- ভর্তি সাধারণ রোগীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গুতে
- হাসপাতালের অব্যবস্থাপনাকে দুষছেন রোগীরা
- মশারি টানালেও মশা থেকে রক্ষা পাওয়া মুশকিল
- নতুন সংক্রমণের আশঙ্কাও সৃষ্টি করছে
- মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান
সাড়ে চার মাসের শিশু আদিবা নূর। ঠান্ডাজনিত সমস্যায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় আদিবার পরিবার। চিকিৎসক হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। পরে আদিবার ঠাঁই হয় মাতুয়াইল শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে। সব পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষে হাসপাতাল তাকে ভর্তি নেয়। আট দিন পর কিছুটা সুস্থ হলে এবার বাসায় যাওয়ার পালা। কিন্তু না, এখানে ঘটল আরেক বিপত্তি। হাসপাতালের মশার কামড়ে এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলো শিশু আদিবা।
বিজ্ঞাপন
শিশু আদিবার মা জেসমিন (ছদ্মনাম) ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা গরিব মানুষ। এজন্য সরকারি হাসপাতালে এসেছি। আমার বাবুর ঠান্ডার চিকিৎসা করাতে এসেছিলাম। এখানে সে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। রোগ সারাতে হাসপাতালে এসেছিলাম, আরেক রোগ এখন সঙ্গী হলো।’
সরেজমিনে দেখা যায়, শত শত রোগী হাসপাতালটিতে ভর্তি রয়েছেন। তাদের অনেকেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। কেউ কেউ অন্য রোগের চিকিৎসা নিতে এসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
অপর এক রোগীর আত্মীয় (জসিম) ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে আসে রোগী। অথচ সেই হাসপাতালেই মশার উৎপাদন কেন্দ্র। মনে হচ্ছে ঘরের শত্রু বিভীষণ। হাসপাতলের পেছনের ডাস্টবিনগুলোর মুখ খোলা, নোংরা, ময়লার স্তুপ, বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকা জায়গাগুলো এখন মশার প্রজননকেন্দ্র। ডেঙ্গু এখন হাসপাতাল ও তার আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ফলে হাসপাতালে ভর্তি অন্যান্য রোগীরাও এটা নিয়ে শঙ্কিত।’

নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত এক শিশুর অভিভাবক ঢাকা মেইলকে জানান, হাসপাতালে সন্ধ্যা নামলেই মশার উৎপাত বেড়ে যায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কাউকে কাউকে মশারি দিচ্ছে। কেউ নিজেই বাসা থেকে মশারি নিয়ে এসেছেন। তবে মশারি টানানো হলেও মশার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন ফাঁক-ফোকর দিয়ে মশা ভেতরে ঢুকে পড়ে। আর এভাবেই রোগীরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
ডেঙ্গু চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে আসা রোগীরাই এখন মশার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। মাতুয়াইল শিশু ও মাতৃ-স্বাস্থ্য হাসপাতালটি যেন এখন পরিণত হয়েছে মশার উৎপাদন কেন্দ্রে। হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে খোলা ডাস্টবিন, নোংরা পরিবেশ ও স্থির পানির জমে থাকা জায়গাগুলো এখন মশার প্রজননক্ষেত্র।
হাসপাতাল পরিদর্শনে দেখা গেছে, ভবনের পেছনের অংশে জমে থাকা পানি, করিডোরে রাখা বর্জ্য ও খোলা ময়লার স্তুপে ভনভন করছে মশা। রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ— চিকিৎসা নিতে এসে এখন মশার কামড়েই বেশি ভুগতে হচ্ছে।
রোগীদের অনেকে বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি, কিন্তু এখানেও মশার কামড়ে শান্তি নেই। মনে হচ্ছে হাসপাতাল নয়, মশার অভয়ারণ্য।
চিকিৎসক ও কর্মচারীরাও মশার উপদ্রবে ভোগান্তির কথা স্বীকার করেছেন। তারা জানান, নিয়মিত ফগিং বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কার্যক্রম না থাকায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালেই যদি এমন নোংরা পরিবেশ থাকে, তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন হয়ে পড়বে। তারা দ্রুত পরিচ্ছন্নতা ও ফগিং কার্যক্রম জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন।

হাসপাতালেই ডেঙ্গুর জন্মভূমি
হাসপাতালের অভ্যন্তরে ঘুরে দেখা যায়, ভবনের পেছনের দিকে ড্রেনের মুখগুলো খোলা। জমে আছে পানি। হাসপাতালটির পশ্চিম পাশে ময়লার স্তুপ। তার পাশে বড় একটি ঝিল। উত্তর পাশে খোলা ঢাকনা, কোথাও কোথাও পানি জমে থাকে। এছাড়া হাসপাতালে বহিরাংশের উত্তর পাশের দেওয়াল ঘেষে পানি জমে আছে। আছে ময়লার স্তুপও। ফলে মশা বেড়েছে। পরিবেশও দূষণ হচ্ছে।
বিভিন্ন জায়গায় প্লাস্টিকের বোতল, খাবারের প্যাকেট ও পুরনো সামগ্রী পড়ে আছে, যেগুলোতে জমে থাকা পানি মশার ডিম ফোটার আদর্শ স্থান তৈরি করেছে। খোলা ডাস্টবিন থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতাল প্রশাসনের অবহেলায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা করা হয় না, ফগিং কার্যক্রমও নেই বললেই চলে। ফলে সন্ধ্যা নামলেই ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মশার ঝাঁক দেখা যায়।
একজন রোগীর স্বজন বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি, কিন্তু এখানে এসে দেখি মশার ভয়ে ঘুমাতে পারি না। রোগ সারানোর জায়গায় যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে বাইরে মানুষ কোথায় যাবে?

চিকিৎসক ও কর্মচারীরাও ভুগছেন
হাসপাতালের এক নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিদিনই রোগীদের অভিযোগ শুনতে হয়। আমরাও মশার কামড়ে বিরক্ত। কর্তৃপক্ষকে বহুবার জানিয়েছি, কিন্তু স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
চিকিৎসকদের মতে, হাসপাতাল এমন একটি স্থান যেখানে সর্বাধিক পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা উচিত। সেখানে মশার এমন আধিপত্য শুধু ডেঙ্গু রোগীদের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে না, বরং নতুন সংক্রমণের আশঙ্কাও তৈরি করছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালের ভেতরে মশার প্রজননক্ষেত্র গড়ে উঠলে তা জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিতে পারে। এডিস মশা এমনিতেই শহরের বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয়। চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোও নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উচিত নিজেদের অভ্যন্তরে নিয়মিত মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা। শুধু ফগিং নয়, জমে থাকা পানি অপসারণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও জরুরি।’
রোগী ও স্বজনদের দাবি, দ্রুত মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা বলছেন, হাসপাতালে এসে যদি আরও অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি থাকে, তাহলে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কোথায় থাকবে?
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনের যৌথ উদ্যোগে হাসপাতালগুলোতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদার করার দাবি উঠেছে। অন্যথায় ডেঙ্গু মোকাবিলায় অর্জিত সাফল্য আবারও ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মাতুয়াইল শিশু ও মাতৃ-স্বাস্থ্য হাসপাতালের বর্তমান চিত্র যেন এক ভয়াবহ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি—যেখানে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিতে এসে রোগীরাই নতুন করে মশাবাহিত রোগের শিকার হওয়ার শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন।

এবিষয়ে মাতুয়াইল শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মুজিবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দেখুন, শনির আখড়া, জুরাইন, মাতুয়াইল এলাকা ডেঙ্গুর ডেঞ্জার জোন। এটা সরকারও জানে, আমি আপনি সবাই জানি। আমরা আমাদের অবস্থান থেকে মশক নিধনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। সিটি করপোরেশনকে বারবার চিঠি দিয়েছি। তারা কাজ করছে, তবে তা আশানুরূপ নয়।’
পরিচালক বলেন, ‘আমরা ড্রেনেজ লাইন সংস্কারে কাজ করেছি। সেখান থেকে প্রায় ৮০ বস্তা বর্জ্য উত্তোলন করা হয়। মশক নিধনে আমরা সিটি করপোরেশনকে অনুরোধ করেছি। ভিডিওকলেও তাদের আমি বিষয়টি দেখিয়েছি। তারা যতটুকু করেন তা খুবই সামান্য। ধরুন, আমরা ২০০০ মশা মারতে পারি, কিন্তু মশা উৎপাদন হয় দুই লাখ।’
ড্রেনের খোলা ঢাকনার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা বর্জ্য অপসারণের কাজ করছি, তাই না খোলা। কাজ শেষ হলে শিগগির তা বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
এবিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ফোকাল পয়েন্ট অফিসার) ডা. ফারিয়া ফয়েজ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি ভালোভাবে দেখছি। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে মশক নিধনের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীদের কাজের বিষয়ে আমরা খোঁজ খবর নেব। তারা নিয়মিত কীটনাশক ছিটাচ্ছে কি-না সে বিষয়েও তদারকি করব।’
এক প্রশ্নের উত্তরে ফারিয়া ফয়েজ বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের কর বকেয়ার সঙ্গে মশক নিধন সেবার কোনো সম্পর্ক নেই। হাসপাতাল এলাকায় আমরা বিশেষ নজর দেব।’
এমআর/জেবি


















