শনিবার, ২৯ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

দান-সদকা করবেন যাদের

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৬:০৯ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

দান-সদকা, সাহায্য-সহযোগিতা ইসলামের সৌন্দর্য। দান-সদকার মাধ্যমে সমাজে গরিব-ধনী তথা উঁচু-নিচুর ভেতরে সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হয়। কোরআন হাদিসে এর অসংখ্য ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। অন্যের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা নিজের সম্পদ দিনে বা রাতে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে আল্লাহর পথে খরচ করে তাদের পুরস্কার তাদের প্রতিপালকের কাছে আছে। তাদের কোনো ভয় নেই। তাদের কোনো চিন্তাও নেই।’ (সুরা বাকারা: ২৭৪)

রাসুলুল্লাহ (স.) বিভিন্নভাবে দান-সদকার প্রতি উৎসাহিত করেছেন, এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, খেজুরের একটি অংশ দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো। (বুখারি: ৬০২৩)


বিজ্ঞাপন


আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা! আমি তোমাদের যে রিজিক দান করেছি, তা থেকে তোমরা (আল্লাহর রাস্তায় মানব কল্যাণে) ব্যয় করো সেই দিন আসার আগে, যেদিন কোনো ক্রয়-বিক্রয় থাকবে না, কোনো বন্ধুত্ব কাজে আসবে না এবং সুপারিশও গ্রহণযোগ্য হবে না।’ (সুরা বাকারা: ২৫৪)

আরও পড়ুন: দান-সদকার যত উপকার নগদে পাওয়া যায়

অন্য এক আয়াতে দানশীলতার গুরুত্ব বোঝাতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যে সম্পদই (মানুষের কল্যাণের জন্য) ব্যয় করবে তা তোমাদের কল্যাণে আসবে। আর তোমাদের অর্থ ব্যয় শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হওয়া উচিত এবং তোমরা যে সম্পদই ব্যয় করবে তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদের দেওয়া হবে। তোমাদের প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না।’ (সুরা বাকারা: ২৭২) আরো এক মর্মস্পর্শী ভঙ্গিতে আল্লাহ দানশীলতাকে উৎসাহিত করেছেন এভাবে— ‘এবং আল্লাহকে ঋণ দাও, উত্তম ঋণ।’ (সুরা মুজাম্মিল: ২০)

দান-সদকা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য
দানশীলতার ব্যাপারে কোরআনের আরেকটি হেদায়াত হলো, দান-সদকা ও সহযোগিতা একমাত্র আল্লাহ তাআলার রাজি খুশির নিমিত্তেই হওয়া এবং তা প্রশস্ত চিত্তে পবিত্র বস্তু হওয়া জরুরি। লোক দেখানো দানের কোনো প্রতিফল নেই। আল্লাহ বলছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! দানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমরা নিজেদের দান-খয়রাতকে সে ব্যক্তির মতো ব্যর্থ করে দিও না যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর জন্য ব্যয় করে থাকে..।’ (সুরা বাকারা: ২৬৪)


বিজ্ঞাপন


গোপনে দান করা বিশেষ ফজিলতের, যদিও প্রকাশ্যেও নিষেধ নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-সদকা করো, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি গোপনে ফকির-মিসকিনকে দান করে দাও, তবে আরো বেশি উত্তম। আর তিনি তোমাদের পাপ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সুরা বাকারা: ২৭১)

আরও পড়ুন: ‘নেক আমল’ যে কারণে গোপন রাখতেন পূর্বসূরিরা

মাজার, মন্দিরে দান করা যাবে না। দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে যেখানে তাওহিদ ও সুন্নাহভিত্তিক ইলম শেখানো হয় সেখানে দান করা উচিত। দান কখনও লোক-দেখানো, নিজের প্রভাব বিস্তার ও অন্য কোনো মতলবে করা যাবে না। বরং মানবসেবার যে কাজই হোক না কেন তা হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমাদের অর্থ ব্যয় কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হবে।’ (সুরা বাকারা: ২৭২)

কাদের দান করা যাবে?
কাদের দান করা যাবে এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে সুরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে তাদের তালিকা দেওয়া হয়েছে। এ আয়াত দ্বারা ফুকাহায়ে কেরাম মোট আট শ্রেণির লোকদের দান করার কথা বলেছেন। ১. গরিব। যার সম্পদ আছে; কিন্তু নেসাব পরিমাণ মালের মালিক নয়। ২. মিসকিন। যার একদমই কোনো সম্পদ নেই। ৩. ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য শরিয়ত নির্দিষ্ট জাকাত আদায়কারী আমল। এটা ইসলামি রাষ্ট্রপ্রধান দ্বারা নিযুক্ত হতে হবে। নিজে নিজে মনে করে নিলে হবে না। (জাওয়াহিরুল ফিক্বহ-৬/৬৯) ৪. নব মুসলিমদের ইসলামের প্রতি মোহাব্বত বাড়ানোর জন্য উৎসাহমূলক জাকাত প্রদান। এ বিধানটি রহিত হয়ে গেছে। তাই বর্তমানে কোনো ধনী নওমুসলিমকে জাকাত প্রদান জায়েজ নয়। (হিদায়া: ১/১৮৪, মারেফুল কোরআন: ৪/১৭১, তফসিরে মাজহারি: ৪/২৩৫)। ৫. দাস মুক্তির জন্য। যেহেতু বর্তমানে দাসপ্রথা নেই। তাই এ খাতটি বাকি নেই। ৬. ঋণগ্রস্তের জন্য। ৭. ফী সাবিলিল্লাহ। তথা আল্লাহর রাস্তায় থাকা ব্যক্তিদের জন্য। এখন প্রশ্ন হলো আল্লাহর রাস্তায় কারা আছে? ফুক্বাহায়ে কেরাম বলেন, এতে রয়েছেন- জিহাদরত মুজাহিদরা। তাদের জিহাদের অস্ত্র ও পাথেয় ক্রয় করার জন্য জাকাতের টাকা গ্রহণ করবে। হজের সফরে থাকা দরিদ্র ব্যক্তির জন্য। ইলমে দ্বীন অর্জনকারী দরিদ্র ব্যক্তির জন্য। (আদ দুররুল মুখতার: ৩৪৩, হিদায়া: ১/১৮৫, রূহুল মাআনি: ৬/৩১৩) ৮. সফররত ব্যক্তিকে। যার টাকাণ্ডপয়সা আছে বাড়িতে। কোনো সফর অবস্থায় অসহায়। তাকে জাকাতের টাকা দেওয়া জায়েজ।

আরও পড়ুন: ৩ কাজের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার অবধারিত

নবীজির বিশেষ নির্দেশনা
দান করতে হয় নিজ দায়িত্বে অভাবীদেরকে খুঁজে খুঁজে। এছাড়াও দান-সদকার টাকা যেন প্রকৃত হকদারের কাছে যায় সেজন্য নবীজি (স.)-এর কিছু বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। উপরে উল্লেখিত অভাবিদের মধ্যে যাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে তারা হলেন—

১. যারা লজ্জায় কারো কাছে চায় না
কিছু মানুষ অর্থসংকটের শিকার, কিন্তু ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য ও সামাজিক অবস্থানের কারণে চক্ষুলজ্জায় কারো কাছে চায় না। মুখ খুলে কিছু বলতেও পারে না। দান করার সময় খুঁজে খুঁজে তাদেরকে প্রাধান্য দেয়া উচিত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এভাবে—‘তারা যেহেতু অতি সংযমী হওয়ার কারণে কারো কাছে সওয়াল করে না, তাই অজ্ঞ লোকে তাদেরকে বিত্তবান মনে করে। তোমরা তাদের চেহারার আলামত দ্বারা তাদেরকে চিনতে পারবে।’ (সুরা বাকারা: ২৭৩)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘এক-দুই লোকমা খাবার বা এক-দুইটি খেজুরের জন্য যে মানুষের দ্বারে দ্বারে ধরনা দেয়- অভাবী তো সে নয়; প্রকৃত অভাবী হলো যার অভাব আছে, কিন্তু তাকে দেখে তার অভাব আঁচ করা যায় না; যার ভিত্তিতে মানুষ তাকে দান করবে। আবার চক্ষুলজ্জায় সে মানুষের দুয়ারে হাতও পাততে পারে না।’ (সহিহ বুখারি: ১৪৭৯; সহিহ মুসলিম: ১০৩৯)

২. নিকটবর্তী লোক
দান-সদকার জন্য অগ্রাধিকার পাবে নিকটাত্মীয়রা। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আর নিকটাত্মীয়ের অধিকার রক্ষা করো।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ২৬)। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার রক্তের সম্পর্ক বজায় রাখে।’ (সহিহ বুখারি: ৬১৩৮)

এতে একদিকে যেমন সদকার সওয়াব পাওয়া যায়, একইসঙ্গে আত্মীয়তার হকও আদায় হয়ে যায়। তাই রাসুল (স.) নিকটবর্তীদের দান করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন এবং একে দ্বিগুণ সওয়াব লাভের মাধ্যম বলেছেন। তিনি বলেছেন, মিসকিনকে দান করলে কেবল দান করার সওয়াব লাভ হয়। আর আত্মীয়-স্বজনকে দান করলে দুটি সওয়াব—দান করার সওয়াব এবং আত্মীয়তার হক আদায় করার সওয়াব।’ (জামে তিরমিজি: ৬৫৮; মুসনাদে আহমদ: ১৬২৩৩)

তবে হ্যাঁ, সবসময় অন্যসব গরিব-দুঃখীদের এড়িয়ে কেবল নিকট জনদের দান করতে হবে, এমনও নয়। কখনো হতে পারে নিকটাত্মীয়ের চেয়েও অন্যদের অভাব ও প্রয়োজন বেশি। দান করার সময় তাদের প্রতিও লক্ষ্য রাখা উচিত। 

৩. বেশি অভাবী বা যার প্রয়োজন বেশি
দান-সদকা বণ্টনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়ার মাপকাঠি হচ্ছে প্রয়োজন ও অভাব। যদি প্রতীয়মান হয় যে, আপনার চেনা দরিদ্রদের মধ্যে কেউ একজন অন্যদের চেয়ে বেশি অভাবী, তাহলে সেই ব্যক্তি সদকা পাওয়ার অধিক উপযুক্ত।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সকল বিষয়ে প্রিয়নবীজির নির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন। 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন