শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সময়মতো চিকিৎসা না নেওয়ায় ডেঙ্গুতে বাড়ছে প্রাণহানি

সাখাওয়াত হোসাইন
প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৫৫ পিএম

শেয়ার করুন:

dengue
ডেঙ্গুতে বাড়ছে প্রাণহানি। ছবি: ঢাকা মেইল

সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহতা কমছেই না। শহর থেকে গ্রাম সবখানেই ডেঙ্গু এখন ‘অপ্রতিরোধ্য’। মশাবাহিত এই জ্বর প্রতিনিয়ত কেড়ে নিচ্ছে একের পর এক প্রাণ। আক্রান্ত মানুষের সারিও দীর্ঘ হচ্ছে। সময় যত যাচ্ছে, ডেঙ্গুর ছোবল তত ভয়ংকর হয়ে উঠছে।

চিকিৎসা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতাই ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জ্বর হলে অনেকেই তা হালকাভাবে নেন, টেস্ট করেন না। কেউ কেউ জানেনই না, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন কি না। আবার অনেকে গুরুতর পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত চিকিৎসকের কাছে যান না। ফলে চিকিৎসা বিলম্বিত হয়, বাড়ে জটিলতা।


বিজ্ঞাপন


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টেস্ট করার পাশাপাশি এই রোগের সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যা সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা না বাড়লে মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব নয়।

কখন কী ধরনের চিকিৎসা

চিকিৎসকেরা বলছেন, ডেঙ্গু হলে কী ধরনের চিকিৎসা নিতে হবে-তা নির্ভর করে রোগীর অবস্থার ওপর। ডেঙ্গু জ্বরের তিনটি ধরন বা ক্যাটাগরি আছে। ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’।

‘এ’ পর্যায়ের রোগীদের সাধারণত শুধু জ্বর থাকে, তারা বেশিরভাগ সময় বাসায় থেকেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। চিকিৎসকের পরামর্শে বিশ্রাম ও পানি গ্রহণই যথেষ্ট।


বিজ্ঞাপন


‘বি’ পর্যায়ের রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগতে পারে। বিশেষ করে যাদের পেটে ব্যথা, বমি, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, গর্ভাবস্থা, কিডনি বা লিভারের সমস্যা রয়েছে।

‘সি’ পর্যায়ের ডেঙ্গু সবচেয়ে জটিল। এ পর্যায়ে লিভার, কিডনি কিংবা মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অনেক সময় আইসিইউ সেবা প্রয়োজন হয়।

Dengu-won1

রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আফসানা বেগম বলেন, ‘ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণ জ্বর। ৯৯ থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠতে পারে। একটানা জ্বর থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেওয়ার পর আবারও আসতে পারে। এর সঙ্গে শরীরে ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ বা ফুসকুড়ি দেখা যায়।’

ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪ ধরন

চিকিৎসকেরা বলছেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন আছে। সেগুলো হলো ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪। একটি ধরনে একবার আক্রান্ত হলে মানুষের শরীরে সেই ধরনটির প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে, মানুষ দ্বিতীয়বার সেই ধরনে আর আক্রান্ত হয় না। ডেন-১-এ আক্রান্ত ব্যক্তি আর কখনো ডেন-১ দ্বারা আক্রান্ত হবে না।

তবে বাকি তিনটি ধরনে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তবে কোনো ব্যক্তি প্রথমবার একটি ধরন দিয়ে আক্রান্ত হওয়ার পর দ্বিতীয়বার যদি অন্য ধরন দিয়ে আক্রান্ত হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির জটিলতা বাড়ে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডেন-১-এ আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পর ডেন-২ বা ডেন-৩ বা ডেন-৪ দ্বারা আক্রান্ত হলে জটিলতা বাড়ে।

নতুন উপসর্গে ডেঙ্গু

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই রোগে এবার বেশিরভাগ মৃত্যু হচ্ছে শক সিনড্রোমে, যেখানে রোগীর শরীরে দ্রুত রক্তচাপ ও অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে যায়, ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট বা তরল ব্যবস্থাপনায় জটিলতা তৈরি হয়। এতে পানিশূন্যতা দেখা দেয় এবং রোগী অচেতন হয়ে পড়তে পারেন।

D-C1

শক সিনড্রোম ও হেমোরেজিক ফিভার, এ দুই ধরনের সমস্যা নিয়েই রোগীরা যাচ্ছেন হাসপাতালে। বেশিরভাগ শক সিনড্রোমের রোগী রাজধানীতে আসছেন বাইরের জেলাগুলো থেকে।

চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ হলো ধরনে পরিবর্তন। ডেঙ্গুর সাধারণ উপসর্গগুলোর সঙ্গে মানুষ পরিচিত হলেও নতুন উপসর্গগুলো অনেকের কাছে অজানা। ফলে অনেক রোগী বিপদ বুঝতেই দেরি করেন। ফলে বাড়ে প্রাণহানির সংখ্যা।

সেজন্য কারও জ্বর হলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপণ্ন হতে হবে। মানুষ সচেতন না হলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

ডেঙ্গু মশা সাধারণত চৌকির নিচে, পর্দার ভাঁজে, বেসিনের নিচে লুকিয়ে থাকে। পাঁচ দিনের কম সময় জমে থাকা পরিষ্কার পানিই এর বংশবিস্তার ক্ষেত্র।

নর্দমা, ডোবায় জমে থাকা ময়লা পানি, নদী, সাগর, বিলের পরিষ্কার বহমান পানি নয়, এই মশা বংশবিস্তার করে ফুলের টবের নিচের পানিতে, বৃষ্টির দিনে রাস্তার ধারে জমা পানি, নির্মাণসামগ্রীতে থাকা পানি, পেপসির ক্যান, নারিকেলের খোলায় জমা পানিতে।

তাই প্রতিদিন সকাল বা সন্ধ্যায় ঘরে মশা নিধনের স্প্রে করাসহ ফুলের টব ও পাত্রের পানি নিয়মিত ফেলে দেওয়া, এবং মশারি ব্যবহার করাই সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ। কোচিং সেন্টার, অফিস বা চেম্বারে ফুলহাতা জামা ও মোজা পরা অভ্যাস করা উচিত। দিনের বেলায় মশারি টানিয়ে ঘুমানোর পরামর্শ দেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, ‘এ বছরের ডেঙ্গু এক ভিন্ন মাত্রা নিয়ে হাজির হয়েছে। ডেঙ্গুকে নিয়ে এখন নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। এখন এটি শুধু মৌসুমি কোনো রোগ নয়, আবার ঢাকাকেন্দ্রিকও নয়। তাই এর প্রতিরোধে চিরাচরিত পদ্ধতি পাল্টে নতুন ধারা সৃষ্টি করতে হবে।’

Mosa2

রাজধানীর টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আয়েশা আক্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। গত ২৫ বছরের ডেঙ্গুর অভিজ্ঞতা হলো, আগাম বৃষ্টি হলে ডেঙ্গু একটু আগে শুরু হয়। শেষ হয় তাড়াতাড়ি। আবার দেরিতে বৃষ্টি হলে ডেঙ্গুর বিস্তৃতি আরও বাড়ে। তবে কম-বেশি অভিজ্ঞতা হলো, বৃষ্টির মৌসুমে অর্থাৎ জুন থেকে প্রকোপ বাড়তে থাকে। আর তা সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের দিকে কমে আসে। এর মধ্যে কিছু কিছু বছর ব্যতিক্রমও হয়।’

আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তারিকুল ইসলাম লিমন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ডেঙ্গু হলে আতঙ্কিত না হয়ে যথেষ্ট বিশ্রাম নিতে হবে। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল খেতে হবে। প্রচুর পানি, ডাবের পানি, খাবার স্যালাইন, ফলের রস খেতে হবে। নিজে থেকে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বা ব্যথানাশক খাওয়া যাবে না। মনে রাখবেন, জ্বর সেরে ওঠার সময়টুকুতে বেশি সাবধান থাকতে হবে। কারণ, এ সময়ই জটিলতাগুলো দেখা দিতে থাকে। তাই জ্বর কমার সঙ্গে সঙ্গে কাজে যোগ দেওয়া যাবে না। বাড়িতে নিয়মিত রক্তচাপ মাপতে হবে।’

তারিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘মাথা ঘোরা, চোখে অন্ধকার দেখা, দুর্বল লাগা রক্তচাপ কমে যাওয়ার লক্ষণ। মনে রাখবেন, পালস প্রেশার ২০–এর নিচে মানে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের দিকে মোড় নিচ্ছে। প্লাটিলেট এক লাখের নিচে নামলে বা হিমাটোক্রিট পরিবর্তন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, ৫০ হাজারের নিচে নামলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হলে প্লাটিলেট দিতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এ ধরনের ডেঙ্গুতে প্লাজমা লিকেজ হয় (প্লাজমা শিরার বাইরে বেরিয়ে আসে)। তাই সতর্কতার সঙ্গে স্যালাইন ব্যবহার করতে হয়। এ জন্যই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দরকার। এ ছাড়া অনেক বমি, শরীরের যেকোনো জায়গায় রক্তপাত, রক্তচাপ কমে গিয়ে দুর্বল অনুভব করা, প্রচণ্ড পেটব্যথা, অতিরিক্ত অস্থিরতা ও অস্বাভাবিক আচরণ, হাত-পা শীতল হয়ে আসার লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে।

এসএইচ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর