মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

বিদ্যুৎ বিলে ‘ভূতের আছর’

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ৩০ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৩৮ পিএম

শেয়ার করুন:

Biddut

দেশজুড়ে আবারও অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিলের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও কোথাও স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি বিল আসছে। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেও অথবা মাসের বেশির ভাগ সময় বাড়িতে না থেকেও কয়েক গুণ বেশি বিল গুনতে হচ্ছে গ্রাহকদের। রাজধানীতে তুলনামূলক কম অভিযোগ থাকলেও গ্রামাঞ্চলে প্রায়ই ঘটছে এ ধরনের ঘটনা।

এটা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন গ্রাহকরা। এটাকে ভৌতিক বিল বা ভুতুরে বিল বলে আখ্যায়িত করছেন গ্রাহকরা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করেও খুব বেশি প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। খতিয়ে দেখার কথা বলে মাসের পর মাস বিদ্যুৎ অফিসে ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: ‘দ্বিগুণ’ সক্ষমতায়ও কেন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি!

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জাফরাবাদের বাসিন্দা সাকিফ সারোয়ার। পেশায় একজন আইনজীবী। ১৮ জুলাই তিনি দেশের বাইরে যান। ওই সময় তার স্ত্রীও শ্বশুর বাড়িতে চলে যান। মাসের অর্ধেকটা সময় বাসা ফাঁকা ছিল। কোনো বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়নি। তবু ওই মাসের বিদ্যুৎ বিলের কাগজ দেখে তিনি অবাক। যেখানে স্বাভাবিকভাবে তার বিদ্যুৎ বিল আসে ২৫০০-৩০০০ টাকা সেখানে জুলাই মাসে তার বিদ্যুৎ বিল এসেছে ৭৪২৭ টাকা।

ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপকালে সাকিফ বলেন, ‘আমার জুলাই মাসের বিদ্যুৎ বিল এসেছে ৭৪২৭ টাকা, জুনে ছিল ৪৩২৬ টাকা, মে'তে ছিল ৩০২০ টাকা। জুলাই মাসে আমি এবং আম্মা দেশের বাইরে চলে যাই ১৮ তারিখে। আমার স্ত্রী চলে যায় শশুর বাড়িতে। আমাদের অনুপস্থিতে বাসায় বিদ্যুৎ ব্যবহার করল কে? অতিরিক্ত এই ভৌতিক বিলের পেছনে রহস্য কী?’


বিজ্ঞাপন


একই অভিযোগ রাজধানীর বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা আসমা আক্তারের। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘বিল কীভাবে তৈরি করে বিদ্যুৎ অফিসের লোকেরা? প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কি এখন ১০০ করে ধরে? আগে যেখানে প্রতি মাসে ৩০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা বিল আসত, এখন সেখানে হঠাৎ করেই গত মাসে আসে ১০১৬৫ টাকা এবং এই মাসে আসে ৭৬৬৫ টাকা।’

power

শুধু রাজধানীতেই নয়, বিভিন্ন জেলা থেকে এ ধরনের অভিযোগ আরও বেশি পাওয়া গেছে। জয়পুরহাটের পাঁচবিবি পৌরসভার বাসিন্দা রকি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রতি মাসে আমাদের কারেন্ট বিল আসত ৪০০-৫০০ টাকা। কিন্তু গত দুই মাস ধরে ১৫০০-২০০০ টাকা আসছে। খবর নিয়ে দেখলাম প্রতিটা পরিবারের কারেন্ট বিলের একই অবস্থা। আগের চেয়ে দ্বিগুণ, তিন গুণ। হঠাৎ কেন এমন হলো জানি না।’

আরও পড়ুন: পিডিবি উৎপাদন স্বাভাবিক বললেও লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জনজীবন

রকি আরও বলেন, ‘ওদের কাছে গেছিলাম অভিযোগ করার জন্য, ওরা বলে গরম বাড়ছে, ফ্যান চললে বেশি বিল আসে। তারে কারেন্ট খায়। এসব অনেক কারণ দেখালো। আবার বলল মিটার পরীক্ষা করতে দেন। ওটা করতেও নাকি সময় লাগবে।’

খুলনার ইয়ামিন রহমান বলেন, ‘ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিল আসার কারণ কী হতে পারে? আমার বিল কখনোই ১৫০০-১৭০০ এর বেশি আসত না। কিন্তু গত দুই মাসে যথাক্রমে ৪০০০ এবং ৬০০০ টাকা এসেছে। অথচ গত মাসের ১৬ দিন আমি বাড়িতেই ছিলাম না। এভাবে বিল আসতে থাকলে তো চলতে পারব না। বিদ্যুৎ অফিসে অভিযোগ করলাম, এখনো কোনো স্টেপ নিতে দেখলাম না।’

এসব বিষয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। আলী বিন সালাম নামে একজন ফেসবুকে লিখেন, ‘গত চার পাঁচ মাস ধরে আমরা বাড়িতে থাকি না। বিদ্যুৎ ব্যবহার করি না। মিটার অফ করা। তারপরও প্রতি মাসে ১০০০/১২০০ টাকা অযথা বিল আসে! এই আজগুবি বিদ্যুৎ বিল কেন আসে? যখন ব্যবহার করতাম তখন মাত্র ৫০০/৭০০ টাকা বিল আসত। আর এখন মিটার অফ করা, তারপরও হাজারের উপরে বিল আসে প্রতি মাসে। সরকারের বিদ্যুৎ অফিসে কি ভূতে কাজ করে?’

বেলাল আহমেদ নামে আরেকজন লিখেন, ‘প্রতি মাসে আমাদের কারেন্ট বিল আসে ৪০০-৫০০ টাকা। এখন গত দুই মাস ধরে ১৫০০-২০০০ টাকার ভেতরে আসছে। খবর নিয়ে দেখলাম প্রতিটা পরিবারের কারেন্ট বিলের একই অবস্থা। আগের চেয়ে দ্বিগুণ, তিন গুণ হঠাৎ কেন এমন। এছাড়া প্রথম সংযোগের সময় মিটারের টাকা জমা দেওয়া হয়। আবার কেন প্রতি মাসে প্রতিটা মিটারের চার্জ নেন। এরকম কি আজীবন জনগণের টাকা ডাকাতি করবেন?’

আরও পড়ুন: নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ‘হতাশা’

গত কয়েক বছর ধরে মাঝেমধ্যেই ‘ভুতুরে‘ বিদ্যুৎ বিলের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এক-দেড় হাজার টাকার বিল ২০-৩০ হাজার এমনকি লাখ টাকা হওয়ার খবরও পাওয়া যায়। এই ধরনের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে দেশজুড়ে। বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর এসব বিষয়কে যথারীতি ‘লুণ্ঠন’ বলে মনে করছে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। এ বিষয়ে সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ভোক্তারা আজকে চরমভাবে এনার্জি জাস্টিজ বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলই নয়। কোম্পানিগুলো আরও নানাভাবে গ্রাহকদের ওপর লুণ্ঠন চালাচ্ছে। সরকার জ্বালানি, গ্যাস, এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দেয় একটা, ভোক্তাদের কাছে নানা অজুহাতে বিল নেওয়া হয় আরেক। এই ধরনের অভিযোগ নিয়ে ভোক্তারা বিদ্যুৎ অফিসে ঘুরেও কোনো প্রতিকার পায় না। এটাকে নিপীড়ন হয়রানি বললে ভুল হবে না।’

power2

এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘কোম্পানিগুলোর এমন আচরণ দেখে মনেই হয় না যে, এসব সরকারের কোম্পানি বা জনগণের মালিকানাধীন কোম্পানি। এরা জনগণের কাছ থেকে কী করে ফন্দি-ফিকির করে নানা উপায়ে বিল আদায় করা যায়, বেশি পয়সা আদায় করা যায়- সেই সুযোগে থাকে।’

আরও পড়ুন: অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’ চলছেই

কোনো ভোক্তা চাইলে ক্যাবের মাধ্যমেও এসব অভিযোগ জানাতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি তথ্য-প্রমাণ নিয়ে ক্যাবের কাছে আসে, তবে তাদের ক্যাবের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।’ 

খুলনার ইয়ামিন রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিল আসার কারণ কী হতে পারে? আমার বিল কখনোই ১৫০০-১৭০০ এর বেশি আসত না। কিন্তু গত দুই মাসে যথাক্রমে ৪০০০ এবং ৬০০০ টাকা এসেছে। অথচ গত মাসের ১৬ দিন আমি বাড়িতেই ছিলাম না। এভাবে বিল আসতে থাকলে তো চলতে পারব না। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) চেয়ারম্যান সেলিম উদ্দিন ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ানের মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি। তবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পরিচালক (জনসংযোগ) মো. শামীম হাসান ঢাকা মেইলকে ‘কিছু কিছু এলাকায় এই ধরনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যুতের দামও কিছুটা বেড়েছে, বিদ্যুৎ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা সেভাবে তৈরি হয়নি। বিদ্যুৎ ব্যবহার যত বেশি হবে সেই মার্জিনে দাম তত বেশি আসবে। তারপরেও যেটা অস্বাভাবিক ৩-৪ গুণ বেশি আসা এই ধরনেরও অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে কারও এই ধরনের সমস্যা হলে স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করতে পারে।’

এই ধরনের অভিযোগ সরাসরি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিআআরসি) খুব বেশি আসে না বলে জানান সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটির সদস্য (বিদ্যুৎ) আবুল খায়ের মো. আমিনুর রহমান। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এই ধরনের অভিযোগ সরাসরি আমাদের কাছে তেমন আসে না। স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসগুলোতে হয়ত কিছু অভিযোগ আসছে। তবে আমাদের কমিশনে কেউ তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ করলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’

টিএই/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর