মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

দূষণে নাকাল রাজধানীবাসী, বাড়ছে রোগ-বালাই

সাখাওয়াত হোসাইন
প্রকাশিত: ১৭ মার্চ ২০২৫, ১১:১৫ এএম

শেয়ার করুন:

loading/img

শিশু শামীমা সুলতানার বাসা রাজধানীর মোহাম্মদপুরে। শ্যামলীর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালে তাকে নিয়ে এসেছেন মা সুরাইয়া আক্তার। তিনি ঢাকা মেইলকে জানান, শামীমা কয়েক দিন ধরে তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগছে। প্রাথমিক চিকিৎসাও নিয়েছে, তাতে কাজ হয়নি। তাই সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। শামীমা এর আগে দুইবার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল। শিশুটির এমন অবস্থার জন্য চিকিৎসকরা ঢাকার পরিবেশ ও বায়ুদূষণকে দায়ী করেছেন বলে জানান সুরাইয়া। 

শুধু শামীমা সুলতানাই নয়, ঢাকায় বসবাসরত অনেকেই পরিবেশের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে শিশুদের রোগ-বালাই বাড়ছে। সময় যত গড়াচ্ছে, ততই বাড়ছে এখানকার শব্দ ও বায়ুদূষণের মাত্রা। এতে নিউমোনিয়া, অ্যাজমাসহ শ্বাসকষ্টজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।


বিজ্ঞাপন


স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিদরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তন, ওজোন স্তর হ্রাস, বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয়ের কারণে সৃষ্ট দূষণ আর তীব্র তাপদাহের কারণে মানুষের মধ্যে কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। বায়ুদূষণে অ্যাজমা, নিউমোনিয়ার মতো রোগীর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। তাছাড়া মাথাব্যথা ও মাথা ঘোরা, গর্ভপাত, জন্মত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশেও বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বায়ুদূষণ। শব্দদূষণ মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে। যত্রতত্র দেওয়া হচ্ছে হর্ন, নিয়ন্ত্রণে নেই দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ। যার কারণে বাড়ছে বধিরতাসহ নানা রোগ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যত্রতত্র নির্মাণকাজ, যানবাহন, কলকারখানার ধোঁয়া—এসব যেমন ঢাকার বায়দূষণের কারণ, তেমনি রাজধানীর বাইরের শহরেও বায়ুদূষণের জন্য এই নিয়ামকগুলোই দায়ী। বায়ু ও শব্দদূষণ একাধিক রোগের কারণ। আর সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয় শিশুরা। এসব উৎস বন্ধে কড়া পর্যবেক্ষণ দরকার। আর দরকার মানুষকে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা। এসব করার কথা পরিবেশ অধিদফতর এবং স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর। কিন্তু ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে।

বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখের কারণে। কিন্তু সারা বিশ্বে এধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ। শহরাঞ্চলে এই দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। দূষণের কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুসারে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমেছে সাত বছর। আর রাজধানীবাসীর গড় আয়ু কমছে আট বছর করে।


বিজ্ঞাপন


রাজধানী শ্যামলীর ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতালের রোগীর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে দ্বিগুণ বেড়েছে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়াসহ কয়েকটি রোগের রোগীর সংখ্যা। ২০২০ সালে আউটডোরের সেবা নিয়েছেন ৩৭ হাজার ১৬৪ জন রোগী আর ২০২৪ সালে নিয়েছেন এক লাখ ৩৩৬ জন রোগী। আর ইনডোরে ২০২১ সালে সেবা নিয়েছেন ২১ হাজার একজন রোগী আর ২০২৪ সালে নিয়েছেন চার হাজার ৩৫৪ জন রোগী। যার বেশিরভাগ বায়ুদূষণজনিত কারণে নিউমোনিয়া, অ্যাজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত।

যা বলছেন চিকিৎসকরা
জানতে চাইলে শ্যামলীর ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার ঢাকা মেইলকে বলেন, বায়ুদূষণের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যের বেশি ক্ষতি হচ্ছে। পাশাপাশি পরিবেশও দূষিত হচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন হয়। এর ফলে শীতকালে ঠিক মতো শীত হচ্ছে না, গরমের সময় প্রচণ্ড তাবদাহ থাকে। ছয় ঋতুর দেশ। বর্ষাকালেও তেমন বৃষ্টি হচ্ছে না। এর ফলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে মানুষই। 

এই চিকিৎসক বলেন, আগের তুলনায় জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে অনেক বেড়েছে অ্যাজমা, নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা। আমরা শ্বাস নিচ্ছি বাতাস থেকে। বাতাসে যখন অক্সিজেনের পরিবর্তে কার্বন ডাই-অক্সাইডের বেশি হয় তখন আমাদের ফুসফুস আক্রান্ত করে, হার্টের রোগ হয়, কিডনি বিকল হচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশও ঠিক মতো হচ্ছে না।

আয়েশা আক্তার বলেন, শব্দদূষণের একটি মাত্রা আছে। মাত্রা বেশি হলে মানবদেহে নানা ক্ষতি হয়। উন্নত দেশে শব্দদূষণের মাত্রা কম এবং কোনো কোনো দেশে শব্দদূষণই নেই। আর শব্দদূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় শিশুদের। তাদের বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত করে শব্দদূষণ। ঠিক মতো মানসিক বিকাশও হয় না। তাতে ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতি হচ্ছে। শিশুরা ঠিকমতো বেড়ে না উঠলে সমাজের জন্য বোঝা হবে। 

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আব্দুস সবুর ঢাকা মেইলকে বলেন, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে নানাভাবে। যত্রতত্র বিল্ডিং বানানো এবং বিল্ডিং বানানোর সময় পরিবেশ সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা না নেওয়া এর অন্যতম কারণ। সেইসঙ্গে ইটের ভাটা পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করছে। আর এই বায়ুদূষণের ফলে ট্রাফিক পুলিশ, রিকশাওয়ালাসহ যারা পাবলিক প্লেসে কাজ করেন, তারা বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।

বায়ুদূষণ রোধে করণীয়
অধ্যাপক ডা. আব্দুস সবুর ঢাকা মেইলকে বলেন, বায়ু যাতে দূষণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং সচেতন থাকতে হবে। বাতাস হচ্ছে, ধুলাবালি উড়ছে। এখন যদি পানি ছিটানো যায়, তাহলে বায়ুদূষণের মাত্রা কমে আসবে। এটি করতে হবে কর্তৃপক্ষকে। সেইসঙ্গে জনবহুল এলাকা থেকে ইটের ভাটা উচ্ছেদ করে দিতে হবে। যেসব গাড়ি থেকে বেশি ধোঁয়া বের হয়, সেগুলো বের করা যাবে না। আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে  যতটুকু সুরক্ষিত থাকা যায়, ততটুকু চেষ্টা করতে হবে। যাতে শরীরে ধুলা কম প্রবেশ করে।

ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ রোধ করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করা যাবে না। বাহিরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। গাড়ি চালানোর সময় প্রয়োজন ছাড়া হর্ন দেওয়া যাবে না। উচ্চ স্বরে মাইক বাজানো যাবে না।

এসএইচ/জেবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

টাইমলাইন