কোরআন-সুন্নাহর পথে অটল-অবিচল থাকা ইসলামে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসতিকামাত বা অবিচল থাকার অর্থ হচ্ছে, দৃঢ়তার সঙ্গে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের আনুগত্য এবং ইসলামি বিধানগুলো মেনে চলা ও মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকা। এটি জান্নাতি মানুষের নিদর্শন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। অতঃপর এ কথার উপর অবিচল থাকে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না। তারা হবে জান্নাতের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে এবং এটা হবে তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান।’ (সুরা আহকাফ: ১৩-১৪)
কিন্তু দ্বীনের ওপর অটল থাকা অতটা সহজ নয়। এজন্য খুব সতর্ক থাকতে হয় একজন মুমিনকে। বর্তমান যুগের হাজারো বাতিল থেকে নিজেকে হেফাজত করা, সত্যকে আঁকড়ে ধরা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এমন এক সময় অতিবাহিত করছি, যখন উম্মতের মধ্যে দ্বন্দ্ব আর দ্বন্দ্ব। কেউ এদিকে টানছে, কেউ ওদিকে। কী করবে উম্মত? কেমনে খুঁজে পাবে সত্য? নাজাতের পথ কোনটি? নবীজি (স.) বলেন, ‘(নাজাতের পথ সেটি) যে পথে আমি ও আমার সাহাবিরা আছি। (জামে তিরমিজি: ২৬৪৮) তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘সকল নব উদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থাকবে। কারণ, সকল নব উদ্ভাবিত বিষয় বিদআত। আর সকল বিদআত গোমরাহি ও ভ্রষ্টতা।’ (মুসনাদে আহমদ: ১৭১৪২, ১৭১৪৫)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: ইসলাম পরিপূর্ণ দ্বীন, বিদআত পরিত্যাজ্য
সাহাবায়ে কেরামের পক্ষ থেকে ‘ইসতিকামাত’ বা অবিচল থাকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যেমন—আবু বকর (রা.) বলেন, অবিচলতার অর্থ হলো, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক (অংশীদার) না করা। ওমর (রা.) বলেন, অবিচলতার অর্থ হলো, যেকোনো বিষয়ে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন করা এবং শিয়ালের মতো এদিক-সেদিক না যাওয়া। ওসমান (রা.) বলেন, আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠভাবে আমল করা। আলী (রা.) বলেন, অবিচলতার মানে হলো, ফরজগুলো গুরুত্বসহ আদায় করা। (মাদারিজুস সালিকিন: ২/১০৪)
সত্যের পথ আঁকড়ে ধরে জীবন অতিবাহিত করতে দ্বীনি জ্ঞান অর্জন, তাকওয়া, ধৈর্য, সত্য খুঁজে নেওয়া ও মেনে নেওয়ার ক্ষমতা এবং আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করার বিকল্প নেই। তা না হলে অজান্তেই মানুষ স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবে এবং অনুমাননির্ভর হয়ে পড়বে। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার হুঁশিয়ারি—‘তাদের বেশির ভাগ অনুমানেরই অনুসরণ করে। সত্যের পরিবর্তে অনুমান কোনো কাজে আসে না। তারা যা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা ইউনুস: ৩৬)
বিজ্ঞাপন
এখানে কোরআন সুন্নাহয় বর্ণিত সত্যের পরিচয়লাভ ও সত্যপথে টিকে থাকার অন্যতম উপায়গুলো তুলে ধরা হলো।
১) নিজের ভুলের ব্যাপারে সতর্ক থাকা
নিজের ভুলের ব্যাপারে সচেতন না হলে মানুষ অনেক সময় সত্যের দিশা থেকে বঞ্চিত হয়। মুমিন দোয়া করবে যেন আল্লাহ তাদেরকে সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত না করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! সরল পথ প্রদর্শনের পর আপনি আমাদের অন্তরকে সত্য লঙ্ঘনপ্রবণ করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে করুণা দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি মহাদাতা।’ (সুরা আলে ইমরান: ৮)
২) জ্ঞানীদের সান্নিধ্য
জ্ঞানীদের সান্নিধ্য মানুষকে সত্যের পথ দেখায়। সত্যের পথে টিকে থাকতে সাহায্য করে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যদি না জানো, তবে জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা করো।’ (সুরা নাহল: ৪৩)
আরও পড়ুন: যুগে যুগে শিরকের সূত্রপাত যেভাবে
৩) সবসময় দ্বীনের পথে থাকার বাসনা ও অনুশীলন
আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও মুমিনদের পথই সত্য পথ। সত্যে অবিচল থাকতে চাইলে তাদেরই অনুসরণ করতে হবে। এছাড়াও সবসময় এই বাসনা থাকতে হবে যে কোরআন সুন্নাহর বাইরে কোনো যুক্তি বা বিবেকের আশ্রয় নেব না। তা না হলে পথভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে। আল্লাহ বলেন, ‘কারো কাছে সুপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দিব এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করব। আর তা কত মন্দ আবাস।’ (সুরা নিসা: ১১৫)
৪) প্রতিপক্ষকে অবজ্ঞা না করা
ইসলামে প্রতিপক্ষকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। কেননা এতে নিজের মধ্যে অজ্ঞতা থাকলে তা স্পষ্ট হয় না। যেমনটি ইহুদি-খ্রিস্টানদের অভ্যাস। ইরশাদ হয়েছে, ‘ইহুদিরা বলে, খ্রিস্টানদের কোনো ভিত্তি নেই। খ্রিস্টানরা বলে, ইহুদিদের কোনো ভিত্তি নেই। অথচ তারা কিতাব পাঠ করে। এভাবে যারা কিছুই জানে না তারাও অনুরূপ কথা বলে। সুতরাং যে বিষয়ে তারা মতভেদ করত কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার মীমাংসা করবেন।’ (সুরা বাকারা: ১১৩)
আরও পড়ুন: ইসলামে জ্ঞানী লোক চেনার উপায়
৫) সত্য গ্রহণে প্রস্তুত থাকা
পূর্ব ধারণা, সমাজে প্রতিষ্ঠিত চিন্তাধারা ও সংস্কারের কারণে মানুষ গোমরাহির মধ্যে ডুবে থাকে। ফলে সে সত্য থেকে বঞ্চিত হয়। তাই সত্য গ্রহণে প্রস্তুত থাকতে হবে। কোরআন-সুন্নাহর কাছে নিজেকে সপে দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর অবশ্যই আমি মানুষের জন্য এই কোরআনে বিভিন্ন উপমা বিশদভাবে বর্ণনা করেছি, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ অস্বীকার করা ছাড়া ক্ষান্ত হলো না।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৮৯)
৬) স্রোতে গা ভাসানো যাবে না
স্রোতে গা ভাসানোর কারণে অনেক সময় মানুষ সত্য থেকে বঞ্চিত হয়। জীবনটা শেষ হয়ে যায় সুন্নাহর বিপরীত কাজে। এজন্য অধিকাংশ লোক কী বলছে তার ওপর ভিত্তি করে বসে থাকা যাবে না। বরং কোরআন-সুন্নাহ কী বলছে তা তালাশ করতে হবে। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘যদি তুমি বেশির ভাগ মানুষের কথামত চলো, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা তো শুধু অনুমানের অনুসরণ করে; আর তারা শুধু অনুমানভিত্তিক কথা বলে।’ (সুরা আনআম: ১১৬)
৭) বাহ্যিক অবস্থা বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না
বাহ্যিক অবস্থার বিচার করলে অনেক সময় অভ্যন্তরীণ সত্য থেকে বঞ্চিত হতে হয়। কেননা বাহ্যিক অবস্থা ও অভ্যন্তরীণ অবস্থা ভিন্ন হতে পারে। ইরশাদ হয়েছে, ‘গ্রাম্য লোকেরা বলে, আমরা ঈমান আনলাম। বলো, তোমরা ঈমান আননি, বরং তোমরা বলো, আমরা আত্মসমর্পণ করেছি। কেননা ঈমান এখনো তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি।’ (সুরা হুজরাত: ১৪)
আরও পড়ুন: ঈমান হারানো মহামারি আকার ধারণ করবে
৮) দলিল অনুসন্ধান করা
সত্য-মিথ্যা নিয়ে শংসয় দেখা দিলে দলিল অনুসন্ধান সবচেয়ে জরুরি বিষয়। এক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিবিশেষের বক্তব্য অথবা অনুমানের অনুসরণ করা যাবে না। আল্লাহ বলেন, ‘বলো, তোমাদের প্রমাণ উপস্থিত করো যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ (সুরা বাকারা: ১১১)
৯) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা
সুপথ লাভ ও সুপথে টিকে থাকতে ব্যক্তির মেধা, প্রচেষ্টা ও বাহ্যিক উপকরণ যথেষ্ট নয়। এগুলো থেকে বেশি প্রয়োজন আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ। তাই মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি যাকে ভালোবাস, ইচ্ছা করলেই তাঁকে সৎপথে আনতে পারবে না। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনেন এবং তিনিই ভালো জানেন সৎপথ অনুসারীদের।’ (সুরা কাসাস: ৫৬) তাই আল্লাহর সাহায্যলাভের দোয়া করতে হবে। সবসময় শয়তান ও নফসের কুমন্ত্রণা থেকে বাঁচার দোয়া করাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
১০) বড় ব্যক্তিরও ভুল হতে পারে—এ কথার ওপর বিশ্বাস রাখা
বড় ব্যক্তিরও ভুল হতে পারে—এ কথা বিশ্বাসে রাখলে বাতিল থেকে বেঁচে যাওয়া সহজ হয়। এমনকি মানুষের বক্তব্যের একাংশ সঠিক, অন্যাংশ ভুল হতে পারে—সেই বিশ্বাসও রাখতে হবে। এই সচেতনতা হক-বাতিল চিনতে সাহায্য করবে। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে এক ব্যক্তি এসে স্বপ্নের কথা জানালে আবু বকর (রা.)-এর ব্যাখ্যা করলেন। নবী (স.) বললেন, ‘তুমি স্বপ্নের ব্যাখ্যায় কিছুটা ঠিক বলেছ এবং কিছুটা ভুল করেছ।’ (সুনানে আবি দাউদ: ৩২৬৮)। অতএব, ওস্তাদও যদি এমন কিছু বলেন যে ভুল-ভ্রান্তি দুটোরই অবকাশ রয়ে যায়, অর্থাৎ সুন্নাহয় এ কথার সমর্থনে বক্তব্য পাওয়া যায় না, তাহলে ওই কথা পুরোপুরি আমলে নেওয়া যাবে না।
১১) দ্বীনের ওপর অবিচল থাকার দোয়া
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) এই দোয়াটি করতেন— يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ ‘ইয়া মুকাল্লিবাল কুলূব, সাব্বিত ক্বালবী আলা দীনিকা’ অর্থ: ‘হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী, আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন।’ (তিরমিজি: ২১৪০)
দ্বীনের ওপর অবিচল থাকার আরেকটি দোয়া নবীজি (স.) আলী (রা.)-কে শিখিয়েছেন। এ সম্পর্কে আলী (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) আমাকে বলেন, তুমি বলো— اللَّهُمَّ اهْدِنِىْ وَسَدِّدْنِىْ ‘আল্লাহুম্মাহদিনী ওয়া সাদ্দিদনী’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে সুপথ প্রদর্শন করুন এবং সরল পথে পরিচালিত করুন।’ আর (হে আলী) তুমি সুপথের সংকল্প করো এবং সঠিক পথে স্থির থাকো, যেভাবে তীর তার লক্ষ্যে স্থির থাকে। (মুসলিম: ২৭২৫; মেশকাত: ২৪৮৫)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক পথের দিশা দিন। সত্যপথে অটল-অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।