শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

‘লোক-দেখানো’ উদ্যোগ থামাতে পারছে না ডেঙ্গুর প্রকোপ

আব্দুল হাকিম
প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৩৪ এএম

শেয়ার করুন:

ovijan
‘লোক-দেখানো’ উদ্যোগ থামাতে পারছে না ডেঙ্গুর প্রকোপ। ছবি: ঢাকা মেইল
  • রাজধানী এখনো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে
  • হাসপাতালগুলোতে আবারও বেড সংকট
  • মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে
  • জলবায়ু পরিবর্তনে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন জটিল
  • বেজমেন্টে লার্ভার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি
  • ডেঙ্গু হলে চ্যাটবটে জানা যাবে করণীয়

ঢাকা শহরের অলিগলি, পাড়া-মহল্লা, অফিস-আদালত, হাসপাতাল—সবখানেই চলে মশক নিধন অভিযান। সিটি করপোরেশনের ফগার মেশিনের ধোঁয়া, কীটনাশক স্প্রে, লার্ভা ধ্বংস, খাল-নালা পরিষ্কার এবং হটলাইনে ফোন করার সুবিধা—সবকিছুই যেন নগরবাসীকে জানানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তবে কি তাই? প্রতিদিনই হাসপাতাল ভর্তি হচ্ছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, মৃত্যুও ঘটছে।


বিজ্ঞাপন


স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, ডেঙ্গু এখনো দেশের জন্য একটি স্থায়ী জনস্বাস্থ্য সমস্যা। ঢাকা শহর ছাড়াও বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর ও সিলেট—সব এলাকায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক।

এদিকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন চালাচ্ছে নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম। ফগার মেশিন দিয়ে রাস্তা ও অলিগলিতে ধোঁয়া দেওয়া হচ্ছে, কীটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে, লার্ভা শনাক্ত করে ধ্বংস করা হচ্ছে। খাল ও নালা পরিষ্কার করা হচ্ছে। হটলাইন নম্বরে ফোন করে মশার উপদ্রবের অভিযোগ জানানো সম্ভব। এছাড়া লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা আরোপের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি দেখাচ্ছে, মশার বংশবিস্তার এখনো অব্যাহত। ফগার ও স্প্রে শুধু একসময় কার্যকর হলেও মশার ডিম ও লার্ভা বিভিন্ন স্থানেই লুকিয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা নির্মূলের কার্যকারিতা সীমিত এবং সমস্যার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

আগারগাঁওয়ের ব্যাংক কর্মকর্তা আনোয়ারুল হক জানান, তিনি সম্প্রতি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কারওয়ান বাজার থেকে মেট্রোরেলে করে বাসায় ফিরি। মনে হয় কারওয়ান বাজারেই মশা আমাকে কামড়াইছে। তবে নিশ্চিত নই, বাসাতেও কামড়াতে পারে।’ ১০ অক্টোবর তার জ্বর শুরু হয়, ১৫ অক্টোবর স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। তিনি পাঁচ দিন বিছানায় পড়েছিলেন। অফিসেও যেতে পারছেন না।

আনোয়ারুল হকের মতো অসংখ্য মানুষ ঢাকা শহরে রয়েছে, যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত। কেউ কেউ নিজ জেলার চিকিৎসার ওপর আস্থা রাখতে না পেরে রাজধানীতে এসেছেন।


বিজ্ঞাপন


ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রচেষ্টা প্রশংসনীয় হলেও তা যথেষ্ট নয়। দুই দশকের বেশি সময় ধরে দেখা গেছে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি অবনতির সময় সরকার সক্রিয় হয়। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় বলছে, তারা মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তাদের কাজ ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রতি বছরই মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের ২০১৯ সালের সমীক্ষা দেখায়, সরকারি হাসপাতালে ন্যূনতম খরচ পাঁচ হাজার টাকার বেশি, বেসরকারি হাসপাতালে খরচ ৫৩ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে। দেশের মানুষ প্রতি বছর এই খরচ বহন করছে।

Ovijan3
অভিযানেও থামছে না ডেঙ্গুর প্রকোপ। ছবি: ঢাকা মেইল

ডেঙ্গুর প্রকোপ নতুন নয়; ২০০০ সালে ঢাকায় বড় আকারে ডেঙ্গু দেখা দেয়। ওই বছর ৫ হাজার ৫৫১ জন আক্রান্ত হন, মারা যান ৯৩ জন। তবে ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত ও মারা যান। আক্রান্ত হন তিন লাখের বেশি, মারা যান এক হাজার ৭০৫ জন। ২৫ বছর পরও ঢাকার মানুষ এখনো ডেঙ্গুর আতঙ্কে রয়েছেন।

ডেঙ্গু সংক্রমণের ধরনও পরিবর্তিত হচ্ছে। এডিস মশার দুই ধরন—এডিস ইজিপ্টাই নগর এলাকায় এবং এডিস অ্যালবোপিকটাস গ্রামীণ পরিবেশে বসবাস করে। কিন্তু আজ প্রায় প্রতিটি উপজেলা সদর শহরের মতো হয়ে গেছে। এ কারণে এডিস মশা ছড়িয়ে পড়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মশার ঘনত্ব বেড়ে গেছে, যা ডেঙ্গুর বিস্তারকে আরও জটিল করে তুলেছে।

আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গুর চারটি ধরন বা সেরোটাইপ রয়েছে—ডেন–১, ডেন–২, ডেন–৩ ও ডেন–৪। একজন মানুষ এক ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে সেই ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। কিন্তু অন্য ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে রোগের তীব্রতা বেড়ে যায় এবং মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যায়। এই ধরনের সেরোটাইপের দ্রুত পরিবর্তন এবং একাধিকবার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে আরও কঠিন করে তুলেছে।

দেশের দক্ষিণে বরগুনা জেলায় এ বছর ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ৮ হাজার ১৬০ জন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, মারা গেছেন ১৪ জন। ঢাকা ছাড়া অন্য কোনো জেলায় এত ডেঙ্গু রোগী হয়নি। তবে সরকারের পরিসংখ্যান সব আক্রান্তকে অন্তর্ভুক্ত করে না। ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর তথ্য সরকারি পরিসংখ্যানে থাকে না। এর ফলে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডেঙ্গু এখন স্থায়ী জনস্বাস্থ্য সমস্যা। জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল মনে করেন, সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে হোক, মরে মরুক। তারা কার্যত কিছুই করেনি। ডেঙ্গু এখন স্থায়ী সমস্যা। ভবিষ্যতে সমস্যা আরও জটিল হবে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকে। তারা কারিগরি সহায়তা এবং করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দেয়। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই পরামর্শ গ্রহণে গুরুত্ব দেয় না। ২০১৭ সালে হু এর পরামর্শককে কৃষ্ণমূর্তি সরকারকে মধ্যবর্তী পরিকল্পনা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৯ সালে ঢাকায় বড় আকারে ডেঙ্গু প্রকোপ দেখা দিলে হু-এর কীটতত্ত্ববিদ বি এন নাগপাল ঢাকায় এসে এডিস মশার চরিত্র এবং জনগণের অংশগ্রহণের গুরুত্বের কথা বলেছিলেন। সেই পরামর্শও কার্যকরভাবে গ্রহণ হয়নি।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, কোনো টোটকা বা ছিটেফোঁটা উদ্যোগে মশকনিধন বা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ আর সম্ভব নয়। এখন দেশজুড়ে সারা বছর ধরে কাজটি করতে হবে। সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মশকনিধনের কাজটিকে সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিতে হবে। পরপর কয়েক বছর কাজ করলে ফল পাওয়া সম্ভব। এর জন্য বড় ধরনের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দরকার। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শুধু ফগার মেশিন, স্প্রে বা জরিমানা যথেষ্ট নয়।

Ovijan2
ফগিংয়ের ধোঁয়ায় নির্মূল হচ্ছে না মশা। ছবি: ঢাকা মেইল 

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় অর্জন হবে। এজন্য প্রয়োজন সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার এবং জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টা। শুধু অভিযান প্রদর্শন করলেই সমস্যা সমাধান হবে না। নগরবাসীকে সচেতন করতে হবে, মশার বসবাসস্থান ধ্বংস করতে হবে, প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে এবং সারা বছর মশক নিধন কার্যক্রম চালাতে হবে। ডেঙ্গু এখন স্থায়ী হয়ে গেছে। ঢাকা ও দেশের অন্যান্য শহর এবং জেলায় এডিস মশার উপস্থিতি রয়েছে। সরকারের সচেতন উদ্যোগ ও নাগরিক অংশগ্রহণ ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাই অভিযান দেখানো হলেও বাস্তবে ডেঙ্গু প্রকোপ বাড়ছেই।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সারা বছর নাগরিক সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি আগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যভাগ পর্যন্ত তা আরও জোরদার করা হয়েছে। প্রচলিত ফগিং-স্প্রে দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়; বরং বৃষ্টির পর প্রতিটি গলি ও আবাসিক এলাকায় কয়েক বিলিয়ন সম্ভাব্য সোর্স থেকে মশা জন্মাতে পারে, যা ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট দুর্বল থাকলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। শুধু ফগিং নয়, বাড়ির বারান্দা, রান্নাঘর, গাড়ির পার্কিং এলাকা, বেজমেন্ট, ছাদ ও ফুলের টবে জমে থাকা পানিতে ডেঙ্গুর জন্ম হচ্ছে। নাগরিকদের অসহযোগিতা এবং বাড়ির বেজমেন্টগুলোতে লার্ভার প্রাচুর্য একটি বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। করপোরেশনের নিজস্ব ও ডিজি হেলথের সহায়তায় পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, বেজমেন্ট এলাকাগুলোতে লার্ভার আধিক্য সবচেয়ে বেশি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে, একমাত্র মশা সার্ভিলেন্স কার্যক্রমের তথ্য প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা হয় এবং তা করপোরেশনের অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী হালনাগাদ করা হয়। নাগরিকদের জন্য অনলাইনে ‘ডেঙ্গু ড্যাশবোর্ড’ চালু করা হয়েছে, যেখানে তারা নিজের এলাকার ঝুঁকির স্তর দেখতে পারবেন—অর্থাৎ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ বা কম ঝুঁকিপূর্ণ কিনা। ড্যাশবোর্ডে সামনের সপ্তাহের সম্ভাব্য বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও তাপমাত্রার পরিবর্তনও জানা যাবে, সঙ্গে ঝুঁকি বাড়লে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনাও থাকবে।

সিটি করপোরেশন আরও জানায়, ডেঙ্গু জ্বর হলে চ্যাটবটের মাধ্যমে করণীয় এবং নিকটস্থ ডেঙ্গু পরীক্ষার স্থান জানতে পারা যাবে। পাশাপাশি ব্যাপক প্রচারাভিযান চালানো হয়েছে। প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীর তথ্য সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, যাতে রোগীর সংখ্যা হঠাৎ কোনো এলাকায় বেড়ে গেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ঢাকা মহানগরে মোট ১৮টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীরা ভর্তি হন। সপ্তাহে দুইবার জরিপ টিম রোগীদের ঠিকানা যাচাই করে সংগ্রহ করে। পরে প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য থাকা ৫৪টি কুইক রেসপন্স টিমকে ওই ঠিকানায় পাঠিয়ে রোগীর বাড়ি ও আশপাশের এলাকা পরিষ্কার করা হয়, অফিস বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঠিকানা থাকলে সেখানেও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গত বছর এ কার্যক্রম চালানো হলেও এ বছর তা আরও সংগঠিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং নির্দিষ্ট সার্ভে টিম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, এই কাজে গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ, সোশ্যাল মিডিয়া ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ইমামদের সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি নার্সারি মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। রিহ্যাবের কাছ থেকে ৬,০০০ আন্ডার-কনস্ট্রাকশন বিল্ডিংয়ের ঠিকানা সংগ্রহ করে সেসব স্থানে অভিযান পরিচালিত হয়েছে। তবে এ বছর এসব বিল্ডিংয়ে লার্ভার পরিমাণ কম পাওয়া গেছে, কারণ নির্মাণ কোম্পানিগুলো এখন সচেতন হয়ে শ্রমিকদের নির্দেশনা দিচ্ছে।

করপোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, উত্তর সিটি করপোরেশন নিজেরাই প্রায় ১৮ হাজার স্কুল পরিষ্কার করেছে। একে পরিচ্ছন্ন সহায়তা হিসেবে দেখা হলে ডেঙ্গু মশার জন্মহার অনেকাংশে কমে আসবে বলে জানানো হয়। এছাড়া ছাদ থেকে আশপাশে ফেলে দেওয়া চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের পাত্র ও আইসক্রিমের কৌটা, পলিথিনসহ অসংখ্য পাত্রে বৃষ্টির পানি জমে কয়েক দিনের মধ্যেই লার্ভা তৈরি হয়। করপোরেশনের পক্ষে প্রতিদিন কয়েক মিলিয়ন সোর্স সংগ্রহ করা অত্যন্ত কঠিন। তবু এ বছর বিশেষ অভিযানে প্রায় এক মেট্রিক টন প্লাস্টিক সোর্স সংগ্রহ করা হয়েছে।

Mosa1
মশা নিধনে বড় বাজেটেও কাজ হচ্ছে না। ছবি: ঢাকা মেইল

ডিএনসিসি জানায়, অনেক বাসায় মানিপ্লান্ট গাছের টবে লার্ভার উপস্থিতি রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে করপোরেশন সচেতন নাগরিকদের দেখিয়ে দিয়েছে এবং লার্ভা ধ্বংসকারী ট্যাবলেট সরবরাহ করেছে, যা গাছের ক্ষতি না করে লার্ভা ধ্বংস করবে। করপোরেশনের চার-পাঁচটি হাসপাতালে মশার ট্র্যাপ বসিয়ে রোগী থেকে রোগী সংক্রমণ রোধের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে বিনামূল্যে ডেঙ্গু চিকিৎসা ও কিট সরবরাহ করা হয়েছে, যা বছরের শুরু থেকেই কার্যকর রয়েছে।

ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। আগে যেখানে বৃষ্টির মৌসুম মূলত জুলাই মাস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকত এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে সামান্য বৃষ্টি হতো, এখন তা শরৎ ও হেমন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে, ফলে এডিস মশার প্রজনন স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হচ্ছে।  জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন বৃষ্টি শুধু জুলাই বা সেপ্টেম্বরেই থামে না, বরং শরৎ ও হেমন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ডেঙ্গু একটি ক্লাইমেটচেঞ্জজনিত সমস্যা, বৃষ্টি হলেই এর বিস্তার রোধ কঠিন হয়ে পড়ে।

