রমজানকে বলা হয় সাইয়িদুশ শুহুর বা সকল মাসের সেরা মাস। এ মাসের প্রত্যেকটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। রমজানের রোজা ফরজ এবং এর এতটাই ফজিলত যে মহান আল্লাহ এর পুরস্কার নিজ হাতে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম। রোজা শুধু আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দেব।’ (মুসলিম: ২৭৬০)
‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে রমজানের একটি রোজা ভঙ্গ করবে, সে আজীবন সেই রোজার (ক্ষতিপূরণ) আদায় করতে পারবে না।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৯৮৭৮)
রোজা অবস্থায় মাসিক আরম্ভ হলে বা ঋতুস্রাব (হায়েজ) ও প্রসবোত্তর স্রাব (নেফাস) দেখা দিলে রোজা ভেঙে যাবে। তবে সক্ষম হলে ওইদিন রোজার সম্মানার্থে ইফতার পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা ভালো। পরে এ রোজা কাজা আদায় করে নেবেন। যারা উপযুক্ত ওজরের কারণে রোজা রাখতে পারবেন না, তারা রমজানের সম্মানার্থে অন্যদের সামনে পানাহার করবেন না। এটা তাকওয়ার পরিচায়ক। (সুরা হজ: ৩২)
অনুরূপভাবে রমজানে দিনের বেলায় নারীদের মাসিক বা ঋতুস্রাব বন্ধ হলে, সেদিনের অবশিষ্ট সময় পানাহার থেকে বিরত থাকবেন। এটি রোজার সম্মানে, রোজা হিসেবে নয়। এ দিনের রোজা আদায় করতে হবে। পরদিন থেকে রোজা পালন করবেন। এমতাবস্থায় নারীরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবেন, সবার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করতে পারবেন। রান্নাবান্না করা, দোয়া-দরুদ পড়া, তাসবিহ-তাহলিল—সবই স্বাভাবিকভাবে করবেন। সেহরি-ইফতারেও শরিক হতে পারবেন।
আরও পড়ুন: বিয়ের উদ্দেশ্যে প্রেম করা জায়েজ?
ঋতুমতী নারীরা কি রোজার সওয়াব পাবেন?
বরকতের মাসে হায়েজের কারণে অনেকে চাপা কষ্ট অনুভব করেন। না, এতে কষ্ট পাওয়ার বা হতাশ হওয়ার কারণ নেই। ইসলাম এমন অবকাশ রাখেনি যে, ইবাদতে অন্যরা তাদের পেছনে ফেলে দেবে। বৈধ কারণে নারীর ইবাদতে বিঘ্ন ঘটলে, ইবাদত না করেও ইবাদতের সমান সওয়াব বলে হাদিসে এসেছে। সহিহ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘কেউ অসুস্থ হলে অথবা সফরে থাকলে তেমন সওয়াবই পাবে, যেমনটা সে সুস্থ অবস্থায় বা সফরে না থাকা অবস্থায় পেতো।’ (বুখারি: ২৯৯৬)
বিজ্ঞাপন
এই বিধান পিরিয়ডকালীন নারীদের জন্যও প্রযোজ্য। কারণ, বৈধ কারণেই তিনি রোজা রাখতে অপারগ হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ইবনে হাজার (রহ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো আমল এমনিতে করতো, কিন্তু সাধ্যাতীত হওয়ায় পারেনি, সে ব্যক্তির ক্ষেত্রে হাদিসটি প্রযোজ্য’।
পিরিয়ড বন্ধের ওষুধ খাওয়া জায়েজ?
মেডিকেল সায়েন্সের সুবাদে আমরা জানি যে, এক ধরনের পিল বা ওষুধ আছে, যা সেবন করলে পিরিয়ড বিলম্বিত করা যায়। এ ধরণের ওষুধ ও চিকিৎসা রাসুল (স.)-এর সময়েও ছিল। কিন্তু নবী (স.) কখনও এমন ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেননি; আবার নিষেধও করেননি। তাই এ বিষয়ে ফকিহদের মত হলো, ডাক্তারের পরামর্শে নারীর পিরিয়ড বিলম্বিত করার পিল খাওয়া বা ওষুধ ব্যবহার করা নাজায়েজ নয়।
তবে, পিল খাওয়া থেকে যথাসাধ্য দূরে থাকা উত্তম। কারণ, এতে নারীর দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যা তৈরির আশঙ্কা থাকে। সুতরাং এক্ষেত্রে আল্লাহর ফায়সালা মেনে নিয়ে রোজা ছেড়ে দেওয়া এবং পরে কাজা আদায় করাই উত্তম।
আরও পড়ুন: হাদিসের আলোকে ‘নেককার স্ত্রী’ চেনার উপায়
তবে যেসব ওষুধে ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই, সেগুলো ডাক্তারের পরামর্শে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশেষ করে হজ ও ওমরার সফরে ব্যবহার করা যায়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-কে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, ‘সফর থেকে ফেরা পর্যন্ত মাসিক থেকে মুক্ত থাকতে পারবে— এমন ওষুধ নারী ব্যবহার করতে পারবে? তিনি বললেন, আমি এতে কোনো অসুবিধা মনে করি না। অতঃপর তিনি বললেন, এক্ষেত্রে পিলুর পানি খুবই উপকারী।’
মাসিক শুরু হওয়ার আগে ওষুধ খেলে যতক্ষণ পিরিয়ড শুরু না হবে, ততক্ষণ নারী পবিত্র বলে গণ্য হবে। এ দিনগুলোতে নামাজ, রোজা আদায় করতে হবে। কোরআন তেলাওয়াত, তাওয়াফ, সহবাস ইত্যাদিও করা যাবে। আর পিরিয়ড শুরু হওয়ার পরে ওষুধ খেয়ে বন্ধ করলে পবিত্র বলে গণ্য হবে না; তখন মাসিকের সর্বনিম্ন সীমা তিন দিন পর্যন্ত— নামাজ, রোজা, তাওয়াফ ও সহবাস ইত্যাদি সব নিষেধ। সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। (সূত্র: মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ১/৩১৮; খোলাসাতুল ফতোয়া: ১/২১৩; হিন্দিয়া: ১/৩৮; আল-মুগনি: ১/৪৫০)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর নারীদেরকে দ্বীনের সকল বিষয়ে সঠিক বুঝ দান করুন। প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার তাওফিক দান করুন। রমজানের বরকত ও পূর্ণ সওয়াব ঋতুমতী নারীদেরও দান করুন। আমিন।