শনিবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

সুখী ও সফল হওয়ার চাবিকাঠি

নবীজির ৫টি মহামূল্যবান কথা জানেন না অনেকে

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬ মার্চ ২০২৪, ০৩:৫৪ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

রাসুলুল্লাহ (স.)-এর পাঁচটি কথাকে সুখী ও সফল জীবনের চাবিকাঠি বলা হয়। উম্মতের কাছে সেই মহামূল্যবান বাণীগুলো পৌঁছে দিতে নবীজি দায়িত্ব দিয়েছিলেন হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-কে। তিনি যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছেন। বিষয়গুলো মুসলিম উম্মাহকে জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের অনেকেই সেই কথাগুলো এখনও জানি না। চলুন দেখে নেওয়া যাক- নবীজির সেই মহামূল্যবান কথাগুলো কী।

হাদিস শরিফে এসেছে, একদিন রাসুলুল্লাহ (স.) সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করলেন, পাঁচটি কথা আমার কাছ থেকে কে নেবে এবং মুখস্থ করবে তারপর অন্যের কাছে পৌঁছে দিবে? আবু হুরায়রা (রা.) বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি নেব, মুখস্থ করব এবং অন্যের কাছে পৌঁছে দেব।


বিজ্ঞাপন


তখন নবীজি (স.) বললেন- اتَّقِ الْمَحَارِمَ تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ ، وَارْضَ بِمَا قَسَمَ اللهُ لَكَ تَكُنْ أَغْنَى النَّاسِ ، وَأَحْسِنْ إِلَى جَارِكَ تَكُنْ مُؤْمِنًا ، وَأَحِبَّ لِلنَّاسِ مَا تُحِبُّ لِنَفْسِكَ تَكُنْ مُسْلِمًا ، وَلاَ تُكْثِرِ الضَّحِكَ ، فَإِنَّ كَثْرَةَ الضَّحِكِ تُمِيتُ الْقَلْبَ

‘গুনাহসমূহ থেকে বাঁচবে, তাহলে সর্বাপেক্ষা ইবাদতকারী লোক গণ্য হবে। তোমার তাকদিরে আল্লাহ যা বণ্টন করে রেখেছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকবে, তাহলে সর্বাপেক্ষা অমুখাপেক্ষী লোক হতে পারবে। প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যহার করবে, তাহলে প্রকৃত মুমিন হতে পারবে। নিজের জন্য যা পছন্দ করো মানুষের জন্যও তা পছন্দ করবে, তাহলে প্রকৃত মুসলিম হতে পারবে। বেশি হাসবে না, কেননা বেশি হাস্য-কৌতুক হৃদয়কে মুর্দা বানিয়ে দেয়।’ (তিরমিজি: ২৩০৫)

আরও পড়ুন: মিথ্যা ছেড়ে দেওয়ার ইসলামিক উপায়

হাদিসের প্রথমাংশে বলা হয়েছে- اتَّقِ الْمَحَارِمَ تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ এই কথাটির ব্যাখ্যা হলো- ‘জগতের যত ইবাদতগুজার আছে সকলের চাইতে তুমি আগে চলে যেতে পারবে, সকলেই তোমার থেকে পিছিয়ে যাবে যদি তুমি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো।’ এখানে কিন্তু আল্লাহর ওলি হওয়ার গোপন রহস্য বলে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর ওলিরা তো সর্বোত্তম মুসলিম। আর এখানে বলে দেওয়া হচ্ছে- গুনাহ পরিত্যাগ করলেই তা হওয়া যাবে। এ কারণেই হাসান বসরি (রহ) বলতেন- مَا عَبَدَ الْعَابِدُونَ بِشَيْءٍ أَفْضَلَ مِنْ تَرْكِ مَا نَهَاهُمُ اللَّهُ عَنْه ‘আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকার চাইতে উত্তম কোনো ইবাদত কোনো ইবাদতকারী করতে পারেনি।’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম: ২৯৬)


বিজ্ঞাপন


হাদিসের দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে- وَارْضَ بِمَا قَسَمَ اللهُ لَكَ تَكُنْ أَغْنَى النَّاسِ এর ব্যাখ্যা হলো- আল্লাহ তাআলা যা বণ্টন করে রেখেছেন সে বিষয়ে সন্তুষ্ট থাকবে, তাহলে সর্বাপেক্ষা সুখী হতে পারবে। দেখবেন অনেকে ধনী হওয়া সত্ত্বেও অসুখী, কারণ আল্লাহর দেওয়া বণ্টনের উপর সে সন্তুষ্ট নয় বরং তার অবস্থা হলো এই যে, আরো চাই, আরো চাই এবং আরো চাই। আসলে আল্লাহর নির্ধারিত রিজিকে সন্তুষ্ট থাকা সুখী হওয়ার মূলমন্ত্র। এখানেই মানসিক প্রশান্তি। কেননা ‘আল্লাহ তোমাদের কষ্ট দিলে তিনি ছাড়া অন্য কেউ তা মোচন করতে পারে না। আর আল্লাহ যদি তোমার মঙ্গল চান, তাহলে তাঁর অনুগ্রহ পরিবর্তন করারও কেউ নেই।’ (সুরা ইউনুস: ১০৭) কোরআনের এই বাণীর ওপর ঈমান রেখে আল্লাহর বণ্টন করা বিষয়ে সন্তুষ্ট ও কৃতজ্ঞ থাকলে হতাশার কিছুই থাকে না।

হাদিসের তৃতীয় অংশে বলা হয়েছে- وَأَحْسِنْ إِلَى جَارِكَ تَكُنْ مُؤْمِنًا এই অংশের ব্যাখ্যা হলো- তুমি তোমার প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো তাহলে প্রকৃত মুমিন হতে পারবে। আসলে প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার নিয়ে কোরআন-হাদিসে অনেক কথা রয়েছে। ইসলামে এর গুরুত্ব অনেক। কোরআন-হাদিসের বর্ণনাগুলো শুনলে যেকারো বুঝতে বাকী থাকবে না যে, প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ প্রকৃত মুমিনেরই বৈশিষ্ট্য। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- مَا زَالَ يُوصِينِي جِبْرِيلُ بِالْجَارِ، حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ ‘জিব্রাইল আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে এত বেশি ওসিয়ত করছিল, আমি ধারণা করছিলাম যে, প্রতিবেশীকে ওয়ারিশ বানিয়ে দেবে।’ (বুখারি, আসসাহিহ: ৬০১৪; মুসলিম, আসসাহিহ: ২৬২৫)

আরও পড়ুন: সম্পর্ক সুন্দর করার ইসলামিক উপায়

হাদিসের চতুর্থ অংশে নবীজি (স.) বলছেন- وَأَحِبَّ لِلنَّاسِ مَا تُحِبُّ لِنَفْسِكَ تَكُنْ مُسْلِمًا এর ব্যাখ্যা হলো- তুমি নিজের জন্য যা পছন্দ করো অপর মুসলমানের জন্য তাই পছন্দ করো তাহলে মুসলিম হতে পারবে। যেমন তুমি চাও কেউ তোমাকে গালি না দিক। সুতরাং তুমিও কাউকে গালি দিও না। তুমি চাও কেউ তোমার গিবত না করুক সুতরাং তুমিও গিবত করো না। তুমি চাও সর্বোত্তমটা যেন তুমি পাও, তাহলে তুমিও অন্যের জন্য সর্বোত্তমটা পছন্দ করো। এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি হলো- সারাবিশ্বের মুসলিম তো এক ভাই এক দেহের মতো। যদি তুমি সেই বিষয়ে একমত হও, তাহলে অবশ্যই অপর ভাইয়ের জন্য কল্যাণকামী ও ভালোকিছুই আশা করবে। আর এটি প্র্যাকটিস করার মাধ্যমে তুমি হয়ে যাবে সর্বোত্তম মুসলিম। আর আমরা জানি, এটি সাহাবিদেরই বৈশিষ্ট্য। আনসার সাহাবিরা তো এ বিষয়ে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ।

আরও পড়ুন: ঈমান হারানো মহামারি আকার ধারণ করবে

হাদিসের শেষ অংশে নবীজি (স.) বলছেন- وَلاَ تُكْثِرِ الضَّحِكَ ، فَإِنَّ كَثْرَةَ الضَّحِكِ تُمِيتُ الْقَلْبَ এই অংশের ব্যাখ্যা হলো- বেশি আনন্দ-বিনোদন করো না। কারণ অতিরিক্ত বিনোদন মানুষের অন্তরকে মেরে ফেলে। অর্থাৎ তুমি যদি চাও তোমার অন্তর সজিব প্রাণবন্ত থাকুক, তাহলে বেশি হেসো না, আনন্দ-ফুর্তির উৎসগুলোকে যত পারো দমিয়ে রাখো। এখানে হাসতে নিষেধ করা হয়নি, বরং বেশি হাসতে নিষেধ করা হয়েছে। আমরা জানি, ভাইয়ের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা সুন্নত। কখনও মুচকি হাসাটাও সদকায়ে পরিণত হয়। তাই পরিমিত হাসিই উত্তম। কিন্তু আখেরাতের কথা বেমালুম ভুলে অতিরিক্ত হাসা নিন্দনীয়। আল্লাহ বলেছেন, ‘অতএব তারা সামান্য হেসে নিক এবং তারা তাদের কৃতকর্মের বদলাতে অনেক বেশি কাঁদবে।’ (সুরা তওবা: ৮২)

আল্লাহর অনুমতিক্রমে জিবরাইল (আ.) রাসুল (সা.)-কে অনেক গোপন রহস্যের সংবাদ দিয়েছেন। তাকে দুনিয়ার জীবনে জান্নাত-জাহান্নাম দেখানো হয়েছে। তার জন্যই জান্নাতের সৃষ্টি। তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব। তার আগে-পরের সব গুনাহ মাফ করা হয়েছে। তবুও তিনি কম হাসতেন, কাঁদতেন বেশি। মানুষকেও কম হাসতে ও বেশি করে কাঁদতে উপদেশ দিতেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে তবে তোমরা খুব কমই হাসতে এবং খুব বেশি কাঁদতে।’ (বুখারি: ৬৪৮৫; তিরমিজি: ২৩১৩)

আরও পড়ুন: কোরআন-সুন্নাহর পথে অবিচল থাকার উপায়

তাই কম হাসতে হবে। কান্না অন্তরকে নরম করে। হৃদয়ে প্রশান্তি আনে। দুঃখকে হালকা করে। মানুষের মন রোদনকারীর প্রতি খুব সহজে আকর্ষিত হয়। আর কান্নার প্রতিদান অনেক বড়। রাসুল (স.) বলেন, ‘আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারী ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। যে রূপ দোহনকৃত দুধ আবার স্তনে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।’ (তিরমিজি : ২৩১১)

দেখুন, এই মহামূল্যবান বিষয়গুলো কি আমরা আগে জানতাম? কেউ কেউ জানলেও অনেকেই জানতাম না। আজ আল্লাহর ইচ্ছায় জানতে পারলাম। সেজন্য আল্লাহর শুকরিয়া। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নবীজির মহামূল্যবান বাণীকে কদর করার তাওফিক দান করুন। সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন