- হাসপাতালে কাতরাচ্ছে অসংখ্য রোগী
- চিকুনগুনিয়া শনাক্তের কোনো কিট নেই
- ডেঙ্গুতে ২০ রোগীর মৃত্যু, চিকুনগুনিয়ায় নেই
চট্টগ্রাম মহানগরের ঘরে ঘরে মানুষের জ্বর। কাহিল হয়ে হাসপাতালে গেলেই শনাক্ত হচ্ছে হয় ডেঙ্গু, নয় চিকুনগুনিয়া। মারা গেলে বা হাসপাতালে ভর্তি হলেই কেবল তুলে ধরা হচ্ছে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি। বাকি তথ্য থাকছে অন্ধকারে।
বিজ্ঞাপন
এমন দায়সারা দায়িত্ব পালন করছে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের কার্যালয়। সেখান থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতির সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করা হয় গত ২ অক্টোবর বুধবার। ওই দিন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এক কিশোরীর মৃত্যু হয়েছিল। কিশোরিটির নাম জয় তারা (১৬)। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ অক্টোবর বেলা ৩টায় তার মৃত্যু ঘটে।
জানা যায়, চলতি বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ জনে। আর সেদিন পর্যন্ত চট্টগ্রামে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৪১ জনে। এর মধ্যে ৪২৭ জন শিশু, ৭৪৮ জন নারী ও ১ হাজার ৩৩০ জন পুরুষ বলে উল্লেখ করা হয় সিভিল সার্জনের প্রতিবেদনে।
ঠিক একইভাবে চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি নিয়ে সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করা হয় গত ৬ অক্টোবর। যেখানে গত ১ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রায় চার হাজার ১৩৩ জন চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। আর সেই থেকে ২৪ অক্টোবর শুক্রবার পর্যন্ত ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতির কোনো প্রতিবেদন জনসমক্ষে আনা হয়নি।
এদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত অনেক রোগী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এর মধ্যে শুধু চমেক হাসপাতালে ডেঙ্গুর তিনটি কর্নারে চিকিৎসাধীন ৪১৩ জন রোগী। আর চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত চিকিৎসাধীন ৬৪৬ জন রোগী।
বিজ্ঞাপন
একইভাবে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে চিৎিসাধীন দেড় শতাধিক ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগী। এছাড়া চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পার্কভিউ হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতাল, শেভরণ হাসপাতাল, সিএসসিআর, ম্যাক্স হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে আরও সহস্রাধিক ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে।

এর বাইরে বহু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসকদের চেম্বারে গিয়ে প্রাইভেট চিকিৎসা নিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। যারা ল্যাব টেস্ট করালে হয় ডেঙ্গু, নয় চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত হচ্ছে। ডেঙ্গু শনাক্তের কিট নগরীর সবকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে থাকলেও সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকুনগুনিয়া শনাক্তের কোনো কিট নেই। এ সুযোগে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকুনগুনিয়া শনাক্তে ৬-৭ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করছে। এতে চিকুনগুনিয়ার চেয়ে খরচের কষ্টে ভুগছে রোগী ও তাদের স্বজনরা।
চকবাজারের চন্দনপুরা এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, এক সপ্তাহ ধরে আমি জ্বরে ভুগছি। প্রথমে জ্বর, তারপর মাথা ও গিঁটে ব্যথা শুরু হয়। হাসপাতালে ল্যাব টেস্টে ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। পরে চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ে। জ্বর সেরে গেলেও এখনো শরীর দুর্বল আর জয়েন্টে-জয়েন্টে ব্যথা রয়ে গেছে। সংসার চালানোই যেখানে কষ্ট, সেখানে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে পরীক্ষা করানো সত্যিই কঠিন।
নগরীর বাকলিয়া কল্পলোক আবাসিকের বাসিন্দা ওসমান গণি বলেন, চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর পাশাপাশি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে চিকুনগুনিয়া। ৩০০ টাকায় ডেঙ্গু পরীক্ষা করা গেলেও চিকুনগুনিয়া পরীক্ষায় বেসরকারি হাসপাতালে গুণতে হচ্ছে ৬ হাজার টাকারও বেশি। যে অর্থ ব্যয় করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। অনেকে বাধ্য হয়ে পরীক্ষা না করেই কষ্ট সহ্য করে বাড়িতে বসে আছেন
নগরীর সচেতন মহলের ভাষ্য, চট্টগ্রাম মহানগরে ঘরে ঘরে কাতরাচ্ছে জ্বরে আক্রান্ত মানুষ। এর মধ্যে বস্তি এলাকার বাসিন্দা বেশি। যাদের অনেকেই না বুঝে ডাক্তারি পরামর্শ ছাড়াই প্যারাসিটামল ও পেইনকিলার খাচ্ছে। এতে জ্বর কিছুটা কমলেও গিড়ায় গিড়ায় ও মেরুদণ্ডে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। যাদের বেশিরভাগ মানুষ এখন উপার্জন অক্ষম হয়ে পড়েছে।
আর যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে ল্যাব টেস্টে তাদের রক্তে হয় ডেঙ্গু, নয় চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হচ্ছে। এভাবে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া সংক্রমণ বাড়ছে শহরজুড়ে। ফলে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এখন চট্টগ্রামে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আবুল ফয়সাল মো. নুরুদ্দিন চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, এই মৌসুমে প্রচুর ভাইরাস জ্বর হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ রোগীই শেষ পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া পজিটিভ প্রমাণিত হচ্ছেন। পরীক্ষা করাতে না পারায় অনেকেই সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
বিআইটিআইডির অধ্যাপক ডা. মো. মামুনুর রশীদ বলেন, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ভাইরাস ফ্লু-সবই এখন প্রকট। কিন্তু ডেঙ্গুর তুলনায় চিকুনগুনিয়ায় বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঘটনা বাড়লেও চিকুনগুনিয়ায় চট্টগ্রামে কোনো মৃত নেই। তবে চিকিৎসায় আক্রান্তদের জ্বর চলে গেলেও জয়েন্ট ব্যথা ও ফোলা ২-৩ মাস পর্যন্ত থাকছে।

সতর্ক করে তিনি বলেন, জ্বর বা অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিলে নিজে নিজে চিকিৎসা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। জ্বর এলেই ল্যাব টেস্ট করা উচিত। অন্যথায় শরীরে বিপদ ডেকে আনতে পারে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া। মশা নিধন না হলে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ডা. মো. মামুনুর রশীদ।
এদিকে মশক নিধনেও নেই তেমন কার্যকর উদ্যোগ। বিভিন্ন এলাকায় জমে থাকা পানিতে মশার উপদ্রব বাড়লেও ওষুধ ছিটানোর কাজ সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। মশার কামড়ে জর্জরিত নগরবাসীর জীবন। এর মধ্যে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার জন্য নগরীর ২০ হটস্পট শনাক্ত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। সেই সাথে পাঁচটি জায়গাকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ধরা হয়েছে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ৮০ শতাংশ রোগীই এসব এলাকার বাসিন্দা।
এলাকাগুলো হচ্ছে-চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশহর, আগ্রাবাদ, বন্দর, সদরঘাট, ডবলমুরিং, খুলশী, বায়েজীদ, চান্দগাঁও, কোতোয়ালি, ইপিজেড, পাহাড়তলী, চকবাজার, লালখানবাজার, বাকলিয়া, দেওয়ান বাজার, দেওয়ান হাট, ঝাউতলা, আন্দরকিল্লাহ, নাসিরাবাদ, পাঠানটুলী এলাকা।
এর মধ্যে হালিশহর, আগ্রাবাদ, বন্দর, সদরঘাট, ডবলমুরিং এলাকাকে অতিঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সম্প্রতি সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এসব এলাকায় দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে চিঠি দিয়েছে বলে জানান চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মো. মোহাম্মদ তৌহিদুল আলম।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ চলছে। আমরা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত। তবে মানুষকে সচেতন হতে হবে। মশা দমন ও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন এড়িয়ে চলতে হবে।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, ডেঙ্গুর তুলনায় চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের হার বেশি। রোগ নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য বিভাগ ও অন্যান্য সংস্থার সমন্বয় প্রয়োজন। পাশাপাশি মশা নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর উদ্যোগ দরকার।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. সেখ ফজলে রাব্বি ঢাকা মেইলকে বলেন, চিকুনগুনিয়ার জন্য সরকারিভাবে কোনো নির্ধারিত ফি নেই। তবে ডেঙ্গুর মতো একই মূল্য নেওয়া যেতে পারে। কেউ অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।
মশক নিধন কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহী ঢাকা মেইলকে জানান, মশার হটস্পট ধরে ক্রাশ কর্মসূচি চলছে। আমাদের ২১০ জন কর্মী ও ৬টি স্পেশাল টিম কাজ করছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা ১০০ দিনের বিশেষ ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। যে সব এলাকা হটম্পট সেখানে আমরা প্রতিনিয়ত ওষুধ মারছি। নতুন মশার ওষুধ দিয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে মশক নিধক কার্যক্রম চলছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কম আছে। মশার ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং করা হচ্ছে। এছাড়া অসচেতন বাড়ির মালিকদের ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে জরিমানার আওতায়ও আনা হচ্ছে।
আইকে/জেবি


















