শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

শহীদের মৃত্যুযন্ত্রণা হয় কি?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৬:৪১ পিএম

শেয়ার করুন:

শহীদের মৃত্যুযন্ত্রণা হয় কি?

প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তবে মুমিনের মৃত্যু আর অন্যদের মৃত্যু এক রকম নয়। আবার শহীদি মৃত্যু এবং অন্য মৃত্যুতে রয়েছে বিস্তর ফারাক। কোরআন-সুন্নাহর বর্ণনা অনুযায়ী, মৃত্যুর কষ্ট সবাইকে ভোগ করতে হবে। তবে শহীদের মৃত্যু খুব সহজ হবে এবং আল্লাহর কাছে শহীদের আলাদা মর্যাদা রয়েছে। 

মৃত্যুযন্ত্রণা সবাইকে ভোগ করতে হবে
মৃত্যু যেমন অনিবার্য, মৃত্যুর যন্ত্রণাও অবধারিত। অবধারিত মৃত্যুযন্ত্রণার প্রতি ইঙ্গিত করে ইরশাদ হয়েছে, ‘জীব মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে’ (সুরা আলে ইমরান: ১৮৫)। আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যই আসবে। এটা হতে তোমরা অব্যাহতি চেয়ে এসেছ।’ (সুরা কাফ: ১৯)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। নিশ্চয়ই মৃত্যুর যন্ত্রণা অনেক কঠিন।’ (সহিহ বুখারি: ৬৫১০)


বিজ্ঞাপন


কোরআনের বর্ণনায় মৃত্যুর সময় কার যন্ত্রণা কেমন হবে
পবিত্র কোরআনের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় মুমিন ও পাপী সবাই মৃত্যুযন্ত্রণার শিকার হবে। পাপীদের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি যদি দেখতে পেতে ফেরেশতারা অবিশ্বাসীদের মুখমণ্ডল ও পিঠে আঘাত করে তাদের প্রাণহরণ করছে এবং বলছে, তোমরা দহনযন্ত্রণা ভোগ করো।’ (সুরা আনফাল: ৫০)

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘যদি তুমি দেখতে পেতে যখন অবিচারকারীরা মৃত্যুযন্ত্রণায় থাকবে এবং ফেরেশতারা হাত বাড়িয়ে বলবে, তোমাদের প্রাণ বের করো। তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে অন্যায় বলতে ও তাঁর নিদর্শন সম্পর্কে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে। সে জন্য আজ তোমাদের অবমাননাকর শাস্তি দেওয়া হবে।’ (সুরা আনআম: ৯৩) উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ তাআলা অবিশ্বাসী, অস্বীকারকারী ও পাপিষ্ঠদের মৃত্যুযন্ত্রণার স্বরূপ তুলে ধরেছেন।

অন্যদিকে একজন মুমিনের মৃত্যুর দৃশ্য এভাবে তুলে ধরা হয়েছে—‘তাকে বলা হলো- জান্নাতে প্রবেশ করো। সে বলে উঠল, হায় আমার সম্প্রদায় যদি জানতে পারত—কীভাবে আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিত করেছেন।’ (সুরা ইয়াসিন: ২৬-২৭)

শহীদের মৃত্যু ও মর্যাদা
সবচেয়ে কম মৃত্যুযন্ত্রণা হবে শহীদের। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমাদের কাউকে পিঁপড়া কামড়ালে যতটুকু কষ্ট অনুভব করো, শহীদের নিহত হওয়ার কষ্ট তার চেয়ে বেশি হবে না।’ (সুনানে নাসায়ি: ৩১৬১)
স্বয়ং নবীজি (স.) শহীদি মৃত্যুর তামান্না করতেন। ইরশাদ হয়েছে, ওই সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! আমার বড় ইচ্ছে হয়, আমি আল্লাহর রাস্তায় নিহত হব। আমাকে জীবিত করা হবে, আবার আমি নিহত হব। পুনরায় আমাকে জিন্দা করা হবে এবং আমি আবার আল্লাহর রাস্তায় জীবন বিলিয়ে দেব। (সহিহ বুখারি: ৭২২৬)
শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে এক হাদিসে এসেছে, শহীদ আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে ছয়টি বড় পুরস্কার পাবে। 
১) তাকে তৎক্ষণাৎ ক্ষমা করে দেওয়া হবে এবং তাকে তার জান্নাতি নিবাস দেখানো হবে।
২) কবরের আজাব মাফ করে দেওয়া হবে ।
৩) হাশরের ময়দানে যখন ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই সন্ত্রস্ত ও পেরেশান থাকবে, তখন আল্লাহ পাক তাকে সেই পেরেশানি ও বিভীষিকা থেকে মুক্ত রাখবেন।
৪) সেদিন তার মাথায় এমন একটি সম্মাননা মুকুট পরানো হবে, যার একেকটি হীরা ও মুক্তা দুনিয়া ও তার সব কিছু থেকে দামী।
৫) স্ত্রী হিসেবে তাকে ৭২ জন হুর দান করা হবে।
৬) তার নিকটজনদের মধ্যে হতে ৭০ জনের ব্যাপারে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। (সুনানে তিরমিজি: ১৬৬৩)


বিজ্ঞাপন


অন্য হাদিসে এসেছে, ‘ঋণ ব্যতীত শহীদ ব্যক্তির সমস্ত গুনাহ আল্লাহ তাআলা মাফ করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম: ১৮৮৬)

মুমিনের মৃত্যুকষ্টের কারণ
একাধিক বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত মৃত্যুর সময় মহানবী (স.)-এর শারীরিক কষ্ট হয়েছিল। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখেছি একটি পানিভর্তি বাটি তার সামনে রাখা ছিল। তিনি সেই বাটিতে তার হাত প্রবেশ করাচ্ছিলেন এবং পানি দিয়ে তার মুখমণ্ডল মলছিলেন। আর বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ, মৃত্যুকষ্ট ও মৃত্যুযন্ত্রণা হ্রাসে আমায় সহায়তা করুন।’ (সুনানে তিরমিজি: ৯৭৮)

কিন্তু মুমিনের কেন মৃত্যুর সময় কষ্ট হয়। এর উত্তর হচ্ছে—মৃত্যুযন্ত্রণার মাধ্যমে মুমিনের মর্যাদা বাড়ানো হয়। এ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) আয়েশা (রা.)-এর কাছে উপস্থিত হন। তখন তাঁর এক নিকটতম প্রতিবেশী মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছিল। নবী (স.) তাকে চিন্তিত দেখে বলেন, ‘তোমার প্রতিবেশীর কারণে তুমি চিন্তিত হয়ো না। কেননা এটা সৎকর্মগুলোর অন্তর্ভুক্ত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৪৫১)

এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, মুমিনের মৃত্যুযন্ত্রণা তার মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ যখন কোনো মুমিনের জন্য কোনো মর্যাদার স্তর নির্ধারণ করেন এবং নিজ আমল দ্বারা যদি তা অর্জন করতে না পারে, তখন আল্লাহ তাঁর শরীর বা তাঁর সম্পদ অথবা তাঁর সন্তানদের বিপদগ্রস্ত করেন। অতঃপর মুমিন ধৈর্যধারণ করার ফলে সে পূর্বনির্ধারিত মর্যাদার স্তরে পৌঁছে যায়।’ (সুনানে আবি দাউদ: ৩০৯০)

শহীদ কত প্রকার
শহীদি মৃত্যু দুই প্রকার। এক প্রকার হলো প্রকৃত শহীদ। তা হলো, দ্বীন কায়েমের জন্য কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জীবন দেওয়া। এ ধরনের শহীদের মর্যাদা অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বুঝ না।’ (সুরা বাকারা: ১৫৪)

এই প্রকার শহীদের মর্যাদা সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, রাসুল (স.) বলেছেন, ‘জান্নাতে প্রবেশের পর আর কেউ দুনিয়ায় ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা করবে না, যদিও দুনিয়ার সব জিনিস তাঁকে দেওয়া হয়। একমাত্র শহীদ ছাড়া, সে দুনিয়ায় ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা করবে যেন ১০ বার শহীদ হতে পারে। কেননা সে শাহাদাতের মর্যাদা দেখেছে।’ (বুখারি: ২৮১৭)

আরেক প্রকারের শহীদ হলো, হুকমি। অর্থাৎ তারা শহীদের সাওয়াবপ্রাপ্ত হবেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় নিহত (শহীদ) হওয়া ছাড়াও আরও সাত ধরনের শহীদ আছে— ১. মহামারিতে মৃত্যুবরণকারী শহীদ। ২. পানিতে মৃত্যুবরণকারী শহীদ। ৩. পক্ষাঘাতে মৃত্যুবরণকারী শহীদ। ৪. পেটের রোগের কারণে (কলেরা, ডায়রিয়া ইত্যাদিতে) মৃত্যুবরণকারী শহীদ। ৫. অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকারী শহীদ। ৬. কোনো কিছুর নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণকারী শহীদ এবং ৭. যে মহিলা গর্ভাবস্থায় মারা যাবে সেও শহীদ।’ (আবু দাউদ: ৩১১১)

উল্লেখ্য, শহীদের মর্যাদা পাওয়ার জন্য অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর প্রতি ঈমান থাকা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এভাবে আল্লাহ তোমাদের মধ্যকার ঈমানদার জেনে নেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোককে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে চান।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৪০)

যে দোয়ায় মৃত্যুযন্ত্রণা হালকা হয়
মৃত্যুশয্যায় মহানবী (স.) মৃত্যুযন্ত্রণা হালকা হওয়ার জন্য দুটি দোয়া করেছেন। তা হলো—
ক. اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى غَمَرَاتِ الْمَوْتِ ‘হে আল্লাহ, মৃত্যুকষ্ট ও মৃত্যুযন্ত্রণা হ্রাসে আমায় সহায়তা করুন।’ (সুনানে তিরমিজি: ৯৭৮)
খ. اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي وَارْحَمْنِي وَأَلْحِقْنِي بِالرَّفِيقِ الأَعْلَى ‘হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করুন, আমার প্রতি দয়া করুন, আর আমাকে মহান বন্ধুর সঙ্গে মিলিত করুন।’ (সহিহ বুখারি: ৫৬৭৪)

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর