রোববার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

হুন্ডির কারণে রেমিট্যান্সের বেহাল অবস্থা

আহসান হাবিব
প্রকাশিত: ১৮ নভেম্বর ২০২২, ১১:২৯ এএম

শেয়ার করুন:

হুন্ডির কারণে রেমিট্যান্সের বেহাল অবস্থা

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের একটি আলোচিত ইস্যু রিজার্ভ সংকট। এই সংকটের জন্য রফতানি থেকে আমদানি বেশি হওয়ার পাশাপাশি দেশ থেকে টাকা পাচার ও বিদেশ থেকে অবৈধ পথে দেশে টাকা পাঠানোর বিষয়। আর এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে হুন্ডির নাম। বলা হচ্ছে, দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে টাকা ঢুকছে মূলত হুন্ডির মাধ্যমে। এর ফলে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে। পাশাপাশি প্রবাসীরা তাদের আয় দেশে পাঠালেও হুন্ডির কারণে তা যোগ হচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে। বরং প্রযুক্তির সহায়তা এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ফাঁকফোকরে দিন দিন আরও ফুলে ফেঁপে উঠছে হুন্ডির কারবার।

হুন্ডি একটি নীতিবহির্ভূত এবং দেশের নিষিদ্ধ অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থ হস্তান্তর বা স্থানান্তর ব্যবস্থা। পূর্বে বাণিজ্যিক লেনদেন এবং ঋণ আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। এখনও হয়। তবে তা অবৈধভাবে এবং অবৈধ্য উদ্দেশ্যে। হুন্ডি ব্যবসা বলতে একটি লিখিত শর্তহীন আদেশ যা এক ব্যক্তির নির্দেশ অনুযায়ী অন্য এক ব্যক্তি লিপিবদ্ধ করেন এবং নির্দেশনামায় উল্লিখিত ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা হয়। হুন্ডি একস্থান থেকে অন্যস্থানে অর্থ প্রেরণের একটি ব্যক্তিগত পর্যায়ের কৌশল, যা মুঘল আমলে চালু হয়েছে এবং আজও প্রচলিত আছে।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: রেমিট্যান্সে ভাটা কতটা উদ্বেগের?

আমাদের দেশের প্রবাসীদের আয়ের বড় একটা অংশ যোগ হয় রেমিট্যান্সে। এর মাধ্যমেই আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধি পায়। অবশ্য কোনো বছরেই আমরা পুরোপুরি রেমিট্যান্স পাই না। প্রবাসীদের আয়ের অর্থ বা রেমিট্যান্স আসা অনেকটা কমে গেছে। এর কারণ হচ্ছে হুণ্ডি ব্যবস্থা। হুন্ডির কারণে রেমিট্যান্সের আজ বেহাল অবস্থা।

বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে টাকা পাঠানো ও দেশ থেকে অর্থ পাচার এই দুটো বিষয়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয় হুন্ডির মাধ্যমে। চাঁদাবাজি, তদবিরে আয় করা অর্থ, ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হয়। এছাড়া রফতানি মূল্য কম দেখিয়ে এবং আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয় হুন্ডির মাধ্যমে।

এজেন্ট ব্যবসার আড়ালে চলছে অবৈধ হুন্ডির রমরমা ব্যবসা। মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএফএস) অন্তত পাঁচ হাজার এজেন্ট হুন্ডি চক্রের সঙ্গে জড়িত। এরা বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়সহ বিভিন্ন মোবাইলের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করছে। এ কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছর বিশাল অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সম্প্রতি মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে এমন বেশ কয়েকজন হুন্ডি কারবারিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দেশে ডলারের দামে অস্থিরতা শুরুর পর বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে সিআইডি। এরপরই বেরিয়ে আসে ডিজিটাল হুন্ডি কারবারি চক্রের চাঞ্চল্যকর তথ্য।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: ‘পাচার ও কালো টাকা না কমলে রেমিট্যান্স বাড়বে না’

আবার বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ বাংলাদেশে না এনে স্থানীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ করছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় এর বহু এজেন্ট এই অবৈধ হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আকাশ ও স্থলপথে অবৈধ হুন্ডিতে দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ছোটখাটো এমন দু-একটি ঘটনা ধরা পড়লেও অজানা থেকে যাচ্ছে বড় অংকের ঘটনা। দেশ-বিদেশে গড়ে তোলা শক্তিশালী হুন্ডি সিন্ডিকেট গ্রাহকের টাকা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে। দিনে দিনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে হুন্ডি।

রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে তা মোকাবিলার জন্য সরকার অত্যন্ত তৎপর। হুন্ডি সবসময় রিজার্ভের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

এমএফএস এজেন্টের মাধ্যমে বছরে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসছে আনুমানিক ৭৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকার প্রায় ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসীরা দুই হাজার ১০৩ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন, যা দেশের মোট জিডিপির ৭ শতাংশের মতো। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

ডলার সংকটের সুযোগ নিয়ে ১৩টি মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠান সরাসরি হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। মানি চেঞ্জার্সের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানগুলো বেআইনিভাবে বেশি দামে নগদ ডলার কিনে সেগুলো মজুদ করছে। এভাবে বাজারে সংকটের মাত্রা বাড়িয়ে লাগাম ছাড়া দাম বাড়িয়ে ডলার বিক্রি করছে। এক্ষেত্রে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে পাসপোর্টে বৈদেশিক মুদ্রা এনডোর্স করেনি। এমনকি ডলার কেনাবেচার কোনো তথ্য রেজিস্টারেও লিপিবদ্ধ করেনি। অর্থাৎ হুন্ডির মাধ্যমে তারা ডলার কিনেছে। একই সঙ্গে হুন্ডির মাধ্যমে বিক্রিও করছে।

হুন্ডিচক্রের সদস্যরা প্রবাসে বাংলাদেশীদের কাছ থেকে বিদেশী মুদ্রা সংগ্রহ করে দেশে তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। কিন্তু হুন্ডিকারবারীরা বিদেশি মুদ্রা না পাঠিয়ে সমমূল্যের বাংলাদেশি টাকা দেশে পরিবারকে বুঝিয়ে দেন। হুন্ডিচক্র কাজটি করে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে। প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে প্রবাসীদের কাছ থেকে বিদেশি মুদ্রা সংগ্রহ করে। দ্বিতীয় গ্রুপ কাজ করে দেশে। হুন্ডির সমপরিমাণ অর্থ তারা বাংলাদেশি টাকায় নির্দিষ্ট দেশীয় মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের দেয়। ওই এজেন্টরা হলো তৃতীয় গ্রুপ। হুন্ডি হয়ে তাদের হাতে আসা টাকা তারা দেশে নির্দিষ্ট ফোন নম্বরে পরিশোধ করে। এভাবে কোটি কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করছে। অপরদিকে বাংলাদেশ রেমিট্যান্স হারাচ্ছে। দেশের টাকা দেশে রাখতে হলে এবং টাকা পাচার বন্ধ করতে বাজেটে বিনিয়োগের সুযোগগুলো বৃদ্ধি ও পাচারের ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মানি লন্ডারিংয়ের (অর্থপাচার) উৎস হলো কালো টাকা। কালো টাকার উৎসগুলো বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধ হবে প্রথম পদক্ষেপ। এ ছাড়া টাকা পাচার ও কালো টাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শাস্তির দু-একটি উদাহরণ সৃষ্টি করলে এ প্রবণতা কমে আসবে বলে আমরা মনে করছি।

আরও পড়ুন: রেমিট্যান্স বাড়াতে হুন্ডি বন্ধে আইনের প্রয়োগ চান অর্থনীতিবিদরা

ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে হুন্ডি প্রতিরোধ করতে হবে। এজন্য বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আনার খরচ কমাতে হবে। রেমিট্যান্সের প্রণোদনার ব্যবস্থাটি চলমান রাখতে হবে। মনিটরিং আরো জোরদার করতে হবে। শাস্তির বিধানগুলো কার্যকর করতে হবে। রেমিট্যান্সের টাকা যাতে গ্রাহক দ্রুত পেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ মানুষ হুন্ডিতে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে টাকা দ্রুত পাওয়া। যেকোনো অঞ্চল থেকে মানুষ দ্রুত হুন্ডিতে টাকা পায় বলেই এটি জনপ্রিয় হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যাংক খাতে রিফর্ম করা উচিত। ব্যাংকগুলোতে যোগসাজশে বা মিলেমিশে দুর্নীতি ও অনিয়মের নজির দেখা যাচ্ছে। এদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ব্যাংকের গ্রাহক সেবা বাড়াতে হবে। তাহলে ব্যাংকের প্রতি মানুষ আগ্রহী হয়ে উঠবে। সেবাগুলোকে সাশ্রয়ী করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের একটা সুযোগ দিলে হয়তো কালো টাকাগুলো বিনিয়োগে ফিরে আসবে।

প্রবাসীরা অবৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠালে দেশে তাদের স্বজনরা আইনের আওতায় আসতে পারেন তা গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে। যারা বিদেশ থেকে অবৈধ পথে টাকা পাঠাচ্ছেন এবং দেশ থেকে সে টাকা গ্রহণ করছেন, তাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মনিটরিং করে আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি প্রবাসীদের কষ্টার্জিত টাকা পেতে আত্ময়-স্বজনরা যেন হয়রানির শিকার না হন, ব্যাংকের মাধ্যমে যেন তারা টাকাটা তাড়াতাড়ি পেতে পারেন এর ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই দেশে রেমিট্যান্সের গতি বাড়বে এবং হুন্ডি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর