হাসিব ইকবাল ও ফারজানা অর্থি দম্পতি ঢাকা থেকে বেড়াতে গেছেন সুনামগঞ্জ জেলার টাঙ্গুয়ার হাওরে। নীলাদ্রি লেকের নীল পানি, একপাশে থাকা মেঘালয়ের পাহাড়সহ চারপাশে ছড়ানো ছিটানো পাথর দেখছিলেন কানে হাত চেপে। কারণ জানতে চাইলে ইশারায় জানালেন, একটু পরে কথা বলবেন।
পরে হাসিব ইকবাল বলেন, সারি সারি মোটরবাইকের উচ্চ শব্দের হর্ন আর নিতে পারছিলাম না। ‘হাউজ বোট’ থেকে ভেসে আসছে উচ্চ শব্দের ডিজে গান। ইঞ্জিনচালিত নৌকা, হাউজ বোটের খট খট শব্দ। কিছু সময়ের জন্য মনে হয়েছিল বধির হলে বুঝি প্রকৃতির অপরূপ স্নিগ্ধতা জড়িয়ে নেওয়া যেত।
বিজ্ঞাপন
ফারজানা অর্থি বললেন, বিরাট হাঁকডাক সব দখলে নিয়েছে। প্রকৃতির কাছে এসেও উচ্চ শব্দে পরিশ্রান্ত লাগে। আমাদের দায়িত্বশীল আচরণই হয়তো এর থেকে মুক্তি দেবে।

প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত এটি। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝর্না এসে মিশেছে এই হাওরে। জীববৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের কারণে টাঙ্গুয়ার হাওরের সুনাম শুধু সুনামগঞ্জ বা বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। তাই তো দৃষ্টিনন্দন হাওরটি দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন অসংখ্য পর্যটক। তাদের আগমনে হাওর মুখর থাকলেও শব্দ দূষণের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরেজমিনে হাওরে শব্দ দূষণ রোধে প্রশাসনের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। পর্যটক ও নৌকার কর্মীদের মধ্যে নেই সচেতনতা। বেড়াতে আসা পর্যটকরা পড়ছেন ভয়াবহ শব্দ দূষণের কবলে। নৌভ্রমণে ব্যবহৃত ইঞ্জিনচালিত যানবাহন চলছে লাগামহীনভাবে। এসব নৌকায় উচ্চ শব্দে চলছে গান। গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পটগুলোতেও পর্যটকদের কান ঝালাপালা হওয়ার অবস্থা। মাঝ হাওরেও উচ্চ শব্দের এমন উৎপাত। পর্যটক পরিবহন করা নিয়ন্ত্রণহীন মোটরবাইকগুলো উচ্চ শব্দে হর্ন দিয়ে দলবেঁধে ছুটছে এদিক সেদিক।
বিজ্ঞাপন
হাওরের এমন পরিবেশ বিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন পরিবেশবাদীরা। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান ঢাকা মেইলকে বলেন, হাওরে হাজার হাজার মানুষ ভ্রমণে আসছে। এ নিয়ে ব্যস্ততাও বেড়েছে। উচ্চ তীব্রতাসম্পন্ন শব্দে জীব-পরিবেশ ও মানুষের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী যেকোনো ধরনের হর্নে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় দূষণের মাত্রা বেড়েই চলছে।

আবু নাসের খান বলেন, উচ্চ শব্দে মানুষের স্বভাব ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। হাওরে মানুষ আসে নিজেদের শহুরে জীবন থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতে। এখানেও সেই ঘাতক শব্দ। যা বাড়ায় বিরক্তি আর তিক্ততা।
তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী টেকেরঘাট গ্রামের বাসিন্দা কাদের জার্জিজ। পেশায় একজন মোটরবাইক চালক। টেকেরঘাট থেকে লাকমাছড়া, বারিক টিলায় নিয়মিত পর্যটকদের নিয়ে যান। আলাপকালে জানান, আগে বাইক কম ছিল। প্রতিযোগিতাও কম ছিল। উচ্চ শব্দে হর্ন দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, হর্ন বাজায় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। অনেক সময় ভ্রমণে আসা লোকজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের সরাতে হর্ন দেই। এই শব্দে নিজেরও কষ্ট হয়। অনেক সময় দর্শনার্থীদের সাথে খারাপ আচরণ করে বসি। বাসায় ফিরে বউ-বাচ্চাদেরও বিরক্ত লাগে।
জাদুকাটা নৌ পরিবহনের মাঝি আঁখি জানান, যারা বেড়াতে আসেন তারা যদি বক্স দিয়ে গান বাজাতে চান আমরা কি করে নিষেধ করি? আমাদের টাকা দেয়, ব্যবস্থা করে দেই। বছরের কিছু সময় কড়াকড়ি থাকে, তখন এসব কম চলে। তখন বোটও নির্ধারিত স্থান দিয়ে চালাতে হয়।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, দিনে দিনে শব্দদূষণ মহামারি আকার ধারণ করেছে। উচ্চমাত্রার শব্দের মধ্যে বাস করতে করতে মানুষের স্বভাব ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। এর কারণে অনেক সময় পারিবারিক বিপর্যয়ও নেমে আসে।
ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ৬০ ডেসিমেলের বেশি শব্দ মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর। অধিক মাত্রায় শব্দ হলে হাওরের জীববৈচিত্র্য মধ্যে জলজ প্রাণীদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে। একটি নির্দিষ্ট মাত্রার শব্দে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন করার কথা। অধিক মাত্রার শব্দে মাছ ভয় পেয়ে যায়।

এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, অধিক শব্দ যে শুধু মাছের জন্য অসুবিধার কারণ তা নয়, অন্যান্য পোকামাকড়-কীটপতঙ্গও শব্দের কারণে আশপাশে থাকে না। পোকামাকড় না থাকলে হাওরের গাছগাছালির ফুলের পরাগায়ন ব্যাহত হয়। সার্বিকভাবে শব্দ দূষণ প্রাণী, উদ্ভিদের জন্য হুমকির কারণ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলনের সভাপতি প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক জীববৈচিত্রের নিজস্ব বসবাসস্থল আছে। মাছ আমাদের পুষ্টির চাহিদা মেটায়। কিন্তু মাছের প্রজননে আমরা বিভিন্নভাবে ব্যাঘাত সৃষ্টি করি বা ধ্বংস করি। তার মধ্যে অন্যতম হাওর এলাকায় উচ্চ শব্দ। যার প্রভাব এরইমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। মাছের উৎপাদন পরিমাণ কমে গেছে। গত বছরের তুলনায় হাওরে অনেক কম মাছ পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোটের (বিএনসিএ) সদস্য সচিব আনোয়ারুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, শব্দ দূষণ পাখির ডাকে হস্তক্ষেপ করে। খাদ্য খুঁজে পাওয়াসহ প্রজননে ব্যাঘাত ঘটায়। অন্যান্য প্রাণীদেরও সঙ্গমে অসুবিধা হয়। এ অবস্থা চলমান থাকলে প্রজাতিগুলো বিলুপ্তির দিকে চলে যেতে পারে।
যা বলছে স্থানীয় প্রশাসন
টাঙ্গুয়ার হাওরে আগত পর্যটক ও পর্যটকবাহী নৌযানের নিরাপত্তায় কাজ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এ নিয়ে পর্যটকদের নিরাপত্তায় ১০ নির্দেশনা জারি করেছে মধ্যনগর থানা পুলিশ প্রশাসন।
মধ্যনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল হক জানান, হাওরের পরিবেশ রক্ষা, নৌদুর্ঘটনা এড়ানো, গণউপদ্রব রোধ এবং সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওরে আগত পর্যটকদের নিরাপত্তার স্বার্থে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে—
১. কোনো নৌযানে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পর্যটক বা যাত্রী পরিবহন করা যাবে না।
২. নৌযান চলাচলের সময় কিংবা পানিতে নামার সময় প্রত্যেক পর্যটক এবং নৌচালক আবশ্যিকভাবে লাইফ জ্যাকেট পরিধান করবেন।
৩. বিরূপ আবহাওয়া থাকলে নদীতে কিংবা হাওরে ভ্রমণ করা যাবে না।
৪. প্রতিটি নৌযানকে হাওর বা নদীতে যাত্রা শুরুর অন্তত ৬ ঘণ্টা পূর্বে নির্ধারিত ফরমে মধ্যনগর থানার ডিউটি অফিসারকে (মোবাইল নম্বর-০১৩২০-১২১০৫৫) অবহিত করতে হবে।

৫. পর্যটক নৌচালকদেরকে নৌযানে এবং স্থলভাগে চলাচলের সময় মাস্ক পরিধান করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
৬. প্রতিটি নৌযান এবং নৌঘাটে ময়লা আবর্জনা ফেলার জন্য নির্ধারিত ডাস্টবিনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। নৌযান মালিক সমিতি এবং নৌচালকরা বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
৭. নির্ধারিত স্থান ছাড়া হাওর বা নদীর পানিতে বা স্থলভাগের কোথাও কোনো ধরনের ময়লা আবর্জনা ফেলা যাবে না।
৮. পর্যটকবাহী নৌযান যেকোনো স্থলভাগের কাছাকাছি অবস্থানকালে উচ্চশব্দে কোনো ধরনের মাইক বা লাউড স্পিকার বাজাতে পারবে না।
৯. প্রতিটি নৌযান পর্যটকদের জন্য মানসম্মত পরিবেশ তথা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও পর্যাপ্ত সুবিধাদি নিশ্চিত করবে।
১০. নোঙরের স্থানে দুষ্কৃতিকারীরা থাকতে পারে। তাদের থেকে পর্যটকদের সাবধান থাকার জন্য অনুরোধ করা হলো।
ডিএইচডি/জেএম