ইসলামে রমজান ও জুমা দুটোই মর্যাদাসম্পন্ন শব্দ। জুমা সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন আর রমজান ১২ মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। রমজান মাসে যেকোনো ইবাদতের ফজিলত বেশি। এদিকে শুক্রবারের আলাদা ফজিলত রয়েছে। তাই রমজান মাসের শুক্রবারগুলো অন্য যেকোনো দিনের চেয়ে বেশি ফজিলতপূর্ণ। দিনটি এমনভাবে কাটানো চাই, যাতে আল্লাহর বিশেষ রহমত ও বরকত লাভ হয়।
রমজানে জুমার দিন যেভাবে কাটাবেন
১. ফজরের নামাজে সুরা সিজদা ও ইনসান তেলাওয়াত
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (স.) শুক্রবার ফজরের নামাজে সুরা আস-সিজদা এবং সুরা আল-ইনসান তিলাওয়াত করতেন। (সহিহ বুখারি: ১০৬৮)
বিজ্ঞাপন
২. সারা দিন বেশি পরিমাণে দরুদ পড়া
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তোমরা জুমার দিন আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করো। কেননা তোমাদের পাঠকৃত দরুদ আমার সামনে পেশ করা হয়। (আবু দাউদ: ১০৪৭)
৩. মেসওয়াক করা
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, জুমার দিন প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির গোসল ও মেসওয়াক করা কর্তব্য এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সে সুগন্ধিও ব্যবহার করবে। (সহিহ মুসলিম: ১৮৪৫)
৪. গোসল করা
জুমার দিনে বিশেষভাবে গোসল করার তাগিদ এসেছে হাদিসে। সালিম (রহ.) থেকে তাঁর পিতার সূত্র থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (স.)-কে বলতে শুনেছেন, যে ব্যক্তি জুমার নামাজে আসে সে যেন গোসল করে আসে। (জামে তিরমিজি: ৪৯২)
৫. সম্ভব হলে সুগন্ধি ব্যবহার করা
অন্য দিনের চেয়ে এদিন বেশি সুগন্ধি ব্যবহার করা উত্তম। আবু সাইদ খুদরি (রা.) বলেন, আমি এ মর্মে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, জুমার দিন সুগন্ধি পাওয়া গেলে তা ব্যবহার করবে। (সহিহ বুখারি: ৮৮০)
বিজ্ঞাপন
৬. জিকির করা
ইমাম জুমার নামাজে আসার পূর্ব পর্যন্ত নামাজ, জিকির ও তেলাওয়াতে রত থাকা। জুমার দিনে যত সম্ভব জিকির করা বাঞ্ছনীয়। কোরআনে জিকির তথা আল্লাহর স্মরণের কথা এসেছে এভাবে- ‘হে বিশ্বাসীগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের জন্য আহবান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের জন্য দ্রুত ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি কর।’ (সুরা জুমা: ৯)
৭.পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর কাপড় পরিধান করা
আবু জার (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন উত্তমরূপে গোসল করে, উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করে, তার উৎকৃষ্ট পোশাক পরিধান করে এবং আল্লাহ তার পরিবারের জন্য যে সুগন্ধির ব্যবস্থা করেছেন, তা শরীরে লাগায়, এরপর জুমার সালাতে এসে অনর্থক আচরণ না করে এবং দুজনের মাঝে ফাঁক করে অগ্রসর না হয়, তার এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমার মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহ ক্ষমা করা হয়। (সুনানে ইবনে মাজা: ১০৯৭)
৮. মসজিদে সুগন্ধি লাগানো
ওমর (রা.) জুমার দিন দ্বিপ্রহরে মসজিদে সুগন্ধি লাগানোর জন্য আদেশ করেছেন। এছাড়াও যেকোনো সময় মসজিদে সুগন্ধি লাগানো উচিত। রাসুলুল্লাহ (স.) পাড়ায় পাড়ায় মাসজিদ নির্মাণ করতে, তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে এবং সুবাসিত করতে হুকুম দিয়েছেন। (ইবনু মাজাহ: ৭৫৯)
৯. ইস্তেগফার করা ও কথা না বলা
এদিন মহান রবের পক্ষে গুনাহ মাফের বারি বর্ষিত হয়। নবী (স.) বলেছেন, কোনো মুসলিম যদি পবিত্র হয়ে জামে মসজিদের দিকে হাঁটতে থাকে, এরপর ইমাম নামাজ শেষ করা পর্যন্ত নীরব থাকে, তাহলে এ নামাজ এই জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত তার গুনাহের কাফফারা (মোচনকারী) হয়ে যাবে, যদি ধ্বংসকারী তথা কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে। (মুসনাদে আহমদ: ২৩৭২৯)
১০. খুতবার সময় চুপ থাকা
খুতবার সময় সম্পূর্ণ নিশ্চুপ থাকা। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন ইমামের খুতবা দেওয়ার সময় তার সঙ্গীকে বলল, ‘চুপ থাকো’ সে একটি অনর্থক কাজ করল। (সুনানে নাসায়ি: ১৪০১)
