ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা মুসলমানদের কাছে তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। যার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং সম্মান রক্ষা করা মুসলমানদের ঈমানি দায়িত্ব মুসা (আ.)-এর জবানে মসজিদুল আকসা ও তার আশপাশের অঞ্চলকে পবিত্র ভূমি উল্লেখ করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন তাতে তোমরা প্রবেশ করো এবং পশ্চাদপসরণ করো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সুরা মায়েদা: ২১)
আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘যে সম্প্রদায়কে দুর্বল গণ্য করা হতো তাদেরকে আমি আমার কল্যাণপ্রাপ্ত রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমের উত্তরাধিকারী করি।’ (সুরা আরাফ: ১৩৭)
বিজ্ঞাপন
ফিলিস্তিন এতই মোবারক ভূমি যে, আল্লাহ তাআলা একে ইসরা ও মেরাজের ভূমি বানিয়েছেন। ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাস থেকেই নবীজির মেরাজ শুরু হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তার বান্দাকে রাত্রে ভ্রমণ করিয়েছিলেন আল-মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ১)
এই অঞ্চলকে বলা হয় মুক্তিকামীদের ভূমি। আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে মুক্তিকামী মানুষকে ফিলিস্তিন ভূমিতে আশ্রয় দিয়েছেন। যেমন—লুত (আ.) সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এবং আমি তাকে ও লুতকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম সেই দেশে, যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি বিশ্ববাসীর জন্য।’ (সুরা আম্বিয়া: ৭১) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং সুলাইমানের বশীভূত করে দিয়েছিলাম উদ্দাম বায়ুকে; তা তার আদেশক্রমে প্রবাহিত হতো সেই দেশের দিকে, যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি; প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে আমিই সম্যক অবগত।’ (সুরা আম্বিয়া: ৮১)
আরও পড়ুন: ফিলিস্তিন কি নবীজির ভবিষ্যদ্বাণীর দিকেই এগোচ্ছে?
প্রাচীন শামের সঙ্গে আরবরা যে পথগুলো ব্যবহার করত তার মধ্যভাগে ছিল ফিলিস্তিন ভূমি, যাকে আল্লাহ ভ্রমণকারীদের জন্য নিরাপদ করেছিলেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের ও যেসব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম সেগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে দৃশ্যমান বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম এবং সেসব জনপদে ভ্রমণের যথাযথ ব্যবস্থা করেছিলাম এবং তাদেরকে বলেছিলাম, তোমরা এসব জনপদে নিরাপদে ভ্রমণ কোরো দিনে ও রাতে।’ (সুরা সাবা: ১৮)
বিজ্ঞাপন
সত্যের পক্ষে বিজয়ীদের ভূমি হবে ফিলিস্তিন। বায়তুল মুকাদ্দাস তথা ফিলিস্তিনকে মহানবী (স.) বিজয়ীদের ভূমি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ ইহুদিদের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ একদিন শেষ হবে। মুসলমানদের একটি দল তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে এবং বিজয়ী হবে। হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, আমার উম্মতের একটি দল সত্যের ওপর বিজয়ী থাকবে। শত্রুর মনে পরাক্রমশালী থাকবে। দুর্ভিক্ষ ছাড়া কোনো বিরোধীপক্ষ তাদের কিছুই করতে পারবে না। আল্লাহর আদেশ তথা কেয়ামত পর্যন্ত তারা এমনই থাকবে। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! তারা কোথায় থাকবে? রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, তারা বায়তুল মুকাদ্দাস এবং তার আশপাশে থাকবে।’ (মুসনাদে আহমদ: ২১২৮৬)
তার মানে, কেয়ামতের আগে ফিলিস্তিন ভূমি থেকে অবশ্যই অবৈধ দখলদারির অবসান এবং মুসলমানদের বিজয় আসবে। আরেক হাদিসে আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘কেয়ামত সংগঠিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানগণ ইহুদি সম্প্রদায়ের সাথে লড়াই না করবে। মুসলমানগণ তাদেরকে হত্যা করবে। ফলে তারা পাথর বা বৃক্ষের আড়ালে আত্মগোপন করবে। তখন পাথর বা গাছ বলবে- হে মুসলিম, হে আল্লাহর বান্দা! এই তো ইহুদি আমার পশ্চাতে। এসো, তাকে হত্যা কর। কিন্তু ’গারকাদ’ গাছ এ কথা বলবে না। কারণ এ হচ্ছে ইহুদিদের গাছ। (সহিহ মুসলিম: ৭০৭৫)
আরও পড়ুন: গাজা ইস্যুতে বিশ্ববাসীর লজ্জাজনক ভূমিকায় হতবাক হবে পরের প্রজন্ম
হজরত মুয়াজ ইবনু জাবাল (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘বায়তুল মাকদিসে বসতি স্থাপন ইয়াসরিবের বিপর্যয়ের কারণ হবে। আর ইয়াসরিবের বিপর্যয় সংঘাতের কারণ হবে। যুদ্ধের ফলে কুসতুনতিনিয়া বিজয় হবে এবং কুসতুনতিনিয়ার বিজয় দাজ্জালের আবির্ভাবের আলামত।’ (সুনানে আবি দাউদ: ৪২৯৪)
হাদিসে দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ বায়তুল মুকাদ্দাসের বিজয় হবে কেয়ামতের আগে। তাই হাদিসে এই বিজয়কে কেয়ামতের একটি আলামত বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে আরেক হাদিসে আউফ বিন মালিক (রা.) বলেন, আমি তাবুক যুদ্ধে আল্লাহর রাসুল (স.)-এর কাছে গেলাম। তিনি তখন একটি চামড়ার তৈরি তাঁবুতে ছিলেন। আল্লাহর রাসুল (স.) বললেন, কেয়ামতের আগের ছয়টি নিদর্শন গণনা করে রাখো—১. আমার মৃত্যু, ২. বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়, ৩. তোমাদের মধ্যে ঘটবে মহামারি, বকরির পালের মতো মহামারি, ৪. সম্পদের প্রাচুর্য, এমনকি এক ব্যক্তিকে ১০০ দিনার দেওয়ার পরও সে অসন্তুষ্ট থাকবে, ৫. এমন এক ফিতনা আসবে, যা আরবের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করবে, ৬. যুদ্ধবিরতির চুক্তি, যা তোমাদের ও বনি আসফার বা রোমকদের মধ্যে সম্পাদিত হবে। অতঃপর তারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং ৮০টি পতাকা উড়িয়ে তোমাদের বিপক্ষে আসবে; প্রত্যেক পতাকার নিচে থাকবে ১২ হাজার সৈন্য। (সহিহ বুখারি: ৩১৭৬)
প্রিয়নবীজি শাম দেশের জন্য দোয়া করেছেন। শাম হলো বর্তমান সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লেবানন ও জর্ডান অঞ্চল। এসব অঞ্চলের জন্য নবীজির দোয়া প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন নবী স. (দোয়ায়) বললেন- اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي شَامِنَا اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي يَمَنِنَا উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী শা-মিনা, আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী ইয়ামিনা।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! শাম দেশে আমাদের জন্য বরকত দান করুন। হে আল্লাহ! ইয়ামান দেশে আমাদের জন্য বরকত দান করুন।’
আরও পড়ুন: শেষ যুগে যেভাবে চলতে বলেছেন নবীজি
তখন সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের নাজদের জন্যও (দোয়া করুন)। তিনি (স.) আবারও বললেন- اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي شَامِنَا اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي يَمَنِنَا উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী শা-মিনা, আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী ইয়ামিনা।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! শাম দেশে আমাদের জন্য বরকত দান করুন। হে আল্লাহ! ইয়ামান দেশে আমাদের জন্য বরকত দান করুন।’
এবারও সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের নাজদের জন্যও (দোয়া করুন)। বর্ণনাকারী ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আমার ধারণা, তিনি (স.) তৃতীয়বারে বললেন, সেখান থেকে শয়তানের শিং উদিত হবে। (মেশকাত: ৬২৭১; বুখারি: ১০৩৭, তিরমিজি: ৩৯৫৩, সিলসিলাতুস সহিহাহ: ২২৪৬, সহিহ তারগিব ওয়াত তারহিব: ৩০৮৬)
আল্লাহ তাআলা মসজিদুল আকসাকে দাজ্জালের হাত থেকে রক্ষা করবেন। হাদিসে এসেছে, ‘দাজ্জাল পৃথিবীতে ৪০ দিন অবস্থান করবে। তার রাজত্ব সর্বত্র বিস্তার লাভ করবে। তবে চার মসজিদ তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকবে। তা হলো কাবা, মসজিদে রাসুল, মসজিদুল আকসা ও মসজিদে তুর।’ (মুসনাদে আহমদ: ২৩১৩৯)
হাদিসের বর্ণনা ও ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যা অনুসারে ঈসা (আ.) দাজ্জাল ও তার অনুসারী ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। তাদের যুদ্ধ হবে ফিলিস্তিন ভূমিতে। ঈসা (আ.) ফিলিস্তিনের লুদ শহরে দাজ্জালকে হত্যা করবেন। অতঃপর যুদ্ধে ইহুদিদের পরাজিত করবেন। তারা পালিয়েও আত্মরক্ষা করতে পারবে না। (সহিহ মুসলিম: ২৯২২; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১/১২৮)
ওপরের উদ্ধৃতি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় কিয়ামতের আগে ফিলিস্তিন ভূমি থেকেই মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়া হবে। আল্লাহ মুসলিম জাতিকে মসজিদুল আকসার সম্মান রক্ষা করার তাওফিক দান করুন। বিজয়ী দলের সদস্য হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।