শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

মহাসড়ক দখল করে রমরমা মাছের ব্যবসা!

মহিউদ্দিন রাব্বানি
প্রকাশিত: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৬:৪৮ এএম

শেয়ার করুন:

loading/img
রাস্তা দখল করে চলছে মাছের ব্যবসা। ছবি: ঢাকা মেইল
      • ভোর থেকেই অর্ধেকের বেশি সড়ক দখল
      • দোকান বসানোর সঙ্গে জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালীরা
      • মাছের আঁশ-রক্ত-পানি সড়কে, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ
      • নির্বিকার থানা পুলিশ ও সিটি করপোরেশন

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা থেকে কাজলা পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশ দখল করে চলছে রমরমা মাছের ব্যবসা। ভোর থেকে প্রায় দুপুর পর্যন্ত এই এলাকায় মহাসড়কের অর্ধেকের বেশি দখলে থাকে শত শত মাছ ব্যবসায়ীর। ফলে যাত্রাবাড়ী থেকে মহাসড়কের কাজলা, শনির আখড়া, রায়েরবাগ হয়ে মাতুয়াইল মেডিকেল এলাকা পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হয়। এছাড়া বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তানসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকাতেও এখানকার যানজটের প্রভাব পড়ে। এতে সকালে অফিসগামী কর্মজীবী ও শিক্ষার্থীদের গন্তব্যে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়। 


বিজ্ঞাপন


পুলিশের নাকের ডগায় মহসড়ক দখল করে মাছ ও সবজির ব্যবসা করলেও নির্বিকার যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। নেই ট্রাফিক শৃঙ্খলা। দীর্ঘ সময় মাছের ডালা নিয়ে বসে থাকে ব্যবসায়ীরা। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচেও বসে শতাধিক মাছ কাটা ও বরফের দোকান। এতে মাছের পানি ও রক্তের দুর্গন্ধে এই পথে চলা দায়। এতে বরফ গলা পানিতে ভিজে যায় সড়ক। স্যাঁতস্যাঁতে নোংরা পানি ও দুর্গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। নাক টিপে, কাপড় উপরে তুলে কোনো মতে যাতায়াত করেন পথচারীরা।

পাশাপাশি আড়তের বর্জ্য ও পানি ফেলা হচ্ছে রাস্তার ওপর। আড়তগুলোর ফেলানো আবর্জনা ও দুর্গন্ধে পুরো এলাকায় দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও পথচারীরা অভিযোগ করেন, সড়কের ওপর এই মাছ বাজারের কারণে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এলাকার পরিবেশও দূষিত হচ্ছে। এছাড়া প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।

সরেজমিনে দেখা যায়, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের সামনে থেকে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের পূর্ব মাথা পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের ওপর তিন শতাধিক পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা মাছ বিক্রি করছেন। একইভাবে এই সড়কের দক্ষিণ পাশে মাছ বিক্রি করছেন আরও শতাধিক বিক্রেতা। ক্রেতাদের উপস্থিতিও প্রচুর, বরং সে তুলনায় মূল আড়তেই ক্রেতা-বিক্রেতা কম। মানুষের চাপে উভয় পাশে সড়কে লেগে থাকে তীব্র যানজট।

Fisher2

পিকআপ চালক সেলিমা মিয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মাছ বাজার বসায় রাস্তায় গাড়ি চলাচল করতে অনেক কষ্ট হয়। একদিকে রাস্তা ভাঙা তার ওপর বসে মাছ বাজার। গাড়ি হর্ন দিলেও সাইড দিতে চান না মাছ ব্যবসায়ীরা। এজন্য অনকে সময় মাছ ব্যবসায়ীদরে সঙ্গে ঝগড়া ও হাতাহাতরি ঘটনা ঘটে।’

নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা অনাবিল পরিবহনের চালক খোকন বলেন, ‘কী আর বলবো ভাই! রাস্তা দখল করে দোকান দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। কেউই তো কিছু বলে না। দিন দিন দোকান সংখ্যা বাড়ছেই। সামনে মনে হয় পুরো রাস্তাই বন্ধ হয়ে যাবে। শনির আখড়া থেকে যাত্রাবাড়ী পৌঁছাতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগছে।’

এক চা দোকানি জানান, ভোর থেকে শত শত মাছবাহী পিকআপ আসে। এখানেই মাছ নামানো হয়। ফলে পুরো সড়ক ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায়। পথচারীরা স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে যাওয়ার কোনো উপক্রম থাকে না। এছাড়া হাঁটাচলা করার সময় মাছের পানি ছিটা কিংবা গায়ে কাঁদা লাগবেই। 

রাহেলা খাতুন নামে মধ্যবয়সী এক নারী আসেন বাজারে। তিনি বলেন, অন্যান্য বাজারের তুলনায় এখানে কিছুটা দাম সাশ্রয়ী। যার ফলে অনেক ক্রেতাই এখানে এসে ভিড় জমায়। কিন্ত রাস্তার ওপর দোকান বসায় চলাচল করতে অসুবিধা হয়। এছাড়া হেঁটে যাওয়ার সময় মাছের পানি গায়ে এসে পড়ে কাপড় নষ্ট হয়ে যায়।

যাত্রাবাড়ীর  মাছের আড়তদার মনসুর আলী বলেন, যাত্রাবাড়ী থেকে কাজলা পর্যন্ত রাস্তার মাঝে ভাঙা রয়েছে। গাড়িতে উঠলে ভয়ে থাকি, কখন উল্টে যায়। তিনি আরও বলেন, বৃষ্টি হলেই সড়কের প্রায় পুরো অংশ তলিয়ে যায়।

সড়কে দোকান দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা তো টাকার বিনিময়ে ব্যবসা করেন। তারা তো ভাড়া দিচ্ছে। এখন কে পাচ্ছে আর কে পাচ্ছে না সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। আগের সরকারের লোকজন দোকান থেকে চাঁদা তুলত। এখনো বিভিন্ন গ্রুপ মাঝে মাঝে আসে। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জ্যোৎস্না আহমেদ বলেন, কাজলা সড়কটি নোংরা আবর্জনায় ভরপুর। রাস্তায় দোকান বসায় জ্যাম লেগে থাকে। ফলে সময় মতো ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে কষ্ট হয়ে যায়। আশা করি কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, সড়কের ওপর মাছের দোকান বসানোর সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল জড়িত। তাদের কারণেই তা উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। তবে পুলিশ সহযোগিতা করলে পাঁচ মিনিটেই এসব অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করা সম্ভব।

চেষ্টা করাও আড়ৎ সমিতির কারও সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। তাদের অফিসেও কাউকে পাওয়া যায়নি।

Fisher3

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন ভোররাত থেকেই নিজ নিজ আড়তের সামনের সড়ক দখল করে পাইকারি দোকান বসান মালিকেরা। তারাই আবার ফ্লাইওভারের নিচে মাছ কাটা ও বরফের দোকান বসিয়েছেন। আর বাইরের দোকানদারদের আড়ৎ সমিতি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও পুলিশকে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। 

এবিষয়ে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান তালুকদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যাত্রাবাড়ীতে সড়কের ওপর মাছ, ফল ও সবজির দোকান বসার ফলে রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যায়- এমনটি আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমি নিজেও একদিন কয়েকজনকে উঠিয়ে দিয়েছি।’

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বস্ত করেন। তবে এখানে আড়তের একটা অংশ ইজারা আছে বলে জানান তিনি। 

জুলাই অভ্যুত্থানের পর সড়ক দখল কিংবা বাণিজ্য চলতে পারে না বলে মন্তব্য করেন নাগরিক সমাজের মুখপাত্র বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ। মুঠোফোনে আলাপকালে তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যানজটের অন্যতম কারণ হচ্ছে অবৈধ সড়ক দখল। এমনতেই যানজটে নাভিশ্বাস যাত্রীদের। এর ওপর দোকানপাট আরও সংকীর্ণ করে ফেলেছে সড়ক। ফলে মারাত্মক রূপ নেবে যানজটে।’

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে এসব দখলদারিত্বের সঙ্গে কারা জড়িত বা কারা উপকারভোগী তাদের চিহ্নিত করা এবং ব্যবস্থা নেওয়া।’

এমআর/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন

এই ক্যাটাগরির আরও খবর


News Hub