বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’ চলছেই

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০৯ আগস্ট ২০২৩, ০৭:৪১ এএম

শেয়ার করুন:

অবৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’ চলছেই

অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই অভিযান পরিচালনা করে বিতরণ সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। এ বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথাও বলে সংস্থাটি। অভিযানে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি খুলে নিয়ে আসা হয় গ্যাস সংযোগ পাইপ লাইন, রাইজারসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ জিনিসপত্র। করা হয় জরিমানা। কিন্তু তারপরও অবৈধ গ্যাস সংযোগ থামছে না। সকালে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলে রাতেই অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীরা আবার সংযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টিকে ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’ অভিহিত করে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন খোদ তিতাস এমডি। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিতাসের লোকজনই এসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীদের কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে বছরের পর বছর অভিযান চালিয়েও কোনো লাভ হবে না।

তিতাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে ৬ লাখ ২ হাজার ৮৮৪টি অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এরমধ্যে ২৫০টি শিল্প-কারখানা, ৩২৯টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ৫৫টি ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ১০টি সিএনজি ফিলিং স্টেশনে মিটার টেম্পারিংসহ নানা অনিয়ম পাওয়া যায়। বকেয়ার কারণে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ১৫০টি শিল্প সংযোগ, ১৩৭টি বাণিজ্যিক সংযোগ, ১১৭টি ক্যাপটিভ সংযোগ ও ৪৩টি ফিলিং স্টেশনের সংযোগ। এসব অভিযানে জরিমানা করা হয়েছে ৯১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। অতিরিক্ত বিল আদায় হয়েছে ১৪৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা।


বিজ্ঞাপন


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব অবৈধ গ্যাস লাইনের বড় একটা অংশের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পরও দুষ্কৃতিকারী চক্রের মাধ্যমে আবারও সংযোগ পেয়ে যায়। যদিও তিতাস দাবি করছে, আগের থেকে এটা অনেক কমেছে।

সম্প্রতি রাজধানীর গেন্ডারিয়া এলাকায় একটি ফেব্রিক্স কারখানায় অভিযান চালায় তিতাস। এ সময় তিতাসের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী কে এম মনিরুল ইসলাম জানান, এই কারখানায় এর আগেও অভিযান চালানো হয়েছিল। সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও জরিমানা করা হয়েছিল। কিন্তু এরপরও এই কারখানায় অবৈধভাবে গ্যস ব্যবহার করে কারখানা চালানো হচ্ছে।

কিছুদিন আগে সাভারের গেণ্ডা এলাকায় একটি পাঁচতলা বাড়িতে অবৈধভাবে ২০টি চুলায় তিতাসের গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছিল। এ বিষয়ে তিতাস কার্যালয়ে অভিযোগ করার পর দুইবার ওই বাড়িটির গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু কয়েকদিন পরই বাড়িটিতে আবার অবৈধভাবে সংযোগ দিয়ে গ্যাস ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আশুলিয়া ও সাভারের গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরকম আরও অনেক ভবন আছে। সবাই জানলেও এ নিয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি না। আশুলিয়ার নিউমার্কেট এলাকার লোকজনের দাবি, গত এক বছরে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে যতগুলো রাইজার কেটে নিয়েছে তার অধিকাংশগুলোতেই পুনরায় অবৈধভাবে সংযোগ দেওয়া হয়েছে।


বিজ্ঞাপন


এ বিষয়ে সাভার আঞ্চলিক বিপণন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী অজিত চন্দ্র দেব ঢাকা মেইলকে বলেন, একটা দুষ্কৃতিকারী চক্র রাতের আঁধারে এই ধরনের কাজ করে থাকে। দেখা যায়, আমরা দিনের বেলায় তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে আসলাম, আবার রাতের আঁধারে তারা সংযোগ নিয়ে নিচ্ছে। যারা এই অবৈধ সংযোগ ব্যবহার করছে তারা কখনোই স্বীকার করছে না কে তাদের এই সংযোগ দিচ্ছে। আমাদের তো আর সেই ক্ষমতা নেই যে তাদেরকে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করব। আমরা মামলা করি— এ পর্যন্তই আমাদের কাজ।

তিতাসের মহাব্যবস্থাপক রশিদুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, একবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পরে সেখানে যদি আবারও অবৈধভাবে সংযোগ নেওয়া হয় তবে আমরা সাথে সাথে সেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করি। তারা আর সংযোগ পায় না।

এর আগে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ মোল্লাহ্ আক্ষেপ করে বলেন, অনেকে বলেন, অবৈধ সংযোগ রয়েছে, তিতাস কিছু করে না। আমাদের লাখ লাখ অবৈধ সংযোগ রয়েছে। আমরা কাটছি, তারা আবার লাগাচ্ছে। ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে, আমাদের লোকবল কম, তাদের সঙ্গে পেরে উঠছি না। অবৈধ সংযোগ প্রতিরোধে আপনাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। না হলে আমাদের একার পক্ষে সম্ভব না।

তিতাসের অসাধু কিছু কর্মকর্তা এরসঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়— সাম্প্রতি এ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিতাস এমডি কিছু অভিযোগের সত্য রয়েছে। তবে বাইরের লোকজন বেশি অপকর্ম করছে। ঠিকাদাররাই কাজগুলো করে থাকে। আমরা ৮ জনকে বরখাস্ত করেছি, ১৬ জনকে সাময়িক বরখাস্তসহ ২২৮ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ৯১ জনকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে।

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিতাসের লোকজনই এসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। এটা একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।

এ বিষয়ে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন যারা এসব অবৈধ সংযোগ দিচ্ছে, যাদেরকে দিয়ে সংযোগ করানো বা দেওয়ানো হচ্ছে, এগুলো তাদের একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তাদের অসাধু কর্মকর্তা, তাদের কন্টাক্টার এর সাথে জড়িত। এতে করে কি হয়, যাদের অবৈধ কানেকশন দেওয়া হয়, তাদের টাকা বেশি খরচ হয়। এগুলো একটা সিস্টেম বানিয়ে ফেলেছে তারা। কারা এসব করছে তা খুঁজে বের করার কাজ গোয়েন্দা সংস্থাকে দিতে হবে। আমি মনে করে, অবৈধ সংযোগ প্রথমেই কাটার দরকার নাই। আগে সব অবৈধ সংযোগগুলো প্রকাশ করতে হবে। তারপর অন্য একটা সংস্থার মাধ্যমে সেটা সার্ভে করে বের করতে হবে। তারপর সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে এদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে হবে। তা না করে অভিযানের নামে মানুষ দেখানো, মানুষ ঠকানো ছাড়া কিছুই না।

টিএই

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর