সোমবার, ৩১ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

কে এই ভয়ংকর প্রতারক মিনহাজ, যেভাবে ফেলতেন ফাঁদে

বোরহান উদ্দিন 
প্রকাশিত: ২৭ মার্চ ২০২৫, ০২:৩৬ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

কখনো নিজেকে দেশে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিতেন। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের উপদেষ্টা হিসেবেও পরিচয় দিতেন। আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে বলে পরিচয় দিয়ে বিএনপি নেতাদের বড় পদ দেয়ার আশ্বাস দেওয়া শুরু করেন। 

শুধু তাই নয়, দাবি করেন, দল চালানোর পরামর্শও তারেক রহমান তার থেকে নেন। সরকারি চাকরিতে ভালো পোস্টিং, পদোন্নতি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে হাতিয়ে নিতেন টাকা। এই সব পরিচয় একা বহন করা মানুষটির নাম আশরাফুজ্জামান ওরফে মিনহাজ।


বিজ্ঞাপন


অথচ এসব পরিচয়ের সবই ভুয়া। তবে স্ত্রী সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় এতদিন অনেকটা নির্বিঘ্নে প্রতারণা করে এসলেও এবার আর শেষ রক্ষা হয়নি মিনহাজের। নানা পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে নিজেকে অত্যন্ত প্রতাপশালী হিসেবে জাহির করা প্রতারক মিনহাজকে বুধবার (২৬ মার্চ) রাতে শরিয়তপুরের নড়িয়া থেকে আটক হয়েছেন।

487384459_1008156840755054_6782065456677514041_n

বৃহস্পতিবার (২৭মার্চ) সকালে মিনহাজকে আটকের বিষয়টি জানা গেছে। নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর একটি টিম তাকে আটক করেছে বলে জানতে পেরেছি। তবে এখনও থানায় হস্তান্তর করা হয়নি।

জানা গেছে, মিনহাজ নতুন নতুন কায়দায় প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নিতেন। কখনো নিজেকে পরিচয় দেন কানাডার ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক। আবার কোথাও বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। বর্তমানে নিজেকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর দাবি করছেন। 


বিজ্ঞাপন


শুধু তাই নয়, কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন টুড্রোর পলিসি অ্যাডভাইজার, ট্রাম্পের ইলেকশন ক্যাম্পেইন কমিটির সদস্য, পলিসি মেকার ও অ্যাডভাইজার টু সজীব ওয়াজেদ জয়— এসব পরিচয়ও দিয়ে বেড়াতেন মিনহাজ।

নিজেকে বিত্তবান পরিচয় দিতে সুইস ব্যাংকে ৫৫ মিলিয়ন ডলার গচ্ছিত আছে বলেও দাবি করতেন এই প্রতারক। এই প্রতারকের বাড়ি নোয়াখালীর মিরওয়ারিশপুর। 

যেভাবে উত্থান প্রতারক মিনহাজের 

জানা গেছে, আশরাফুজ্জামান নামের এই প্রতারকের উত্থান ২০০৮ সালে। ২০০৯ সালে সাহারা খাতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আগেই তার পরিবারের এক সদস্যকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেন মিনহাজ। এরপর ২০০৯ সালে সাহারা খাতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর তার পরিবারের জামাই পরিচয় দিয়ে সচিব, পুলিশ, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রভাবশালীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিতে শুরু করেন তিনি।

অভিযোগ আছে, নিজে পুলিশ, আমলা ও বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে মামলায় ফেলে আবার মামলা থেকে বাঁচানোর নামে ভুক্তভোগীর পরিবার থেকে টাকা আদায় তার প্রধান পেশা হয়ে ওঠে। এ ছাড়া কর্মকর্তাদের বিপদে ফেলেও টাকা নেন তিনি। 

জানা গেছে, প্রতারণা করতে যখন যাকে প্রয়োজন তাকে ব্যবহার করতেন মিনহাজ। পরিবারের জামাই পরিচয় ব্যবহার করার ঘটনা জানতে পেরে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন একসময় গ্রেফতার করে তাকে কারাগারেও পাঠিয়েছিলেন।

ক্ষমতার খুঁটি হিসেবে পাশে পান সরকারি কর্মকর্তা স্ত্রী

অভিযোগ আছে, বিসিএস ক্যাডার স্ত্রীর প্রভাব দেখিয়ে ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে মিথ্যা মামলার আসামি করে আবার ভুক্তভোগীদের সহযোগিতার কথা বলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই তার মূল পেশা।

485208585_1365530401538024_6425527055847652788_n

সম্প্রতি প্রতারক মিনহাজ ও তার স্ত্রীর এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগও জমা পড়েছে।

জানা গেছে, বর্তমানে তার স্ত্রী পর্যটন মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন। নরসিংদীতে থাকাবস্থায় স্ত্রীর প্রভাবে নিজেকেও সরকারি কর্মকর্তা মনে করে দাপট দেখাতেন মিনহাজ। পরবর্তীতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে যোগ দেওয়ার পর বিভিন্ন অভিযানে স্ত্রী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেড হিসেবে কাজ করতেন। সঙ্গে থাকতেন মিনহাজ। অভিযান শেষে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আর্থিক সুবিধা নিতেন মিনহাজ।

শুধু তাই নয়, স্ত্রীর ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে মিনহাজের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার অভিযোগ আছে। এসব অভিযানে হুমকি ধামকি দিয়ে চাঁদা নিতেন মিনহাজ।

486457111_1706276853306276_6940709158817853196_n

তার স্ত্রী নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষে কর্মরত থাকাবস্থায় নিয়মিত অফিস করতেন না এমন অভিযোগও আছে। তবে যেদিন অভিযান থাকত সেদিন তিনি অফিস করতেন।

অবশ্য এই সরকারি কর্মকর্তা গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে প্রথমে প্রতারক মিনহাজকে চেনেন না বলে দাবি করেন। অবশ্য সম্প্রতি সচিবালয়ে নিজ দফতরে বসে তাদের একান্ত কিছু ছবি দেখানোর পর স্বামী হিসেবে স্বীকার করলেও এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলতে অপারগতা জানান এই সিনিয়র সহকারী সচিব।

এদিকে বাবার ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ সার্টিফিকেট ব্যবহার করে মিনহাজের স্ত্রী কোটায় সরকারি চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

মিনহাজ থেকে নেতাকর্মীদের দূরে থাকতে বলেছে বিএনপি 

এদিকে মিনহাজের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের টেলিফোন আলাপ ভাইরাল হয়েছে। তাতে আলালকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করতে তারেক রহমানকে বলবেন বলে আশ্বাস দেন মিনহাজ। কথার যাদুতে ফেলে মোয়াজ্জেম হোসেন আলালও পদ পেতে তার ওপর ভরসা রাখার কথা জানান।

নিজেকে এই পদের জন্য যোগ্য করে করেন বলেও টেলিফোন আলাপে তাকে বলতে শোনা যায়।

কীভাবে মিনহাজের ফাঁদে পা দিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলার এফআইআর এ সব বলা হয়েছে। নতুন করে কিছু বলার নেই। দলের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে।’

আরও পড়ুন-

শেষ রক্ষা হলো না ভয়ংকর প্রতারক সেই মিনহাজের

এদিকে মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) আশরাফুজ্জামান মিনহাজের সঙ্গে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সম্পর্ক না রাখার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ আহ্বান জানানো হয়।

এতে বলা হয়, ‘দুর্ধর্ষ এক প্রতারকের নাম আশরাফুজ্জামান মিনহাজ’ শিরোনামে একটি সংবাদের প্রতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। সংবাদটিতে বলা হয়েছে যে, আশরাফুজ্জামান মিনহাজের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সখ্যতা রয়েছে, এমনটি দাবি করে বিভিন্ন অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন মিনহাজ। তার এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, মূলত আশরাফুজ্জামান মিনহাজ একজন প্রতারক ও ধান্দাবাজ। বিভিন্ন স্থানে প্রতারণার মাধ্যমে অপকর্ম করে বেড়ানোই তার মূল পেশা। কথিত আশরাফুজ্জামান মিনহাজের সঙ্গে বিএনপি ও এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সম্পর্ক না রাখার জন্য অনুরোধ করা হলো।

এদিকে মিনহাজকে নিয়ে চারিদিকে আলোচনার ঝড় ওঠার পর প্রতারণার শিকার অনেকে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। মিনহাজের কাছ থেকে চাকরি কিংবা ভালো পোস্টিংয়ের আশ্বাস পেয়েছেন এমন একজন বিচারকের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা মেইলের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই বিচারক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘গণমাধ্যমে লেখালেখির কারণে হয়তো এই প্রতারক আমাকে খুঁজে পেয়েছে। হঠাৎ একদিন আমাকে মেইল করে নানা বিষয়ে কথা বলেন। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দেন। হঠাৎ একদিন জানতে চান ভালো কোথাও পোস্টিং চাই কি না। কিছু খরচ করতে পারলে সে আইনমন্ত্রীকে বললেই ঢাকা কিংবা পছন্দের জেলায় পোস্টিং করাতে পারবেন বলেও আশ্বাস দেন। আমি সে ফাঁদে পা দিইনি। গত সপ্তাহেও আমাকে মেইল করেছে।’

পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অনেক আগে ফেসবুকে যে কোনোভাবে আমার বন্ধু তালিকায় যোগ হয় এই মিনহাজ। কিন্তু শুরুর দিকেই তার কথাবার্তা সুবিধার মনে হয়নি। পদোন্নতি, পোস্টিংয়ের ব্যবস্থা করা নিয়ে কথা বলতো। পরে তাকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছি।’

বিইউ/ইএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন