বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

‘দ্বিগুণ’ সক্ষমতায়ও কেন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি!

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০৮ জুন ২০২৩, ০১:১৭ পিএম

শেয়ার করুন:

‘দ্বিগুণ’ সক্ষমতায়ও কেন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি!

গত বছরের ২১ মার্চ দেশের বৃহত্তম পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে শতভাগ বিদ্যুতায়নের দেশ ঘোষণা করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে সারাদেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা আসে। জানানো হয়, বর্তমান সরকারের টানা ১৪ বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্র বেড়েছে ১২৭টি, উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ গুণ।

বিদ্যুৎ বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের বর্তমান ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট। কিন্তু বর্তমানে ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতেই হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সক্ষমতা থাকতেও কেন অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন?


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: মধ্যরাতে লোডশেডিংয়ে দুর্বিষহ জনজীবন

পাওয়ার ডিভিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালে দেশে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ২৭টি। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫৩ টিতে, যা ২০০৯ সালের তুলনায় প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ। এই সময়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র বেড়েছে ১২৭টি। এর মধ্যে মাত্র একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র মেয়াদোত্তীর্ণ। এছাড়া ওইসময় দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। ১৪ বছরের ব্যবধানে ২০২৩ সালে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াটে। অর্থাৎ বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালের তুলনায় পাঁচ গুণের বেশি।

জ্বালানি খাতে সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। কোন ধরনের জ্বালানি কী পরিমাণে দরকার তার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকা উচিত। পরিকল্পনার পাশাপাশি অর্থের বরাদ্দ সংস্থানও রাখার দরকার ছিল। এই কাজগুলো করা হয়নি।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট। অপরদিকে চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। এছাড়াও তখন বিদ্যুতের মোট সঞ্চালন লাইন ছিল আট হাজার কিলোমিটার। বিদ্যুতায়িত বিতরণ লাইন ছিল দুই লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। ২০২৩ সালের মে মাসে মোট সঞ্চালন লাইন দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৬৭২ কিলোমিটারে। বিদ্যুতায়িত বিতরণ লাইন হয়েছে ছয় লাখ ২৮ হাজার ৫৬২ কিলোমিটারে। ২০০৯ সালে কোনো বিদ্যুৎ আমদানি হতো না। বর্তমানে বিদ্যুৎ আমদানি হয় ১৯০৮ মেগাওয়াট।


বিজ্ঞাপন


PP1

তবে গ্রাহক ও মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণও বেড়েছে কয়েক গুণ। ২০০৯ সালে বিদ্যুতের গ্রাহক ছিল এক কোটি আট লাখ। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ঘণ্টায় ২২০ কিলোওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহক চার কোটি ৪১ লাখ। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ঘণ্টায় ৬০৯ কিলোওয়াটে।

পিডিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে স্বাভাবিক অবস্থায় দেশে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে ১৪০০০-১৫০০০ মেগাওয়াট। শীতের সময় চাহিদা থাকে ১০ হাজার মেগাওয়াটেরও নিচে। অর্থাৎ দেশের আবহাওয়া পরিস্থিতির ওপর তা উঠানামা করে। সে হিসেবে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ। বিদ্যুৎখাতে সরকারের এত উন্নয়নের পরও গেল বেশ কয়েক দিন ধরে তীব্র লোডশেডিংয়ে নাজেহাল পুরো দেশ। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতেই চলছে দফায় দফায় লোডশেডিং। গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও ভয়াবহ। বিশেষ করে রাতের লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জনজীবন। কয়েক দিন ধরেই দেশে তীব্র তাপদাহ চলছে। এতে চাহিদা বাড়তে থাকে বিদ্যুতের।

আরও পড়ুন: লোডশেডিং অসহনীয় পর্যায়ে, সমাধানের চেষ্টা চলছে: প্রতিমন্ত্রী

তীব্র লোডশেডিংয়ে দুর্ভোগের কথা স্বীকার করছে সরকারও। অসহনীয় পর্যায়ে লোডশেডিংয়ের কারণে দুঃখ প্রকাশ করে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমাদের লোডশেডিং বেড়ে গেছে। আমরা বারবার বলে আসছিলাম, বিশেষ করে আমাদের যে ফুয়েল গ্যাস কয়লা তেল, দীর্ঘ সময় লাগছে এগুলো যোগান দিতে। এ কারণে আমাদের লোডশেডিংয়ের জায়গাটা আরও দীর্ঘতর হচ্ছে। এখন যে সমস্যাটা দেখা দিয়েছে আমরা দেখছি পরিস্থিতি অনেকটা অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে। আমরা বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে চেষ্টা করছি, এটা কত দ্রুত সমাধান করা যায়। সরকারের পক্ষ থেকে এটা সমাধানের চেষ্টা চলছে। কত দ্রুত অন্তত পায়রাতে কয়লা নিয়ে আসা যায় সেই চেষ্টা চলছে।’

বর্তমানে দেশে চলমান তীব্র তাপদাহের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। সবথেকে বড় বিষয় হচ্ছে, বৈশ্বিক সংকটের কারণে বাংলাদেশকেও এর খেসারত দিতে হচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি কয়লা আমদানি করা যাচ্ছিল না। কয়লা না থাকায় সংকটের কারণে পায়রার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বুধবার (৭ জুন) বিকেল ৪টায় তিন হাজার ৪১৯ মেগাওয়াট লোডশেডিং দেওয়া হয়। ওই সময় ১৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয় ১১ হাজার ২২০ মেগাওয়াট। যা গত কয়েক দিনে সর্বোচ্চ লোডশেডিং। এছাড়াও গত কয়েক দিন ধরেই চাহিদার বিপরীতে ১৫০০-৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পরিচালক (জনসংযোগ) মো. শামীম হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশে চলমান তীব্র তাপদাহের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। সবথেকে বড় বিষয় হচ্ছে, বৈশ্বিক সংকটের কারণে বাংলাদেশকেও এর খেসারত দিতে হচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি কয়লা আমদানি করা যাচ্ছিল না। কয়লা না থাকায় সংকটের কারণে পায়রার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।’

TT

শামীম হাসান বলেন, এছাড়াও ডিজেলে পাওয়ার প্লান্টগুলাও বন্ধ রয়েছে। রামপালসহ অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতেও উৎপাদন কম হচ্ছে। আমাদের গ্যাসের যে ডিমান্ড সেটাও পূরণ হচ্ছে না। ১৪০০ এমএমসিএফ আমাদের ডিমান্ড। কিন্তু আমরা সাড়ে আটশ থেকে সাড়ে নয়শ এমএমসিএফ গ্যাস পাচ্ছি। যার কারণে উৎপাদন কম হচ্ছে। এই ধরনের নানা কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন কম হচ্ছে। লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। আমরা চিন্তা করছি আরও এক হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন বাড়ানোর। এছাড়াও ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও চালু করার চিন্তা করা হচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যে কয়লা চলে আসবে। খুব শিগগিরই এই সমস্যার সমাধান হবে।’

আরও পড়ুন: লোডশেডিং নিয়ে যা বললেন প্রধানমন্ত্রী

সরকারের ভুল নীতির কারণে জ্বালানি খাত সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অব্যবস্থাপনার কারণে সিস্টেমের ওপর কন্ট্রোল নেই। এ বিষয়ে ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘জ্বালানি খাতে সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। কোন ধরনের জ্বালানি কী পরিমাণে দরকার তার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকা উচিত। পরিকল্পনার পাশাপাশি অর্থের বরাদ্দ সংস্থানও রাখার দরকার ছিল। এই কাজগুলো করা হয়নি। এছাড়াও জ্বালানি সরবরাহে যেসব পরিকল্পনা করা হয়েছিল এগুলো শুধু কাগজে-কলমে তৈরি করেছিল, বাস্তবায়ন করেনি। যার কারণে উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও উৎপাদন করতে পারছে না। আবার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে, মূল্য বৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা নেওয়া হয়নি। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপে গলদ আছে। এখন সবকিছু রিভিউ করার সময় এসেছে।

টিএই/জেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর