অবশেষে ৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিত হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক জাকসু (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচন। কিন্তু বহুদিন পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনের স্বচ্ছতা, সুষ্ঠুতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার আগ থেকে একের পর এক অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও অভিযোগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পুরো প্রক্রিয়া। নির্বাচনের দিনে অন্তত পাঁচটি প্যানেল ভোট ও ফলাফল বর্জন করেছে। ভোটের পরিবেশ নিয়েও উঠেছে তীব্র সমালোচনা।
নির্ধারিত সময় সকাল ৯টায় ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ২০ থেকে ৩০ মিনিট দেরিতে শুরু হয় ভোট। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কিছু হলে পোলিং এজেন্টদের উপস্থিত না থাকা এবং টেবিল ও এটেনডেন্স শিট প্রস্তুত করতে দেরি হওয়ায় ভোটগ্রহণে বিলম্ব হয়। তবে ভোট শুরুর পরপরই নানা অনিয়মের অভিযোগ সামনে আসতে থাকে।
বিজ্ঞাপন
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হলে প্রায় ২৫ মিনিট ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, ভোটদানে আসা শিক্ষার্থীদের আঙুলে অমোচনীয় কালি ব্যবহার করা হচ্ছিল না। আবার কালি লাগানো হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তা মুছে যাচ্ছিল। এতে একাধিকবার ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে রিটার্নিং কর্মকর্তার আশ্বাসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় এবং ভোটগ্রহণ আবার শুরু হয়।
ভোটগ্রহণকালে অন্যতম আলোচিত ঘটনা ঘটে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে। দুপুরের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল সমর্থিত ভিপি প্রার্থী শেখ সাদী হাসানসহ অন্তত ১৫ জন নেতাকর্মী নারী হলে প্রবেশ করে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তোলেন। এতে হলের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা হল প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানালে, দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ভোটগ্রহণ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। ওই সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, কালি সহজেই মুছে যাচ্ছিল, তাই জালিয়াতির আশঙ্কা ছিল প্রবল। পরে নতুন কালি আসার পর ভোটগ্রহণ পুনরায় শুরু হয়।
হলের প্রাধ্যক্ষ সহযোগী অধ্যাপক শামীমা নাসরীন জলি জানান, কালি নিয়ে সমস্যা হওয়ায় সাময়িকভাবে ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু অনুমতি ছাড়া কিছু ব্যক্তি হলে ঢুকে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। তিনি আরও বলেন, ভোট জালিয়াতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
শুধু এই একটি হলেই নয়, শহীদ রফিক-জব্বার হলেও ভোট জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, ভোট দিতে গিয়ে তিনি দেখতে পান, ভোটার তালিকায় তার নামের পাশে ইতোমধ্যে কেউ স্বাক্ষর করে ভোট দিয়ে গেছে। এছাড়া জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলে কার্যকরী সদস্য হিসেবে তিনজনকে ভোট দেওয়ার কথা থাকলেও ব্যালটে একজনের নাম ছিল।
বিজ্ঞাপন
এদিকে ভোটার তালিকায় প্রার্থীদের ছবি না থাকায় একাধিক শিক্ষার্থী দাবি করেন, এটি জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে। আবার অনেক হলে অতিরিক্ত ব্যালট পেপার পাঠানো হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এমনকি বেশ কিছু কেন্দ্রে ভোটার অনুপাতে বুথের সংখ্যাও ছিল কম, ফলে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।
ব্যালট ও ওএমআর শিট ছাপানোর দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ‘এইচআরসফট বিডি’ নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির মালিক রকমনুর জামান রনি বিএনপি ঘনিষ্ঠ। তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার নানা ছবি রয়েছে। এসব তথ্য সামনে এনে শিবিরপন্থী প্যানেলের প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের দাবি, যখন এমন বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যালট ছাপানো হয়, তখন নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া বেশ কয়েকটি প্যানেল দুপুর থেকেই অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিতে শুরু করে। সবচেয়ে আগে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় ছাত্রদল সমর্থিত ‘সাদী-বৈশাখী-সাজ্জাদ পরিষদ’। এরপর ভোট বর্জন করে ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ ‘সংশপ্তক পর্ষদ’। বিকেলে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় আরও কয়েকটি প্যানেল—‘সমপ্রীতির ঐক্য’, ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’, ‘সজীব জেনিচ ফ্রন্ট’-এর আংশিক প্যানেল।
ছাত্রদল প্যানেলের পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বরাবর ৯টি নির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়। অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল, পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া, প্রার্থীদের ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে বাধা, ভোট চলাকালে লিফলেট বিতরণ, কিছু হলে বিদ্যুৎ না থাকা অবস্থায় ভোটগ্রহণ, অমোচনীয় কালি ব্যবহার না করা, ভোটার তালিকায় ছবি না থাকা, অতিরিক্ত ব্যালট সরবরাহ, নির্দিষ্ট কেন্দ্রগুলোতে বুথের সংখ্যা কম থাকা, এবং ব্যালটে অসম্পূর্ণ প্রার্থী তালিকা।
ছাত্রদলের জিএস পদপ্রার্থী তানজিলা হোসাইন বৈশাখী বলেন, আমাদের বিজয় ব্যাহত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে এক হয়ে নির্বাচনী কারসাজি করেছে। শিক্ষার্থীদের প্রকৃত রায়ের প্রতিফলন এই নির্বাচনে ঘটেনি। তাই আমরা নির্বাচন বর্জনে বাধ্য হয়েছি।
অন্যদিকে শিবির সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী মাজহার ইসলাম বলেন, সকাল থেকেই আমরা ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছি। নানা ধরনের অপপ্রচার করা হচ্ছে আমাদের বিরুদ্ধে। তবে ভোট বর্জন করাটা প্রত্যেকের গণতান্ত্রিক অধিকার।
নির্বাচনের নানা অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে রাতে ফল বর্জনের ঘোষণা দেন জাতীয়তাবাদী ঘরানার তিন শিক্ষক—নজরুল ইসলাম, নাহরীন ইসলাম এবং শামীমা সুলতানা লাকী। বাংলা বিভাগের শিক্ষিকা শামীমা বলেন, শিক্ষার্থীদের বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি সুন্দর নির্বাচন দেখার। কিন্তু এই নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ব্যর্থ। ব্যালট বাক্স সময়মতো পাঠানো হয়নি, ব্যবহৃত কলমের কালি ছিল টেকসই নয়। ফলে এসব অনিয়ম নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
নির্বাচন কমিশন অতিরিক্ত ব্যালট পেপার ছাপানোর ব্যাখ্যায় জানিয়েছে, ব্যালট পেপার নষ্ট হতে পারে। এই আশঙ্কায় মোট ভোটারের ১০ শতাংশ অতিরিক্ত ব্যালট ছাপানো হয়েছে। কিন্তু প্যানেলগুলোর দাবি, এই অতিরিক্ত ব্যালটই জাল ভোট বা কারচুপির সুযোগ করে দিয়েছে।
দিনভর ক্যাম্পাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি থাকলেও তা বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে খুব একটা কার্যকর ছিল না বলে মনে করছেন অনেকেই। ক্যাম্পাসজুড়ে ছিল চরম উত্তেজনা, অনিশ্চয়তা এবং অভিযোগের ঘূর্ণিপাক।
এইউ



























