রাত পোহালেই ঈদ উদযাপনে মাতবে দেশ। ঈদে এলে প্রতিটি পরিবারে বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। সবাই ভাগাভাগি করে নেন ঈদ আনন্দ।
আনন্দের বার্তা নিয়ে বছর ঘুরে আবারও ঈদ এলেও সব পরিবারে নেই আনন্দ। বিশেষ করে জুলাই শহীদ পরিবারের জন্য যেন বেদনায় ভরা এবারের ঈদ। গত বছরের ঈদে যাদের উপস্থিতি আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েকগুণ এবার সেই প্রিয় মুখগুলো নেই। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন তারা। তাদের হারিয়ে এসব পরিবারে ঈদের আনন্দ উৎসবের আমেজ নেই। রংপুরের ৭ জুলাই শহীদ পরিবারের ঈদ নিয়ে লিখেছেন ঢাকা মেইলের রংপুর প্রতিনিধি রেজাউল করিম জীবন।
বিজ্ঞাপন
পুলিশের গুলি আমার পরিবারের সব স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে: সাঈদের বাবা
গত বছরের ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ১নং গেটের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন। আবু সাঈদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ। আবু সাঈদের মৃত্যুর পরে সারাদেশে আন্দোলন বেগবান হয়। তীব্র জনরোষের মুখে ৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের।
ঈদের আগে ছেলের কথা স্মরণ করতে গিয়ে আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘প্রতি বছর সাঈদসহ পরিবারের অন্য ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। ভার্সিটি থেকে বাড়িতে এলে একসঙ্গে ইফতার করতাম। এবারও ইফতার-সেহরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সাঈদের সঙ্গে হয়নি। বাড়িতে সবাই আছে শুধু আবু সাঈদ নাই। কথাগুলো বলার সময় তার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে।
আবু সাঈদের বাবা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রতি বছর ঈদে কিছু না কিছু নিয়ে আসত সাঈদ। গত বছর পাঞ্জাবি এনেছিল। আবু সাঈদ ঈদে বাড়িতে এলে সবসময় হাসি আনন্দে থাকতো। ভাতিজাসহ ছোট ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতো। গ্রামের সবার সঙ্গে দেখা করে কুশল বিনিময় করতো। মুরব্বিদের কাছে দোয়া চাইতেন। এবার পাঞ্জাবি আনবে না আবু সাঈদ। পুলিশের গুলি আমার পরিবারের সব স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
আবু সাঈদের ভাই আবু হোসেন বলেন, ‘এবারের ঈদে আমাদের বাড়িতে কোনো আনন্দ নেই। বাড়িটা শূন্য শূন্য লাগছে। আমরা আবু সাঈদের অভাব অনুভব করছি। প্রতিবছর বাবাসহ সব ভাইয়েরা একসঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। এবার তাকে ছাড়াই ঈদের নামাজ পড়তে হবে।’
এবারের ঈদে আনন্দ নয়, থাকবে চোখের পানি: মিলনের স্ত্রী
পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো মানুষটিই চলে গেছেন। আমাদের আবার ঈদ আনন্দ, বলেই চোখের পানি ছাড়েন স্বর্ণকার শহীদ মুসলিম উদ্দিন মিলনের স্ত্রী দিলরুবা আকতার।
গত বছরের ১৯ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন মিলন।
মিলনের স্ত্রী বলেন, প্রতি বছর ১৫ রমজানের মধ্যেই সন্তানদের জন্য নতুন জামাকাপড় কিনতেন মিলন। তারপর পরিবারের অন্যদের মুখে হাসি ফোটাতেন। বিগত বছরের ঈদগুলোতে ঈদের দুই তিন আগে থেকেই বাড়িতে উৎসব শুরু হতো। ঈদের দিন তিনি (স্বামী মিলন) আগেই উঠতেন। সেমাই রান্না করতে বলতেন। সেমাই রান্না হলে পরিবারের সবার সঙ্গে সেমাই খেয়ে নামাজে যেতেন। নামাজ আদায় করে এসে আবার পরিবারের সবার সঙ্গে বসে খাবার খেতেন। বিকেলে সন্তানকে নিয়ে ঘুরতে যেতেন বাইরে। সন্ধ্যায় সময় হলে আমিও যেতাম। ঈদ ঘিরে কত পরিকল্পনা থাকতো আমাদের। সবশেষ হয়ে গেছে এক গুলিতে। ঈদে অন্যদের আনন্দ থাকবে আর আমাদের চোখের পানি।
এখনো বাবার অপেক্ষায় থাকে সাংবাদিক প্রিয়’র মেয়ে সাদিরা
চার বছর বয়সী সাদিরা জামান সবসময় বাবাকেই শুধু খোঁজেন। জানতে চায়, বাবা কখন আসবে, এ অবুঝ শিশুকে বোঝাবে কে, যে তার বাবা আর কোনদিন আসবে না। চলে গেছে চিরদিনের জন্য। ঈদে সবার আগে প্রিয় তার মেয়ের জন্য কেনাকাটা করতো। আমরা তার জন্য কেনাকাটা করেছি কিন্তু তার বাবা তো নতুন জামা নিয়ে আসেনি।
এভাবেই কথাগুলো বলেন, সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়’র মা সামসি আরা জামান কলি। সাংবাদিক প্রিয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।
যখন প্রিয়’র মা কথা বলছেন, তখন শহীদ প্রিয়’র মেয়ে চেয়ার থেকে উঠে বাবার (প্রিয়’র) ছবি নামিয়ে বাবা বাবা বলে আদর করে। চুমো দেয়। এসময় বলতে থাকে বাবা তুমি কখন আসবে। আমাকে কোলে নিয়ে আদর করবে। আমার কপালে চুমো দেবে। তার প্রশ্নে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
প্রিয়’র মা বলেন, কিছুদিন আগে ঢাকায় গিয়ে প্রিয়’র অফিসে গিয়েছিলাম। সেখানেও নাতনি তার বাবার জন্য কেঁদে কেঁদে বলেন, বাবা অফিসে সবাই আছে তুমি নাই কেন। তুমি কোথায় গেছো। কখন আসবে। আমি তোমাকে চুমু দেব। তাড়াতাড়ি আসো বাবা।
এভাবে আর নেওয়া যায় না। সবসময় নাতনি আমার তার বাবার জন্য কাঁদে। চোখের জলে কী আর ঈদ আছে।
শহীদ তাহির জামান প্রিয় ঢাকায় একটি অনলাইন পোর্টালের সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সাইন্সল্যাব ও সেন্ট্রাল রোডের পাশেই পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন। সহকর্মীরা তাকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশের গুলির মুখে নিতে পারেননি। সেখানে দীর্ঘক্ষণ রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।
ঈদের শাড়ি নিয়ে এসেই মা বলে ডাকত, এবার কে ডাকবে: শহীদ মানিকের মা
ঈদের কয়েকদিন আগেই আমার জন্য শাড়ি নিয়ে আসতো। বাড়িতে ঢুকেই মা বলে ডাকতো। আমার বাবার ডাক আশেপাশের সবাই শুনতো। এবার মানিক আমার মা বলে ডাকল না, কেউ আর মা বলে এতো আদর করে ডাকবে না। চোখের পানি মুছতে মুছতে কথাগুলো বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ অটোচালক মানিকের মা নুরজাহান বেগম।
তিনি বলেন, রোজার কয়েকদিন আগে থেকেই বাবা (মানিক) পরিবারের জন্য রোজার সকল প্রস্তুতি নিতো। রোজায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে ইফতার করতো। সেহরির সময় সবার আগে উঠে সবাইকে ডেকে তুলতো। আশপাশের সবাইকে ডাকতো। ইফতার করলাম বাবাকে ছাড়া, সেহরিতে মানিক বাবা আর ডাকে না। মানিক সকালে উঠে ঈদের নামাজ আদায় করে বাবার কবর জিয়ারত করতো। তারপর বাসায় এসে সবার সঙ্গে খাবার খেত। পরে আত্মীয় স্বজনের খোঁজখবর নিতো। এবারে সেই খোঁজ নেওয়ার মতো আর কেউ নাই। সবার ঈদ থাকলেও আমাদের ঈদ আর নেই।
পরিবারের আনন্দ শেষ হয়ে গেছে: শহীদ সাজ্জাদের মা
ঈদ এলেই মা ও স্ত্রী সন্তানসহ আত্মীয় স্বজনের জন্য নতুন জামাকাপড় কিনে আনতেন সাজ্জাদ হোসেন। সন্তানের কাছে থেকে ঈদের জন্য নতুন শাড়ি পেয়ে খুবেই আনন্দ লাগতো। ভালো লাগতো। এবারে সন্তান নাই। ওইভাবে কেউ আর খোঁজ নেয়নি। নেবে কিনা জানা নাই।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথাগুলো বলেন, শহীদ সাজ্জাদ হোসেনের মা ময়না বেগম। সবজি বিক্রেতা সাজ্জাদ হোসেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কৈলাশ রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।
সাজ্জাদের মা বলেন, আগে ঈদ আসলে মনের মধ্যে একটা আনন্দ কাজ করতো। ছেলে আমাদের জন্য কেনাকাটা করতো। পরিবারে সবার মাঝে আনন্দ থাকতো। একমাত্র উপাজর্নকারী ছেলে আর নাই। ঈদে কীভাবে আনন্দ হবে। কীভাবে ভালো কিছু রান্না হবে। বাবা নাই। আমাদের ঈদও আর নাই। আমাদের পরিবারে আর কখনও ঈদের আনন্দ হবে না।
ইফতার নিয়ে প্রতিদিন কান্নায় চোখ ভাসায় মেরাজের দুই সন্তান
রোজায় আব্বুর সঙ্গে বাজারে গিয়ে ইফতার কিনে আনতাম। গত ঈদে আব্বু আমাকে প্যান্ট শার্ট স্যান্ডেল কিনে দিয়েছিল। ঈদের নামাজ আব্বুর সঙ্গে পড়তে গেছিলাম মাঠে বলেই হু হু করে কেঁদে উঠে শহীদ মেরাজুল ইসলামের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া বড় ছেলে মেহরাব হোসেন নাজিল।
ফল বিক্রেতা মেরাজুল ইসলাম মেরাজ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। মেরাজুল নগরীর জুম্মাপাড়ার শামসুল হক ও আম্বিয়া বেগমের সন্তান। তিন ভাই বোনের মধ্যে মেরাজুল দ্বিতীয়। তিনি সিটি বাজারে ফল বিক্রি করতেন। তার দুই সন্তান।
শহীদ মেরাজুলের স্ত্রী বলেন, রমজানে প্রতিদিন ইফতার হাতে নিয়ে বাবার কথা মনে করে অশ্রুতে চোখ ভাসিয়েছে পিতৃহারা দুই সন্তান। আমি তাদের কী বোঝাব। তাদের বাবা আর কোনদিন ইফতার এনে তাদের আর ডাকবে না। ঈদে নতুন জামা নিয়ে আসবে না। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে মার্কেটে যাবে না। ঈদের নামাজ আর পড়তে যাবে না। সবমিলিয়ে আমাদের পরিবারে ঈদের কোন আনন্দ নেই। আমি দুই সন্তান নিয়ে নানা সংশয় আর সংকটের মধ্যে দিন পার করছি।
ঈদ তো কল্পনাতেই নাই: শহীদ তাহিরের মা
চোখে মুখে হতাশার ছাপ। আব্দুল্লাহ আল তাহিরের কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পরেন। কষ্টের সংসারে ছেলেকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। ছেলে পড়ালেখা শেষ করে মানুষের মতো মানুষ হবে। আমাদের পরিবারের কষ্ট দূর করবে। সব স্বপ্নই চুরমার হয়ে গেছে পুলিশের এক গুলিতেই। কথাগুলো ছলছল চোখে বলেন, শহীদ আব্দুল্লাহ আল তাহিরের মা। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৯ জুলাই রংপুর নগরীর সিটি বাজারের সামনে পুলিশের গুলিতে মারা যান আব্দুল্লাহ আল তাহির।
তাহির ঢাকায় বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব গ্লাস এন্ড সিরামিকসের অষ্টম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন। আব্দুল্লাহ আল তাহিরের বাবা আব্দুর রহমান। চার ভাই বোনের মধ্যে বড় ছেলে ছিল তাহির।
তাহিরের মা বলেন, ঈদ তো কল্পনাতেই নেই। কীভাবে কেনাকাটা করব ছেলে ছাড়া। গতবছর ছেলেকে নিয়ে কেনাকাটা করেছি। ওর পছন্দ অনুযায়ী সব কিনে দিয়েছিলাম। ছেলে আমার অনেক খুশি হয়েছিল। এবারের ঈদে এমন কোনো পরিকল্পনাই নাই। ছেলে না থাকায় পরিবারের মধ্যে কোনো প্রাণ নাই।
ছেলের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ছেলে আমার সব কাজ করতে পারত। আমার বাড়ির কাজেও সহযোগিতা করত। গত ঈদে রংপুর স্টেশনে আতর বিক্রির টাকায় আমাকে জামার কাপড় কিনে নিজের হাতে সেলাই করে দিয়েছিল। এবার সে নাই। আমার যেন কেউ নাই।
এভাবেই প্রতিটি জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্যদের মাঝে বিষণ্নতা ছেয়ে গেছে। তাদের পরিবার থেকে হারিয়ে গেছে ঈদের আনন্দ উৎসব।
প্রতিনিধি/এমআর