এই কর্মকর্তা বলেন, ডেঙ্গু একটি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত রোগ, যা বৃষ্টির সময় দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এডিস মশা জন্মানোর সোর্স কমিয়ে আনা বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ দেশের বর্তমান ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট পরিস্থিতির কারণে যেকোনো ফেলে রাখা পাত্রে সামান্য বৃষ্টির পানিতেই মশার লার্ভা তৈরি হচ্ছে। এ কারণে সোর্স রিডাকশনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এবার দুই ধাপে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এনজিওগ্রাফের সহযোগিতায় মোহাম্মদপুরসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আগস্ট মাস থেকে সোর্স রিডাকশন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, শুধু ফগিং বা কীটনাশক দিয়ে ডেঙ্গু দমন সম্ভব নয়। এক বর্ষায় একটি গলিতেই কয়েক বিলিয়ন সোর্স তৈরি হতে পারে। আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নাগরিক পর্যায়ে বারান্দা, বেজমেন্ট, টব ও ছাদে জমে থাকা পানির সোর্স দূর করা। আমরা এই বছর থেকে আগস্ট মাসে দুই ধাপে সোর্স রিডাকশন করেছি এবং এনজিও সহযোগিতায় মোহাম্মদপুরসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়েছি। করপোরেশনের পক্ষে প্রতিটি সোর্স ধ্বংস করা সম্ভব নয়; পরিচ্ছন্ন সহযোগিতা থাকলে এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া সহজ হবে।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে বছরব্যাপী ধারাবাহিকভাবে মশকনিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। নিয়মিত কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে পুরো বছর জুড়েই ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা দমনে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। করপোরেশনের উদ্যোগের মধ্যে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, লার্ভা ধ্বংস এবং জনসচেতনতা কর্মসূচি গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এডিস মশা এখন শুধু পরিষ্কার পানিতে নয়, অল্প পানি জমলেই বংশবিস্তার করে—এ বিষয়টি মাথায় রেখে জনবহুল অঞ্চলগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতি সপ্তাহে অঞ্চলভিত্তিক বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। প্রশাসকের নির্দেশনায় প্রতিটি অঞ্চল ধারাবাহিক পরিকল্পনার আওতায় পর্যায়ক্রমে কাভার করা হচ্ছে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকাকেন্দ্রিক বিশেষ কর্মসূচিও নিয়মিত পরিচালিত হয়। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে বৃহৎ পরিসরে প্রোগ্রাম আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিটি অঞ্চলে অনুরূপ কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এছাড়া করপোরেশনের নিজস্ব কন্ট্রোল রুম থেকে ৭৫টি ওয়ার্ডের কার্যক্রম প্রতিদিন লাইভ মনিটরিং করা হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের তালিকা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত হওয়ার পর সেগুলো যাচাই-বাছাই করে প্রতিটি রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়, যাতে রোগীর প্রকৃত ঠিকানা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ধানমন্ডি, বেইলি রোডসহ দক্ষিণ সিটির সীমানাভুক্ত এলাকায় বহিরাগত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় প্রকৃত আক্রান্তদের শনাক্ত করতে আলাদাভাবে অনুসন্ধান চালানো হয়। রোগীর মূল বসবাস নিশ্চিত করে সংশ্লিষ্ট ঠিকানার আশপাশে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় এবং প্রায় ২০০ মানুষকে সচেতনতার আওতায় আনা হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফারিয়া ফয়েজ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা সিটি করপোরেশন হিসেবে বছরব্যাপী নিয়মিত একটি কাজের ধারা বজায় রাখি। আমাদের পুরো বছরজুড়েই ডেঙ্গু মশাসহ অন্যান্য মশা নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রম চলে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করি, যার মধ্যে পরিষ্কার-পরিছন্নতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

এই কর্মকর্তা বলেন, আগে মনে করা হতো, শুধু পরিষ্কার পানিতে ডেঙ্গু মশার লার্ভা তৈরি হয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সামান্য পানি জমলেই লার্ভা তৈরি হতে পারে। এ কারণে আমরা বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে প্রতিটি অঞ্চলে লার্ভা ধ্বংস ও মশা নিধনে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। প্রতিটি সপ্তাহে ডিএসসিসি প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আমরা অঞ্চলভিত্তিক প্রোগ্রাম পরিচালনা করি। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে আমাদের বিভাগগুলো কাজ করে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ মিলিতভাবে একটি বড় প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ রকম প্রতিটি অঞ্চলে আমাদের কর্মসূচি চলমান রয়েছে।

Mosa2
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই। ছবি: ঢাকা মেইল

নিয়মিত কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করে ডা. ফারিয়া ফয়েজ বলেন, মশকনিধন কার্যক্রমের পাশাপাশি আমরা প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের তালিকা যাচাই করি। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আমরা ফোনের মাধ্যমে রোগীর ঠিকানা নিশ্চিত করি, কারণ দক্ষিণ সিটির এলাকায় বিশেষ করে ধানমন্ডি বা বেইলি রোড এলাকায় বাহিরের জেলার মানুষ চিকিৎসার জন্য এসে হাসপাতালে ভর্তি হয়। ঢাকার বাইরে থেকে যারা আত্মীয়ের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে আসে, তাদের প্রকৃত ঠিকানা নিশ্চিত করতে আমরা ‘ওয়ান টু ওয়ান’ যোগাযোগ করি। যদি তারা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত হন, তাহলে তাদের বাসার আশেপাশে আমরা প্রায় ২০০ মানুষের মধ্যে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করি এবং লার্ভা ধ্বংস ও মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করি।

চিকিৎসকরা বলছেন, পাবলিক লেভেলে মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য মশারি ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। সকালবেলা বা সন্ধ্যার দিকে ঘুমানো শিশুদের মসকিউটো বাইটের সম্ভাবনা বেশি। বাড়ির আশেপাশের মশা থেকেও সংক্রমণ হতে পারে। ফুলের টব, ফ্রিজের নিচে জমে থাকা পানি পরিষ্কার রাখলে মশার প্রজনন কমে। সিটি করপোরেশনের মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার করা এবং নাগরিক সচেতনতা বাড়ালে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক কমে। জ্বর হলে প্রথম থেকেই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া ও প্রচুর তরল গ্রহণ জরুরি। লেবুর শরবত, চিনি-লবণ দিয়ে শরবত, স্যালাইন বা ডাবের পানি—এগুলো সারাদিনে ১৫-১৬ গ্লাস খেলে জটিলতা কমে। ডেঙ্গু এমন একটি রোগ যার বেজ লিমিট নেই। শিশু, বয়স্ক ও কর্মক্ষম সবাই আক্রান্ত হতে পারে। সতর্কতা মেনে দুই-চার দিন বিশ্রাম নিলে জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. প্রফেসর মো. আসিফ মাসুদ চৌধুরী ঢাকা মেইলকে বলেন, এখন যদি ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা যায়, তাহলে এটি সবচেয়ে ভালো উপায়। পাবলিক লেভেলে যেমন মশার কামড় থেকে বাঁচা—সেটি হলো মশারি ভালোভাবে ব্যবহার করা। সকালবেলা বা সন্ধ্যার দিকে ঘুমানো শিশুদের মসকিউটো বাইটের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। বাড়ির আশেপাশের মশা থেকেও সংক্রমণ হতে পারে। এছাড়া আশেপাশের আবাসস্থল, যেমন ফুলের টব বা ফ্রিজের নিচে জমে থাকা পানি পরিষ্কার রাখলে মশার প্রজনন অনেকাংশে কমে আসে।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সিটি করপোরেশনের উদ্যোগের মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার এবং নাগরিকরাও সচেতন থাকলে মশার বিস্তার কমে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপও উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। জ্বর হলে প্রথম থেকেই সতর্কতা মেনে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও প্রচুর তরলজাতীয় খাবার গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। লেবুর শরবত, চিনি-লবণ দিয়ে তৈরি শরবত, স্যালাইন, ডাবের পানি—এসব দিয়ে সারাদিন ১৫-১৬ গ্লাস তরল খেলে রোগের জটিলতা অনেক কমে।

ডা. আসিফ মাসুদ চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু এমন একটি রোগ যার বেজ লিমিট নেই। বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্ক এবং কর্মক্ষম মানুষরা আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষত যারা কাজের চাপ নিয়ে সহজে বিশ্রাম নিতে পারছে না, তাদের জন্য সতর্ক থাকা জরুরি। জ্বর হলে প্রথম দিনেই ডেঙ্গু টেস্ট করা যায় এবং সতর্কতা মেনে দুই-চার দিন বিশ্রাম নিলে জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

এএইচ/জেবি

 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর