রাজধানীতে আধুনিক জীবনযাপন ও যান্ত্রিক কোলাহল থেকে একটু প্রশান্তি পেতে এখন ইনডোর প্ল্যান্ট বা ঘরের ভেতরের টবের গাছ একটি ট্রেন্ড হয়ে ওঠেছে। ড্রয়িংরুম, বেলকনি কিংবা জানালার পাশে নানা প্রজাতির টবে গাছ রাখেন নগরবাসী। এতে যেমন ঘরের সৌন্দর্য বাড়ে তেমনি মানসিক প্রশান্তি মিলে। কিন্তু এই গাছের টবে জমে থাকা অল্প পানিই এখন ডেঙ্গু সংক্রমণের নতুন উৎসে পরিণত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরেজমিন রাজধানীর মিরপুর, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ ও মোহাম্মদপুর এলাকার কয়েকটি বাসা ঘুরে দেখা যায়, বাসার ভেতরে ইনডোর প্ল্যান্ট বা ঘরের ভেতরের টবের পানি জমে আছে। সে পানি কালো হয়ে গিয়েছে। পানি পরিবর্তনের কথা মনে থাকে না পরিবারের সদস্যদের। সেখান থেকে এডিস মশার লার্ভা জন্ম নিচ্ছে এবং পরবর্তী সময়ে ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৫ নম্বর ওয়ার্ড হাজারীবাগ। এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এবার আমাদের এলাকায় ডেঙ্গুর প্রভাব গত কয়েক বছরের তুলনায় বেশি। এছাড়া আগের মতো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কার্যক্রমও আমার নজরে আসেনি।’
এক পরিবারের চারজন আক্রান্ত
ধানমন্ডি ১৫ নম্বরের একটি বাসার ষষ্ঠ তলায় চার সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন আমজাদ মিয়া। তার ছোট মেয়ে লামিয়ার শখের কারণে ঘরে কয়েকটি ইনডোর প্ল্যান্ট লাগানো হয়েছে। গত মাসে এক সঙ্গে দুই মেয়েসহ চারজনের ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। পরে তারা জানতে পারেন ইনডোর প্ল্যান্টের টবে জমা থাকা পানিতে ডেঙ্গু মশা জন্মেছে। এরপর থেকে প্রতি তিন দিন পরপর ইনডোর প্ল্যান্টের পানি পরিবর্তন করেন তারা।
আমজাদ মিয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডেঙ্গু হওয়ার পর আমি ভাবছি আমরা এত উপরে থাকি, যেখানে এডিস মশা উড়ে আসা সম্ভব নয়। কিন্তু কীভাবে এলো। এই চিন্তা গত কয়েক দিন ধরে করছি। পরে ডাক্তারের কাছে সব খুলে বললে ডাক্তারই আমাদের বললেন, ইনডোর প্ল্যান্টের টবের পানিতেও এডিস মশার লার্ভা জন্ম নেয়।’
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও বলেন, ‘এরপর বাসায় এসে যখন জিজ্ঞেস করি টবের পানি কতদিন ধরে পরিবর্তন করা হয়নি। তখন ছোট মেয়ে বলে, বাবা! জ্বর আসার ১০ থেকে ১৫ দিন আগে থেকে টবে তো একই পানি আছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজে গিয়ে পানি পরিবর্তন করি। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে হলে সবাইকে সচেতন হতে হবে।’
ইনডোর প্ল্যান্টে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ব্যাচেলর
রাজধানীর মিরপুর, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর এলাকার কয়েকটি ব্যাচেলর বাসা ঘুরে দেখা যায়, তাদের ঘরের ইনডোর প্ল্যান্টের পানি তারা মাসে একবারও পরিবর্তন করেন না। দীর্ঘদিন জমে থাকতে থাকতে এক সময় শুকিয়ে গেলে আবার বেশি করে টবে পানি দেন তারা।
ধানমন্ডির একটি ফ্ল্যাটে একটি রুম নিয়ে থাকেন দুই বন্ধু সারোয়ার হোসেন ও মাসুম রানা। কিছুদিন আগে তারা দুজনই আক্রান্ত হন ডেঙ্গুতে। সারোয়ার হোসেন ঢাকা মেইলেকে বলেন, ‘আমরা আগে বুঝতে পারিনি যে, ইনডোর প্ল্যান্টের পানিতেও এডিস মশার লার্ভা হতে পারে। দুজনই ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর আমাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। এখন আমরা যেমন পানি পরিবর্তন করি রেগুলার, তেমনি ঘর পরিষ্কার রাখি।’
মিরপুর বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী রবিউল। তিনি থাকেন আগারগাঁও ৬০ ফিট এলাকায়। ইনডোর প্ল্যান্ট থেকে ডেঙ্গু ছড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাসাবাড়ির ভেতরের টবে দীর্ঘদিন পানি জমে থাকলে তাতে এডিস মশা লার্ভা জন্ম নেবে- এটা স্বাভাবিক। এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। কিছুদিন আগে আমার কয়েকজন বন্ধু একসঙ্গে আক্রান্ত হন ডেঙ্গুতে। তাদের বাসায় একাধিক ইনডোর প্ল্যান্ট আছে। এসব প্ল্যান্টের পানি তারা পরিবর্তন করে কি না তা আমার সন্দেহ। জানেনই তো ব্যাচেলরা কেমন হয়…।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ( ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন ঢাকা মেইলেকে বলেন, ‘ঘরের ভেতরে যেসব প্ল্যান্টের টবে পানি জমে থাকে সেখানে এডিস মশার লার্ভা জন্ম নিতে পারে। আমাদের পক্ষে তো আর বাসার ভেতরে গিয়ে গিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। এরজন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা।’
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আপনারা কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সকাল-বিকেল পর্যাপ্ত লোকের মাধ্যমে আমরা ওষুধ দিচ্ছি। এছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের পরিষ্কার-পরিছন্নতা অভিযান চলমান রয়েছে। একই সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। যেমন মসজিদে জুমার খুতবায় ডেঙ্গুর বিষয়ে বলতে আমরা অনুরোধ করেছি। এছাড়া প্রতি শনিবার স্থানীয় সরকার সচিব, সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতনসহ অন্য সকল কার্মচারী কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করে ডেঙ্গুর সচেতনমূলক সভা করা হয়। আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘এখন ডেঙ্গু কেবল ড্রেন বা খোলা জায়গা থেকে নয়, ঘরের ভেতরের টব বা সাজানো গাছের পানিতেও জন্ম নিচ্ছে। যারা নিয়মিত পানি পরিবর্তন করেন না, তাদের বাসাতেই বেশি লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে।’
সৌন্দর্যের সঙ্গে সচেতনতাও জরুরি
ডেঙ্গুর মৌসুমে ঘর পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরা বলছেন ইনডোর প্ল্যান্টের যত্ন নিতে হবে নিয়ম মেনে। তারা পরামর্শ দিয়ে বলেছেন-
প্রতি দুই দিনে একবার টবের পানি পরিবর্তন করুন।
টবের নিচে ট্রে থাকলে সেটি শুকনো রাখুন।
ফুলদানি বা পানিভর্তি বাটি ঘরে রাখলে নিয়মিত পরিষ্কার করুন।
প্রয়োজন হলে পানির ওপর সামান্য ডিটারজেন্ট বা ব্লিচিং মিশিয়ে দিন, এতে লার্ভা বাঁচবে না।
ঘরের কোণে বা পর্দার পেছনে মশার আশ্রয় হতে পারে—তাই আলো-বাতাস চলাচল নিশ্চিত করুন।
এমএইচএইচ/জেবি


