১১. জুমার নামাজ আদায়
ইসলামের যেসব ফরজ বিধান আছে, এর মধ্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জুমার নামাজ। যারা জুমার নামাজকে অলসতা কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ছেড়ে দেয়, তাদের হৃদয়ে আল্লাহ তাআলা মোহর মেরে দেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যদি মানুষ জুমার সালাত পরিত্যাগ করা থেকে বিরত না থাকে তাহলে আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দেবেন, যার ফলে তারা অলস ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সুনানে দারামি: ১৫২৪)
১২. জুমার নামাজে সুরা আলা, সুরা জুমা ও গাশিয়াহ পড়া
নুমান ইবনে বশির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) দুই ঈদের নামাজে ও জুমার নামাজে ‘সাব্বিহিসমা রব্বিকাল আলা-’ ও ‘হাল আতা-কা হাদিসুল গা-শিয়াহ’ সুরাদ্বয় পাঠ করতেন। (সহিহ মুসলিম: ১৯১৩)
কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (স.) সুরা জুমা ও সুরা আলা তেলাওয়াত করতেন।
১৩. জুমার দিনে সুরা কাহাফ পড়া
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহাফ পাঠ করবে তার জন্য দুই জুমার মধ্যবর্তীকাল জ্যোতির্ময় হবে।’ (আত-তারগিব: ৭৩৫)
১৪. রমজানজুড়ে নবীজি যে ৪ কালাম বেশি পড়তেন
১. أشهد أن لا إله إلا الله ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ২. أستغفر الله ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ ৩. اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْئَلُكَ الْجَنَّةَ ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকাল জান্নাহ’ এবং ৪. اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ النَّارِ ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী আউজু বিকা মিনান নার’। বাক্যগুলো একত্রে মিলিয়ে ও পড়া যাবে এভাবে—أشهد أن لا إله إلا الله أستغفر الله اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْئَلُكَ الْجَنَّةَ وَ أَعُوذُ بِكَ مِنَ النَّارِ উচ্চারণ: ‘আশহাদু আললা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আসতাগফিরুল্লাহ, আসআলুকাল জান্নাতা ওয়া আউজুবিকা মিনান নার।’ অর্থ: ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কেউ নেই। আমি আল্লাহর কাছে মাফ চাই। আমি আল্লাহর কাছে জান্নাত চাই এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাই।’ (দ্র: সহিহ ইবনে খুজাইমা: ১৮৮৭)
১৫. আছরের সময়টি দোয়ায় অতিবাহিত করা
জুমার দিন বিশেষ সময়ে দোয়া কবুল হয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেন, জুমার দিনের মধ্যে অবশ্যই এমন একটি মুহূর্ত আছে, যখন কোনো মুসলিম আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করে নিশ্চয়ই তিনি তাকে তা দান করেন। তিনি বলেন, সে মুহূর্তটি অতি স্বল্প। (সহিহ মুসলিম: ১৮৫৮)
বেশির ভাগের মতে, সে সময়টি আছরের পর থেকে নিয়ে মাগরিবের আগ মুহূর্ত। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেন, ‘জুমার দিনের বারো ঘণ্টার মধ্যে এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে যদি কোনো মুসলিম এ সময়ে আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে, তাহলে মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাকে দান করেন। এ মুহূর্তটি তোমরা আসরের শেষ সময়ে অনুসন্ধান করো।’ (আবু দাউদ: ১০৪৮)
১৬. কবর আজাব থেকে মুক্তির দোয়া করা
হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনানুযায়ী, জুমার দিন কবরের আজাব মাফ হয়ে যায়। এক হাদিসে আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে মুসলমান জুমার দিনে কিংবা জুমার রাতে মৃত্যুবরণ করবে, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তাকে কবরের ফেতনা থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন। (তিরমিজি: ১০৯৫; মেশকাত: ১৩৬৭; মুসনাদে আহমদ: ১১/১৪৭)
তাই জুমার দিন কবর আজাব থেকে মুক্তির প্রার্থনা করা জুমার দিনের বিশেষ আদব। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে পবিত্র রমজানের জুমার দিনগুলোতে উল্লেখিত আমলগুলো করার তাওফিক দান করুন। আমিন।