যানজটের নগরী ঢাকায় স্বস্তির বাহন হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে মেট্রোরেল। নিয়ম অনুযায়ী মেট্রো স্টেশনের নিচের অংশ যাত্রী চলাচলের জন্য পুরোপুরি ফাঁকা থাকবে। তবে রাজধানীর তিনটি মেট্রো স্টেশনের নিচে পাঁচ শতাধিক অস্থায়ী দোকান বসেছে। মেট্রো চলাচল শুরুর পর থেকে এসব দোকান বেড়েই চলেছে। চলতি রমজান উপলক্ষে দোকানের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এসব দোকানে ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে যাত্রী চলাচলে অসুবিধা যেমন হয় তেমনি নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন নগরবাসী।
স্টেশন ঘিরে এসব দোকান থেকে প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকার বেশি চাঁদাবাজি হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যাত্রীরা জানান, মিরপুর ১০ ও ১১ মেট্রো স্টেশনের নিচে সবচেয়ে বেশি হকারের উৎপাত। এই দুই স্টেশনে ওঠা ও নামার সময় দোকানের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাড়াহুড়ার সময় দ্রুত যাওয়া যায় না। আবার ছিনতাইকারীদের ভয়ে সাবধানেও চলাফেরা করতে হয়।
বিজ্ঞাপন
দোকানিরা জানান, মেট্রো স্টেশন হওয়ার আগেও এসব জায়গায় দোকান ছিল। স্টেশন চালু হওয়ার পর আবার দোকানিরা বসতে শুরু করেন। তবে এর জন্য তাদের নির্দিষ্ট ভাড়া দিতে হয়। এখান থেকে নিয়মিত ভাড়া তোলেন স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও তাদের ক্যাডাররা। ভাড়া না দিয়ে এখানে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। ভাড়ার টাকা থেকে পুলিশ ও মেট্রোর আনসার সদস্যরাও ভাগ পান বলে জানা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, উত্তরা থেকে মতিঝিল রুটের ১৬টি স্টেশনের মধ্যে তিনটি স্টেশনের নিচে অস্থায়ী দোকান বসানো হয়েছে। মিরপুর ১১, মিরপুর ১০ ও বাংলাদেশ সচিবালয়- এই তিন স্টেশনে পাঁচ শতাধিক দোকান রয়েছে। সবচেয়ে বেশি দোকান রয়েছে মিরপুর ১০ স্টেশনে। এখানে দুই পাশের সিঁড়ি, লিফট ও নিচের পুরো জায়গাজুড়ে ৩০০টির মতো অস্থায়ী দোকান রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ সচিবালয় ও মিরপুর ১১ স্টেশনের নিচে শতাধিক দোকান রয়েছে।
ইউসুফ আহমেদ নামের এক যাত্রী বলেন, ‘মিরপুর ১০ মেট্রো স্টেশনে নামলে ভয়ে থাকি। কখন যেন ছিনতাইকারী এসে মোবাইল বা ম্যানিবাগ নিয়ে দৌড় দেবে। কিছুদিন আগে আমার বন্ধুর একটি মোবাইল হারিয়ে গেছে এই স্টেশন থেকে। এটার পর থেকে বেশি ভয়ে থাকি। স্টেশনের এই ঘিঞ্জি ভাব দূর করতে সব অস্থায়ী দোকান দ্রুত সরানো উচিত।’
বিজ্ঞাপন
এই যাত্রী বলেন, ‘আগে শুধু মিরপুর ১০ স্টেশনের নিচে দোকান ছিল। কিন্তু দেখার কেউ না থাকায় আরও বিভিন্ন স্টেশনে দোকানের সংখ্যা বাড়ছে। দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে স্টেশনগুলোতে যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়বে।’
ইশতিয়াক হোসেন নামের আরেক যাত্রী বলেন, ‘রাজধানীর সবচেয়ে ভালো বাহন হলো মেট্রোরেল। কিন্তু মেট্রো স্টেশনের নিচে প্রতিনিয়িত অস্থায়ী দোকান বাড়ছে। এসব সাধারণ যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য বাধা। সবার স্বার্থে মেট্রো স্টেশন আরও বেশ নিরাপদ ও হকারমুক্ত রাখতে হবে।’
যেভাবে দোকান দখল ও চাঁদাবাজি
স্থানীয়রা জানান, মেট্রো স্টেশনের নিচে যে কেউ চাইলেই দোকান বসাতে পারেন না। এখানে দোকান বসানোর জন্য প্রথমে স্পেস থাকা সাপেক্ষে ফাঁকা জায়গা নির্বাচন করতে হবে। তারপর সেখানে দোকান বসানোর দুই থেকে চার দিনের মধ্যেই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার ক্যাডার পরিচয়ে একজন ভাড়া আদায়ে চলে আসবেন। তারপর ওই ব্যক্তির সঙ্গে বোঝাপড়া করে ব্যবসা পরিচালনার অলিখিত একটা চুক্তি হয়। এর জন্য আশেপাশের দোকানিরাও সহযোগী হিসেবে যুক্ত হন।
মেট্রো স্টেশনের নিচের জায়গাগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ৫ আগস্টের আগে সেটা করতেন আওয়ামী লীগের নেতারা। পরবর্তী সময়ে এখন এর সঙ্গে বিএনপির নেতারা জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই চাঁদাবাজিতে ভাগ পান পুলিশ ও আনসার সদস্যরাও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনটি স্টেশনের ৫০০ দোকান থেকে প্রতি মাসে ২-৩ হাজার করে চাঁদা আদায় করা হয়। এই তিন স্টেশন থেকে সব মিলিয়ে মাসে ১০ লাখের বেশি টাকার চাঁদাবাজি হয়।
মিরপুর ১০ স্টেশনের একজন অস্থায়ী দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখানে দোকান দেওয়ার জন্য আগে ফাঁকা জায়গা পেতে হবে। জায়গা পাওয়ার পর আশপাশের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবসা শুরু করা যায়। কিন্তু ব্যবসা শুরুর পর ভাড়া দিতে হয়। স্থানীয় দখলদাররা মেট্রোর জায়গা দখল করে নিয়েছে। তাদের ভাড়া না দিয়ে দোকান পরিচালনা সম্ভব নয়। একটি ছোট দোকান পরিচালনার জন্য মাসে দুই থেকে তিন হাজার টাকা দিতে হয়। এসব টাকার ভাগ শুধু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা নয় বরং আনসার ও পুলিশ সদস্যরাও পায়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক দোকানি বলেন, ‘আমি প্রথমে মিরপুর ১১তে ব্যবসা শুরু করি। শুরুর এক সপ্তাহে কেউ কোনো কিছু দাবি করেনি। কিন্তু এক সপ্তাহ পর স্থানীয় একজন এসে জায়গা তার দাবি করেন এবং মাসে দুই হাজার টাকা ভাড়া দিলে ব্যবসা করতে দেবেন। ভাড়া টাকা না দিলে কোনোভাবে ব্যবসা পরিচালনা সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়েই ব্যবসা করছি।’
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক এ কে এম খায়রুল আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের কোনো ম্যাজিস্ট্রেট নেই, তাই এসব অবৈধ দোকানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছি না। আমরা ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছি, পেলেই দ্রুত ব্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া আমাদের এমআরটির যে পুলিশ আছে তাদের দিয়ে অস্থায়ী দোকানগুলোর বিরুদ্ধে প্রাথমিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পুলিশ চাঁদার টাকার ভাগ নেয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে একটা লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে৷’
জেবি