি আমার কথাগুলো শুনবেন? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যায় অফিসে বসে মন্ত্রীর বাসায় টেলিফোন করলাম। ওপাশ থেকে একজন কে বলছেন জানতে চাইলে পরিচয় দিলাম। বললাম, আমার বাড়ি যশোর। আমি মন্ত্রীর সাথে কথা বলতে চাই। যশোরে থাকতে তরিকুল ভাই আমাকে যতটুকু চিনতেন তাতে কি আমি গুরুত্ব পাবো? মাথার ভেতর এসব ঘুরপাক খেতে খেতে মন্ত্রীর পিএ লাইনটি ট্রান্সফার করে দিলেন। আমি পরিচয় দিয়ে দেখা করতে চাইলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি শান্তস্বরে বললেন, ‘কাল বাসায় এসো।’
আমি সন্ধ্যায় মিন্টো রোডে তৎকালীন ডাক তার ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী তরিকুল ইসলামের বাসায় পৌঁছে গেলাম। ভয় শঙ্কা ও জড়তা নিয়ে মন্ত্রীর সামনে হাজির হলাম। তিনি আমাকে চিনলেন। বললেন, তোর সমস্যা কী? আমি ঘটনাটা সবিস্তার জানালাম। সারাটা জীবন বঞ্চিত ও দুখী মানুষের জন্য রাজনীতি করা তরিকুল ভাই ব্যথিত হলেন। বললেন, ভালো মানুষরাইতো মরে। তার ভেতর যেন বারুদ জ্বলে উঠল। আমাকে বললেন, পত্রিকায় একটা রিপোর্ট কর। তারপর সেটা নিয়ে কাটিংসহ একটা আবেদন নিয়ে আসবি। আমি দেখব। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক উত্তেজনা কাজ করতে লাগল। তিন দিন পর সংগ্রামের প্রথম পাতায় তিন যুবকের বিনা বিচারে ডিটেনশনের কাহিনি লেখা রিপোর্ট আর একখানা দরখাস্ত নিয়ে আমি সকাল বেলা আবার হাজির হলাম। ভাই আমাকে বললেন, সন্ধ্যার পর আসবি। তোকে নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীর বাসায় যাব। সময়মতো গেলাম।
ভক্স ওয়াগন টাইপের একটা পুরনো মডেলের টয়োটা কারে চেপে আমরা সিদ্ধেশ্বরীর দিকে রওনা হলাম। আবদুল মতিন চৌধুরী সে সময় সিদ্ধেশ্বরী ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের বিপরীতে নিজের বাসায় থাকতেন। যাবার সময় আমাকে সতর্ক করে বললেন, আমি ওখানে কিছু কথা বলব। তুই হাসবি না। কোনোভাবেই অপ্রস্তুত হওয়া যাবে না। আমি জি ভাই, জি ভাই বললেও ভেতরে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমি জানি তরিকুল ভাই রাশভারি টাইপের লোক। চলাফেরা বাঘের মতো। প্রচণ্ড দেশপ্রেমিক ও সাহসী মানুষ। কিন্তু হাসতে মানা করার কারণ আমার কাছে ছিল দুর্বোধ্য ও দুশ্চিন্তার। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে হলুদ সোডিয়াম বাতিগুলো সন্ধ্যার রাজধানী শহরকে অদ্ভুত বর্ণের করে তুলেছে। তারই মাঝ দিয়ে সড়কের বুক চিরে বেইলি রোড ধরে আমরা সিদ্ধেশ্বরী পৌঁছলাম।
বিজ্ঞাপন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসার নিচ তলায় খাস কামরা। বাইরে লালবাতি জ্বলছে। দরজা ভেড়ানো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি। তাই পুলিশের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের রাজনীতির সিংহপুরুষ আমাদের তরিকুল ভাই। লালবাতিতে তার কীই বা আসে যায়! দরজা খুলে ঢুকে পড়লেন। আমাকে বললেন, আয়। ভেতরে তখন ছাত্রদলের সভাপতি ফজলুল হক মিলন প্রমুখ মিটিং করছেন। ছাত্রদলের সাথে কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝামেলা চলছে। তরিকুল ভাইকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন সবাই। মতিন চৌধুরী শুধু বললেন, ‘আরে মিনিস্টার সাহেব। আমারে কইবেন না। আপনি আসবেন।’ তরিকুল ভাই রসিকতা করে বললেন, ‘মতিন ভাই কী আর বলব। ভাবি থাকলে না হয় বলেই আসতাম। আপনারতো ওসব বালাই নেই। আমাদের হলো হাজারো সমস্যা।’ মতিন চৌধুরী বললেন, ‘কী যে বলেন, মিনিস্টার সাব।’
প্রাথমিক আলাপ পর্ব শেষে তরিকুল ভাই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় বললে ভুল হবে উপস্থাপন করলেন। বললেন, ‘মতিন ভাই, এ হলো আমার ছোট ভাই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সভাপতি ছিল। এখন ঢাকা মহানগরী জামায়াতের মজলিসে শূরার সদস্য। দৈনিক সংগ্রামে কাজ করে। অনেক বড় নেতা।’ এক নাগাড়ে বলে থামলেন তিনি। আমি জীবনে কোনোদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইনি। আর জামায়াতের মজলিসে শূরার সদস্য হওয়ার কথা তো আমি ভাবতেই পারি না! পেটের ভেতর থেকে হাসি মোচড় দিয়ে উঠল। কিন্তু হাসতে মানা। ভাই আমার দিকে মোটা চোখে তাকাচ্ছেন। এরপর আমাদের আগমনের হেতু বর্ণনা করলেন। মতিন চৌধুরী আমাকে বড় জামায়াত নেতা ভেবে চেয়ার থেকে ফের উঠে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে মোলাকাত করলেন। আমার অবস্থা দম বন্ধ হওয়ার মতো। ভাই বললেন, ‘দরখাস্ত বের কর।’ আমি পাতলা কাগজে টাইপ মেশিনে লেখা আবেদনখানি মেলে ধরলাম। যশোরের ভাষায় কাগজ দেখে তিনি বললেন, ‘এতো ‘ন্যালফেলে’ কাগজে লিখিছিস কেন। তুই ছাত্রশিবির করতিস। শিবিরের ছেলেরাতো স্মার্ট হয়।’
মতিন চৌধুরী শুধু বললেন, ‘আরে মিনিস্টার সাহেব। আমারে কইবেন না। আপনি আসবেন।’ তরিকুল ভাই রসিকতা করে বললেন, ‘মতিন ভাই কী আর বলব। ভাবি থাকলে না হয় বলেই আসতাম। আপনারতো ওসব বালাই নেই। আমাদের হলো হাজারো সমস্যা।’ মতিন চৌধুরী বললেন, ‘কী যে বলেন, মিনিস্টার সাব।’
মতিন চৌধুরী আদ্যোপান্ত দরখাস্তখানা দেখলেন। যশোরের তৎকালীন পুলিশ সুপার আলী ইমাম চৌধুরীকে ফোন করলেন বিষয়টি জানতে। কিন্তু পেলেন না। বললেন, ‘মিনিস্টার সাহেব। কাল অফিস টাইমে আরেকটু আইসেন। এনারেও সাথে আইনেন।’ পরদিন সকালে আবার আমরা সচিবালয়ে মতিন চৌধুরীর অফিসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলাম। কাজটা হয়ে গেল। নিরপরাধ মজলুম তিনজন সাধারণ মানুষ মুক্ত হয়ে গেল। পরে আমি ভাইকে বললাম, আমাকে এভাবে শিবির নেতা বানালেন। আমিতো কোনোদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইনি। ভাই বললেন, মতিন চৌধুরী বিএনপি নেতাদের মধ্যে জামায়াতের প্রতি সবচেয়ে বেশি সহানুভূতিশীল। এই কৌশলে ছাড়া কাজ হতো না। নিরীহ নিরপরাধ মানুষগুলোকে ছাড়াতে এটুকু না করলে কিছুই হতো না। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। ভাবলাম। একজন নেতার মধ্যে সাধারণ মানুষের জন্য কী অসীম মমতা থাকলে তিনি এতটা করতে পারেন।
লেখক: হেড অব নিউজ, ঢাকা মেইল