শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

নিঃশব্দে এক যুদ্ধ, ডেঙ্গু থেকে বেঁচে ফেরা মানুষের গল্প

মাহফুজুর রহমান
প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৩১ এএম

শেয়ার করুন:

dengue2
হাসপাতালে জীবনের লড়াই। ছবি: সংগৃহীত

বর্ষার ভেজা সন্ধ্যায় যখন শহর ডুবে থাকে বৃষ্টির জলে, তখন কোথাও না কোথাও কেউ নিঃশব্দে জ্বরে কাঁপছে। হয়ত সে জানেই না, শরীরের ভেতর ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে যুদ্ধ। ডেঙ্গুর ভাইরাস নিঃশব্দে তার শরীর দখল করছে, আর ঘরের মানুষ চিন্তিত মুখে তার কপালে হাত রাখছে। এমনই হাজারো পরিবারের মধ্যে অনেকেই আজও সেই ভয়, উদ্বেগ আর কান্নার স্মৃতি ভুলতে পারেনি। কেউ হারিয়েছে প্রিয়জনকে, কেউ ফিরে পেয়েছে জীবন নতুন করে।

রিমা নামের এক কলেজছাত্রী। কয়েক মাস আগে হালকা জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন সর্দি-জ্বরই হবে। কিন্তু তৃতীয় দিনেই জ্বর কমে গিয়ে শরীরে দেখা দেয় অসহ্য ব্যথা, চোখের পেছনে চাপ, খাবার খেতে না পারা। পরীক্ষা করাতে গিয়ে জানা গেল, তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত। পরিবারের সবার ভেতর শুরু হলো আতঙ্ক। প্লেটলেট কমতে শুরু করল। রাতে হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। রিমা আবার কলেজে ফিরে গেছেন, কিন্তু এখনো প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে জানালা বন্ধ করে মশারি টাঙিয়ে রাখেন। তার মনে হয়, প্রতিটি মশা যেন মৃত্যুর আগমনী বার্তা। তবু তিনি বেঁচে আছেন, কারণ তিনি সময়মতো চিকিৎসা পেয়েছিলেন।


বিজ্ঞাপন


হাসপাতালের করিডরে জীবনের লড়াই

তুহিনের গল্প ভিন্ন। ব্যাংকের তরুণ কর্মকর্তা, সবসময় কর্মচঞ্চল। প্রতিদিন খবরের কাগজে পড়তেন, ‘ডেঙ্গুতে আরও মৃত্যু’, ‘হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ’। কিন্তু একদিন সেই সংবাদ যেন নিজের ঘরেই ঢুকে পড়ল। অফিস থেকে ফিরে শরীরে হঠাৎ দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, তারপর অজ্ঞান। হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা গেল, প্লেটলেট বিপজ্জনকভাবে কমে গেছে। চিকিৎসার পাশাপাশি বন্ধুবান্ধব রক্তের ব্যবস্থা করল, মা দিনরাত পাশে ছিলেন। কয়েক দিন পর তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এখন তুহিন মনে করেন, ডেঙ্গু কেবল রোগ নয়, এটি এক শিক্ষা—জীবনের ভঙ্গুরতা ও সময়ের মূল্য বোঝানোর এক নির্মম উপায়।

Dengu-won1

হাসপাতালের করিডোর এখন প্রতিদিনের যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। মশারির নিচে অসংখ্য শিশু, তরুণ, বৃদ্ধ শুয়ে আছে। কেউ কাঁদছে ব্যথায়, কেউ নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। একজন রোগীর স্যালাইনের ফোঁটা গুনছে তার মা, আরেকজনের পাশে ভাই নিঃশব্দে বসে আছে। নার্সরা ছুটে চলেছেন এক বেড থেকে আরেক বেডে। হাসপাতালে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে মিশে যায় ওষুধ, স্যালাইন, আর অজানা আতঙ্কের গন্ধ।


বিজ্ঞাপন


হারানোর বেদনা, মানবতার আলো

ডেঙ্গুর এই ভয় শুধু শরীরে নয়, মনেও গভীর দাগ ফেলে। যারা ফিরে এসেছে মৃত্যুর মুখ থেকে, তারা এখন নতুনভাবে জীবনকে ভালোবাসে। কিন্তু যারা প্রিয়জন হারিয়েছে, তাদের কাছে প্রতিটি বৃষ্টির দিন মানে এক ধরনের অজানা ভয়ের দিন।

সুমি বেগমের তিন বছরের ছেলে রোহান খেলতে খেলতে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল। প্রথমে বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়েই কয়েক দিন বাড়িতে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ রোহানের শরীর ফুলে ওঠে, চোখ বন্ধ হয়ে আসে। হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা যায়, শরীরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। চিকিৎসকরা চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারেননি। রোহান চলে গেছে চিরতরে। আজও সুমি প্রতিদিন নিজের উঠান, ঘর, পুকুরপাড় পরিষ্কার করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, অন্য কোনো মা যেন তার মতো কান্না না করে, সেটিই এখন তার জীবনের লক্ষ্য।

হাসপাতালে আরেক প্রান্তে এক বৃদ্ধ নিজেই স্যালাইনের বোতল ধরে রেখেছেন। পাশে এক তরুণী শুয়ে আছে জ্বরে কাঁপতে। দুজনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই, তবু একে অপরের প্রতি সহমর্মিতায় তারা বেঁচে থাকে। কেউ অন্যের জন্য বাতাস করছেন, কেউ নিজের খাবার ভাগ করে দিচ্ছেন। এই ছোট ছোট মানবিক আচরণগুলোই হয়তো এই সংকটের সবচেয়ে উজ্জ্বল আলো।

ডেঙ্গুর সংক্রমণ যত ছড়াচ্ছে, তত বাড়ছে মানবিক গল্পের সংখ্যাও। রাশেদ নামের এক তরুণ আইসিইউতে মৃত্যুর মুখে ছিলেন। প্লেটলেট ৪০০০-এ নেমে গিয়েছিল। পরিবার রক্ত খুঁজে পাচ্ছিল না, হাসপাতালে প্যাকেট শেষ। ঠিক তখন কিছু স্বেচ্ছাসেবক দল এগিয়ে আসে, রাতে রক্ত নিয়ে পৌঁছে যায় হাসপাতালে। পরদিন সকালে রাশেদ ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাঁর বেঁচে ফেরাটা শুধু চিকিৎসার সাফল্য নয়, মানবতারও জয়।

আশার আলো ও জীবনের দায়বদ্ধতা

ডেঙ্গুর ভয় এখন শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ নেই। এর প্রভাব ছড়িয়ে গেছে গ্রামের বাড়িতেও। শহরে কাজ করতে গিয়ে মারা যাওয়া মানুষদের গল্প এখন প্রতিটি গ্রামে শোনা যায়। বগুড়ার জোয়ার গ্রামে মোসারফ হোসেন ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। আগস্টের শেষ সপ্তাহে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার পরিবার এখন প্রতিদিন রাতে মশারি টাঙায়। স্ত্রীর মুখে এখন একটাই কথা—আগে মশারিকে ঝামেলা মনে হতো, এখন মনে হয় এটাই জীবনের নিরাপত্তা।

Dengu-won3

গ্রাম-শহর মিলিয়ে এখন সবাই এক অদৃশ্য আতঙ্কে বাস করছে। বৃষ্টির পানি জমে থাকলে, নোংরা ড্রেনে যদি লার্ভা দেখা যায়, সঙ্গে সঙ্গে খবর যায় পৌরসভা বা ইউনিয়ন অফিসে। তরুণরা নিজেরাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছে। কেউ হাতে স্প্রে নিয়ে ঘুরছে, কেউ দেয়ালে লিখছে—‘জল জমাবেন না, জীবন বাঁচান।’ সচেতনতা এখন আর শুধু সরকারি প্রচারণায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি হয়ে উঠছে মানুষের ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অনেকেই এখন মানসিক উদ্বেগে ভুগছেন। রাতে ঘুমাতে ভয় পান, হালকা জ্বর হলেই আতঙ্কে ভোগেন। অনেকেরই মনে হয়, সেই ভয়াবহ সময় যেন আবার ফিরে আসছে। কিন্তু একই সঙ্গে তারা জীবনের নতুন মানে খুঁজে পেয়েছেন। অনেকেই এখন সামাজিক মাধ্যমে নিজের অভিজ্ঞতা লিখছেন, যাতে অন্যরা সচেতন হয়, ভয় না পায়। কেউ বলছেন, ‘ডেঙ্গু আমাকে শিখিয়েছে, জীবন আসলে কতটা মূল্যবান।’

শিক্ষার্থীরা এখন স্কুলে নিজেরাই মশার প্রতিরোধে প্রচারণা চালাচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় চলছে সচেতনতা ক্যাম্পেইন। কেউ মশারি বিলাচ্ছে, কেউ পরামর্শ দিচ্ছে পানি জমতে না দেওয়ার। ডেঙ্গুর ভয়কে হারাতে তারা একে অপরের পাশে দাঁড়াচ্ছে।

এক সময় এই শহর অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল মৃত্যু সংবাদের ভারে। এখন আবারও আলো ফিরছে মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভেতর দিয়ে। কোনো মা অন্য মায়ের সন্তানের জন্য রক্ত দিচ্ছেন, কোনো তরুণ নিজের অফিসের সহকর্মীর জন্য রাত জেগে হাসপাতালের বাইরে অপেক্ষা করছে। এই মানবিক শক্তিই হয়তো ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র।

ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যুও থেমে নেই। কিন্তু প্রতিটি মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, বেঁচে থাকা মানেই দায়িত্বশীল হওয়া। নিজের ঘর পরিষ্কার রাখা, মশার প্রজনন বন্ধ করা, অন্যকে সচেতন করা—এই ছোট ছোট কাজগুলোই এখন জীবন রক্ষার সমান মূল্যবান।

শহরের প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি পরিবারের গল্পেই এখন ডেঙ্গুর ছায়া আছে। কেউ বেঁচে গেছে অলৌকিকভাবে, কেউ হারিয়েছে প্রিয়জনকে। কিন্তু সবাই একই কথা বলে—আমরা বাঁচতে চাই, আর যেন কেউ ডেঙ্গুর কারণে প্রিয়জন হারায় না।

ডেঙ্গু হয়তো পুরোপুরি নির্মূল করা যাবে না, কিন্তু সমাজের সম্মিলিত চেষ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা কমানো সম্ভব। আর সেই চেষ্টার সূচনা হতে পারে নিজের ঘর থেকে, নিজের উঠান থেকে, নিজের মশারি টাঙানো থেকেই।

রিমা এখন প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে জানালা বন্ধ করে দেয়, আলো নিভিয়ে মশারিতে শুয়ে পড়ে। বাইরে বৃষ্টি পড়ে, মাঝে মাঝে মৃদু বাতাসে মশারি দুলে ওঠে। সে চোখ বন্ধ করে ভাবে—সেদিন যদি সময়মতো হাসপাতালে না যেত, হয়তো এই দৃশ্য আর দেখা হতো না। তার মন থেকে ভেসে আসে একটাই প্রার্থনা—এই শহরের আর কোনো মানুষ যেন ডেঙ্গুর কারণে কান্নায় ভেঙে না পড়ে।

তুহিন এখন আবার অফিসে যায়, কিন্তু ডেস্কের কোণে ছোট একটি মশারি রাখে, স্মারক হিসেবে। রাশেদ আবার তার স্বেচ্ছাসেবক দল নিয়ে হাসপাতালের বাইরে রক্ত সংগ্রহ ক্যাম্প করে। সুমি বেগম প্রতিদিন রোহানের নাম ধরে ডাকে, কিন্তু চোখে জল নয়, বরং একরাশ দৃঢ়তা।

এই শহরের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি পরিবারের মধ্যেই আছে এমন গল্প—যেখানে মৃত্যু ও জীবনের লড়াই চলে প্রতিদিন, যেখানে ভয়কে জয় করে উঠে আসে আশার আলো।

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আমাদের কাঁদিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের মানুষ হতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে, বেঁচে থাকার মানে কেবল নিজের নয়, অন্যের প্রতিও দায়বদ্ধতা।

Dengue-won-4

আমরা সবাই হয়তো কখনো না কখনো রিমা, তুহিন বা রাশেদ হবো। হয়তো আমাদেরও কোনো প্রিয়জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবে, হয়তো ভয় আবার ফিরে আসবে। তবু আমাদের প্রার্থনা একটাই—বাঁচতে চাই, ডেঙ্গু যেন আর কোনো জীবন না নেয়।

‘রাতভর জেগে সন্তানের পাশে’

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছেলেটির শরীরের তাপমাত্রা যখন বারবার ১০৪ ছুঁয়ে যাচ্ছিল, তখন মায়ের চোখে ঘুম ছিল না। সারারাত কখন ঠান্ডা পানি দিয়ে পট্টি দিয়েছে, কখন ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে থেকেছে—নিজেও মনে করতে পারেন না। ‘ওর শরীর পুড়ে যাচ্ছিল, আমি শুধু আল্লাহর নাম নিচ্ছিলাম,’ বললেন তিনি। সকালে আবার হাসপাতালে দৌড়, রিপোর্ট হাতে নিয়ে ডাক্তার দেখানো, ওষুধের ব্যবস্থা—সবকিছুই একা সামলেছেন। ‘ওর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, তখন মনে হয়েছিল আমি কিছু হারাতে যাচ্ছি,’ কণ্ঠ কেঁপে উঠল মায়ের।

‘খাবারে যত্ন, কোরআন তেলাওয়াতে ভরসা’

সন্তানের ডেঙ্গু ধরা পড়ার পর থেকেই মা নিজেই রান্নাঘরে নেমে পড়েন। ডাবের পানি, ফলের রস, পেঁপে পাতা সেদ্ধ, সুপ—সবই নিয়ম মেনে খাওয়াতেন। ‘শরীরের পানি যেন না কমে, সেটা দেখতাম সবসময়,’ বলেন তিনি। চিকিৎসার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক সান্ত্বনার আশ্রয়ও নিয়েছেন তিনি। প্রতিরাতেই সন্তানের পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত করতেন, আয়াতুল কুরসি পড়ে সন্তানের গায়ে ফুঁ দিতেন। ‘আমি জানতাম চিকিৎসা দরকার, কিন্তু দোয়ার শক্তিও আছে,’ বলেন তিনি। দিনরাত যত্নে এখন সন্তান সম্পূর্ণ সুস্থ।

‘প্রতিদিন হাসপাতালে, মনটা ভারী হয়ে যেত’

নিজে সুস্থ থেকেও প্রতিদিন হাসপাতালে ছুটতেন এক তরুণ শিক্ষক। তাঁর এক আত্মীয়ের ছোট্ট মেয়ে ডেঙ্গুতে ভর্তি ছিল। শিশুটিকে নড়তে না দেখে বুকের ভেতর কেমন ভারী হয়ে যেত। ‘ছোট্ট মেয়েটার নিঃশ্বাসের শব্দও কষ্টের মনে হচ্ছিল,’ বললেন তিনি। পাশে বসে গল্প করতেন, বই পড়ে শোনাতেন—যাতে মনটা ভালো থাকে শিশুটির। হাসপাতালের করিডরে সারি সারি বেডে এত অসুস্থ শিশু দেখে তাঁর মনটা আরও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত। ‘ভাবতাম, এত ছোট ছোট প্রাণ এমন যন্ত্রণায় কেন?’ চোখ নামিয়ে বললেন তিনি।

এম/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর