নারায়ণগঞ্জে একে একে মুছে যাচ্ছে ওসমান পরিবারের নাম। গেল ৫ আগস্ট থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে পালিয়ে থাকা ওসমান পরিবারের সদস্যরা পড়েছেন অস্তিত্ব সংকটে। দোর্দাণ্ড প্রভাবশালী পরিবার গত ১৬ বছর কোনো না কোনোভাবে ছিলেন আলোচনায়। শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ মদদে এ পরিবার নারায়ণগঞ্জে হয়ে উঠেন আতঙ্কের। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে ওসমান পরিবারের পড়েছে মহাসংকটে। ওসমান পরিবারের অধিকাংশ স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। কয়েকদিন আগে ফতুল্লা খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে রিয়া গোপের নামের স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়। পর্যায়ক্রমে ওসমান পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বিভিন্ন স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে।
শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিম ওসমান সেতুর নাম মুছে দিয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা সেতুর টোল প্লাজার সামনে জড়ো হয়ে এ সেতুর নাম মুছে ফেলে তারা।
বিজ্ঞাপন
কলাগাছিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি শাহাদুল্লাহ মুকুল জানান, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ওসমান পরিবার ও তাদের সহযোগীদের হাতে বন্দরে অসংখ্য বিএনপি নেতাকর্মী নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মী এবং সাধারণ জনগণ ‘খুনি শেখ হাসিনার দোসর’ নাসিম ওসমান সেতুর নাম মুছে ফেলে।
এর আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শামীম ওসমান বিএনপি-জামায়াতের উদ্দেশে প্রায়ই একটি বক্তব্য রাখতেন। তা হলো ‘নারায়ণগঞ্জে খেলতে আইসেন না। জনগণের কাছে বিচার দিলে, জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে গেলে কারোর বাড়ির ইট কিন্তু থাকবে না।’ তিনি এই কথা বিরোধী দলের রাজনীতিবিদদের উদ্দেশশে বলে থাকলেও তবে তা যেন নিজের বেলায় ঘটেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুথানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে শামীম ওসমানের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। এর আগে জুলাই আন্দোলনে তিনি তার ছেলে, অনুসারীদের নিয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে শোডাউন দেন। যা নিয়ে মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
এরই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের পতনের ৬ মাস পর এবার শামীম ওসমানের দাদা বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সেই বাড়ির ইট খুলে নিয়ে যায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা। বর্তমানে বাড়িটির একটি অংশ বাদে কোনোটি অবশিষ্ট নেই। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে খান সাহেব ওসমান আলীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি ‘বায়তুল আমান’ ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
এর আগে নানা কারণে শামীম ওসমান সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে জিয়াউর রহমানের গাড়িবহর আটকে দিয়ে যেমন আলোচনায় আসেন। তেমনি খালেদা জিয়ার লংমার্চের গাড়িবহর আটকে দিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন। টানবাজার পতিতাপল্লী উচ্ছেদ করেও আসেন আলোচনায়। একইভাবে গোলাম আজমকে নারায়ণগঞ্জে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেও রাজনীতি মহলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে ‘খেলা হবে’ বলেও ‘না খেলে’ দু’বার দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।
বায়তুল আমান গুঁড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে স্থানীয়সূত্রে জানা যায়, গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৭টা থেকে এ শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাড়া এলাকার এই বাইতুল আমানকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বায়তুল আমান ভবনটি ১৯৩৯ সালে শামীম ওসমানের দাদা খান সাহেব ওসমান আলী প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে আওয়ামী লীগ দল গঠনের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অসংখ্য নেতা-কর্মী এসেছেন এবং বৈঠক করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এই ভবনটির কথা উল্লেখ করা আছে। শামীম ওসমানের বাবা একেএম শামসুজ্জোহা এই বাড়ি থেকেই তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন।
সূত্র বলছে, ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাড়া এলাকার এই বায়তুল আমান থেকে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১’র স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটা আন্দোলন সংগ্রামে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল এই বায়তুল আমান। ভবনের মালিক খান সাহেব ওসমান আলী থেকে শুরু করে তার ছেলে একেএম শামসুজ্জোহা, তার তিন ছেলে মরহুম একেএম নাসিম ওসমান, একেএম সেলিম ওসমান ও একেএম শামীম ওসমান বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই বাইতুল আমানে ভাঙচুর করা হয়েছিল। তবে ধসে দেওয়া হয়নি। এবার একেবারেই ধসে দেওয়া হচ্ছে। যদিও চাষাঢ়া এলাকার সড়ক প্রশস্তকরণে এই বাইতুল আমান ভাঙার ব্যাপারে আলোচনা চলমান ছিল।
প্রতিনিধি/এসএস