গত কয়েক দিন ধরে গরমের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল- কোথাও বিদ্যুতে স্বস্তি নেই। দিনের বেলা বিদ্যুৎ না থাকলেও কোনো রকম চলে যায়। কিন্তু রাতের বেলা তা সহ্যের সীমা ছাড়াচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাতের বেলায়ও কয়েক দফা আসা-যাওয়া করছে বিদ্যুৎ। সবথেকে বেশি ভোগাচ্ছে মধ্যরাতের লোডশেডিং। কর্মজীবীরা বলছেন, সারাদিন কাজ-কর্ম শেষ করে যখন একটু ঘুমুতে যান একটু পরই চলে যায় বিদ্যুৎ। গরমে আর ঘুম আসে না। ঘণ্টাখানেক পরে বিদ্যুৎ এলে আসা-যাওয়ার প্রক্রিয়া চলে শেষ রাত পর্যন্ত। এভাবে রাতে ঠিকমতো ঘুম আসছে না। পরদিন অফিসে গিয়ে সারাদিন ঝিমুনি আর ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। যাদের বাসায় অসুস্থ মানুষ, বয়োবৃদ্ধ কিংবা শিশু আছে তাদের অনেক বেশি কষ্ট পোহাতে হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
কয়েক দিন ধরেই দেশে তীব্র তাপদাহ চলছে। এতে চাহিদা বাড়তে থাকে বিদ্যুতের। গরম আবহাওয়ার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা যখন তুঙ্গে ঠিক সেই সময় কয়লা সংকটে বন্ধ হয় দেশের বৃহত্তম কয়লাভিত্তিক পায়রার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। গত ২৫ মে প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়। এরপর সোমবার (৫ জুন) থেকে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম ইউনিট বন্ধ হওয়ার পর থেকেই তীব্র লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে দেশ।
জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে জানা গেছে, সোমবার বিকেল ৪টার দিকে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ১১ হাজার ৮৫২ মেগাওয়াট। একই সময় চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৮০০। সে হিসেবে ওই সময় লোডশেডিং হয়েছে ২৮১৫ মেগাওয়াট। রোববার দিবাগত রাত ১টার দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ১১ হাজার ৫৩৩ মেগাওয়াট। অপরদিকে চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। ওইসময় লোডশেডিং হয়েছে ৩২১৫ মেগাওয়াট। যা গত কয়েক দিনে সর্বোচ্চ।
পিজিসিবির হিসাব অনুযায়ী, রাতে বিদ্যুতের চাহিদা বেশি থাকার কারণে লোডশেডিংও বেশি হচ্ছে। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। রাজধানীর একটি বেসরকারি অফিসে কর্মরত মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রফিকুল। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘রাতে লোডশেডিংয়ের কারণে ঠিকমতো ঘুম হয় না। এতে অফিসে গিয়ে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কাজ করতে হয়। গতকাল (রোববার) রাতেও দুইবার লোডশেডিং হয়েছে। বিদ্যুৎ যায় রাত দুইটায়-তিনটায়। সকালে ঘুম ভাঙে গরমে। না দিনে ঠিকভাবে কাজ করতে পারি, না পারি রাতে ঠিকভাবে ঘুমাতে।’
বিজ্ঞাপন
একই অভিযোগ মিরপুরের বাসিন্দা হিমু আক্তারের। তিনি বলেন, ‘রোববার রাত সাড়ে ১১টায় কারেন্ট গিয়ে এলো ১টার পর। এরপর আবার ৩টা থেকে নেই। ফজরের আজানের সময়ও কারেন্ট আসার নাম নেই। কোথায় বাস করি! এই গরমে এত কষ্ট আর নেওয়া যায় না।’
দিনেও চলে দফায় দফা লোডশেডিং। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা লাকী আক্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গত সপ্তাহ-দুয়েক ধরে পরিস্থিতি খারাপ। আগে কালেভদ্রে একবার লোডশেডিং হলেও এখন দিনরাত মিলে একাধিকবার বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় ভীষণ কষ্টে আছি। একবার গেলে এক ঘণ্টার আগে আসে না। সকাল নয়টার মধ্যে এক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ যাবেই। সারাদিনে কমপক্ষে তিনবার, রাতে দুইবার বিদ্যুৎ যাওয়া রুটিন হয়ে গেছে। আমরা বিদ্যুতের সমাধান চাই। কারণ আমাদের বিল তো বকেয়া নেই।’
কারওযান বাজার এলাকার বাসিন্দা তুহিন বলেন, ‘আমাদের এলাকা বাণিজ্য হওয়াতে বিদ্যুৎ অনেক কম যেত। কিন্তু এখন খুব ঘনঘন বিদ্যুৎ যায়। লোডশেডিংয়ের জ্বালায় আমরা অতিষ্ঠ।’
এদিকে তীব্র লোডশেডিংয়ে দুর্ভোগের কথা স্বীকার করছে সরকারও। অসহনীয় পর্যায়ে লোডশেডিংয়ের কারণে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের লোডশেডিং বেড়ে গেছে। আমরা বারবার বলে আসছিলাম, বিশেষ করে আমাদের যে ফুয়েল গ্যাস কয়লা তেল, দীর্ঘ সময় লাগছে এগুলো যোগান দিতে। এ কারণে আমাদের লোডশেডিংয়ের জায়গাটা আরও দীর্ঘতর হচ্ছে। এখন যে সমস্যাটা দেখা দিয়েছে আমরা দেখছি পরিস্থিতি অনেকটা অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে। আমরা বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে চেষ্টা করছি এটা কত দ্রুত সমাধান করা যায়। সরকারের পক্ষ থেকে এটা সমাধানের চেষ্টা চলছে। কত দ্রুত অন্তত পায়রাতে কয়লা নিয়ে আসা যায় সেই চেষ্টা চলছে।’
লোডশেডিংয়ের কারণ জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, পায়রা বন্ধ হচ্ছে, বড়পুকুরিয়াতে আমাদের পাওয়ার প্লান্টটি অর্ধেক ক্যাপাসিটিতে চলছে। আমাদের লিকুয়িট ফুয়েল যে পাওয়ার প্লান্টগুলো ছিল সেগুলো প্রায় অর্ধেক ক্যাপাসিটিতে চলছে। যে কারণে আমাদের লোডশেডিংয়ের মাত্রাটা অনেক বেড়ে গেছে। আমরা বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে এটার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। আমরা অচিরেই চেষ্টা করছি যে, এই অবস্থা থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
রাতে বিদ্যুতের চাহিদা বেশি থাকছে। তাই বেশি লোডশেডিং দিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পিডিবির পরিচালক (জনসংযোগ) মো. শামীম হাসান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কয়লা সংকটের কারণে পায়রার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এখানে একটা ঘাটতি হচ্ছে। রাতের বেলা অনেক কারখানার শিফট চালু থাকে। তার ওপর তীব্র গরম আবহাওয়ার কারণে আবাসিকেও বিদ্যুতের চাহিদে বেশি থাকছে। যার কারণে রাতেও লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। আমরা আশা করছি খুব শিগগিরই এই সংকট কেটে যাবে।’
টিএই/জেবি