রাজধানীর আশপাশ এলাকাসহ দেশের অনেক অঞ্চলে লোডশেডিং তীব্র আকার ধারণ করেছে। নগর এলাকায় কিছুটা স্বস্তি থাকলেও চরম অস্বস্তিতে গ্রামাঞ্চলের মানুষ। কোনো কোনো অঞ্চলে ৬-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকছে না বিদ্যুৎ। তীব্র গরমে লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। তবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে- উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে। এলাকাভিত্তিক কিছু কারিগরি ত্রুটির কারণে লোডশেডিং হতে পারে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সোমবার (২৪ জুলাই) দুপুর দুইটার দিকে লোডশেডিং ছিল ১২৭৩ মেগাওয়াট। এসময় চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৫০ মেগাওয়াট। তার বিপরীতে উৎপাদন হয় ১২ হাজার ৭১৭ মেগাওয়াট। বিকেল ৩টার দিকে আরও বাড়ে লোডশেডিং। এসময় ১৪ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয় ১২ হাজার ৯০৩ মেগাওয়াট। এতে লোডশেডিং ছিল ১২৮৬ মেগাওয়াট। বিকেল ৪টার দিকে লোডশেডিং ছিল ১১৫৬ মেগাওয়াট। এরপর বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত লোডশেডিং ছিল গড়ে প্রায় সাড়ে ৬০০ মেগাওয়াট।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: ‘দ্বিগুণ’ সক্ষমতায়ও কেন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি!
এছাড়া আগের দিন রোববার (২৩ জুলাই) সর্বোচ্চ লোডশেডিং ছিল ১৫০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত। গভীর রাতে অর্থাৎ রাত ১টার দিকে লোডশেডিং ছিল ১২১১ মেগাওয়াট। এসময় বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। তার বিপরীতে উৎপাদন ছিল ১৩ হাজার ৩৩২ মেগাওয়াট। এরপর রাত ২টার দিকে লোডশেডিং ছিল ১০৪৮ মেগাওয়াট ও রাত ৩টার দিকে ছিল ১১৩২ মেগাওয়াট লোডশেডিং।
রাজধানীর প্রধান এলাকাগুলোতে লোডশেডিং না থাকলেও সাইড এলাকা ও আশপাশের এলাকাগুলোতে কিছুটা লোডশেডিং দেখা গেছে।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকার বাসিন্দা খায়রুল জানান, দুয়েক দিন ধরে কিছুটা লোডশেডিং দেখা যাচ্ছে। সোমবার সন্ধ্যার পর তিনবার কারেন্ট গেছে এসেছে।
মুগদা এলাকার বাসিন্দা মিঠু মিয়া বলেন, ‘গতকাল আমাদের এখানে লাইনের কাজ করেছে, প্রায় ৮-১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। আবার গত পরশু দিনও কয়েকবার কারেন্ট গেছে আসছে। কয়েক দিন ধরে কিছুটা লোডশেডিং দেখা যাচ্ছে।’
একই অবস্থার কথা জানালেন বাসাবো এলাকার কয়েকজন। তারা বলছেন, দিনে ৩-৪ বার বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে। এছাড়া ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে দিনে কয়েকবার লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে। সাভারের অনেক এলাকায় দিনের বড় একটা সময় বিদ্যুৎ থাকে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকার রুহুল আমিন বলেন, ‘কয়েক দিন ধরেই লোডশেডিং দেখা যাচ্ছে। গতকালকেও (সোমবার) ৫-৬ বার কারেন্ট গেছে আসছে। গড়ে প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা কারেন্ট থাকছে না। কয়েক দিন ধরেই আবহাওয়াটা অনেক গরম। একবার কারেন্ট গেলে গরমে অনেক কষ্ট হচ্ছে।’
আরও পড়ুন: মধ্যরাতে লোডশেডিংয়ে দুর্বিষহ জনজীবন
জামালদি এলাকার আরেকজন একই কথা জানালেন। তিনি বলেন, ‘যখন আবহাওয়াা একটু ঠান্ডা থাকে তখন লোডশেডিং হয় না। আবার যখন প্রচণ্ড গরম, ঠিক তখন লোডশেডিং শুরু হয়। আমাদের যখন দরকার তখন কারেন্ট থাকে না।’
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পিডিবির দাবি, উৎপাদন স্বাভাবিক রয়েছে। যেসব এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে সেসব এলাকায় কিছু কারিগরি ত্রুটির কারণে সাময়িক লোডশেডিং হচ্ছে। এ বিষয়ে সংস্থাটির উৎপাদন বিভাগের সদস্য এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনে আপাতত কোনো ঘাটতি নেই। আবহাওয়ার টেম্পারেচার বাড়ার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা যখন বাড়ছে তখন আমরা অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করেছি। আমাদের রামপাল, বরিশাল, সিরাজগঞ্জসহ অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রই এখন চালু আছে। যেসব এলাকায় এখন লোডশেডিং হচ্ছে এগুলোতে অন্য কোনো কারিগরি বা মেইন্টেইন সমস্যা থাকতে পারে। এসব এলাকার লোডশেডিং উৎপাদন ঘাটতির কারণে নয়।’
এদিকে রাজধানী ও এর আশপাশ এলাকায় কিছুটা স্বস্তি থাকলেও নাজুক অবস্থা গ্রামে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রামাঞ্চলগুলোতে অনেক এলাকায় ৬-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। উত্তরের জেলা দিনাজপুরের প্রত্যন্ত এক গ্রামে কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা জানান, কিছুক্ষণ পরপর বিদ্যুৎ চলে যায়। কয়েক দিন ধরেই নাজুক অবস্থা চলছে সিলেটে। যদিও সোমবার জাতীয় গ্রিডে সমস্যার কারণে প্রায় দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল পুরো সিলেট বিভাগে। সেটা ছাড়াও এই অঞ্চলে লোডশেডিং যেন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন: নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ‘হতাশা’
এদিকে লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে সিলেটের সাধারণ মানুষ। ঘনঘন লোডশেডিং বন্ধ এবং বিদ্যুতের অনিয়ম, অপচয় ও দুর্নীতি রোধের দাবিতে গত রোববার (২৩ জুলাই) বিকেলে নগরীর বন্দরবাজারে কোর্ট পয়েন্টে এক বিক্ষোভ সমাবেশ করে গ্যাস-বিদ্যুৎ গ্রাহক কল্যাণ পরিষদ। লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদ থেকে ঘটেছে অপ্রীতিকর ঘটনাও। গত ১৬ এপ্রিল ফেনীর ছাগলনাইয়ায় লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের অভিযোগ কেন্দ্রে হামলা ও ভাঙচুর করেছে স্থানীয় গ্রাহকেরা। ওইদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে ছাগলনাইয়া পৌর এলাকায় পল্লী বিদ্যুৎ অভিযোগ কেন্দ্রে এই ঘটনা ঘটে।
সরকারের ভুল নীতি এবং স্থায়ী সমাধান না থাকার কারণে লোডশেডিংয়ের মতো ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন নাগরিক সমাজের নেতারা। এ বিষয়ে সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দীন আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কয়লা আমদানির পর পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে সেই সাথে আদানির নতুন বিদ্যুৎ যুক্ত হওয়ার ফলে আমাদের ধারণা ছিল, বিদ্যুতের লোডশেডিং আর হবে না হয়ত। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে মফস্বল এলাকায় বিশেষ করে পল্লী বিদ্যুৎ এবং নেস্কো গ্রাহকদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। লোডশেডিংয়ের মাত্রা এতদিন মফস্বলে থাকলেও গত ২-৩ দিন যাবত রাজধানীতেও মাত্রা অতিরিক্তভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।’
রাজধানী ও এর আশপাশ এলাকায় কিছুটা স্বস্তি থাকলেও নাজুক অবস্থা গ্রামে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রামাঞ্চলগুলোতে অনেক এলাকায় ৬-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। উত্তরের জেলা দিনাজপুরের প্রত্যন্ত এক গ্রামে কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা জানান, কিছুক্ষণ পরপর বিদ্যুৎ চলে যায়।
মহিউদ্দীন বলেন, ‘আজ আমার নিজের বাসা শনির আখড়াতেই দিনে তিনবার লোডশেডিং হয়েছে। গতকাল রাতেও দুবার লোডশেডিং হয়। মশার আক্রমণ আর ডেঙ্গু পরিস্থিতি যখন ভয়াবহ এর মধ্যে নতুন করে বিদ্যুৎ সংকট জীবনযাত্রাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আজ আমার মেয়ে অভিযোগ করে জানায় ওদের হলে রাতের বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকে না। বিদ্যুতের একটি স্থায়ী সমাধান খুব জরুরি। দ্রুত সমাধান করা না গেলে ডেঙ্গু মহামারির মধ্যে জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘বিদ্যুৎ নাই অথচ গত মাসে ডিপিডিসির বিদ্যুতের বিলে চরম বৈষম্য আমরা লক্ষ্য করেছি। ৫০০-৬০০ টাকা যার বিল আসতো তার দুই থেকে তিন হাজার টাকা বিল এসেছে। এমনিতেই সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের লুটপাট নিয়ে চরম অসন্তোষ আছে। নতুন করে আবার লোডশেডিং যুক্ত হলে আগামী দিনে সরকারের জন্যই খারাপ সংকেত বয়ে আনতে পারে।’
টিএই/জেবি