সুরা নাসর। পবিত্র কোরআনের ১১০তম সুরা। এই সুরার অপর নাম সুরা তাওদী বা বিদায়ী সুরা। কারণ সুরাটিতে নবীজির ইন্তেকাল নিকটবর্তী হওয়ার ইঙ্গি রয়েছে। এর আয়াত সংখ্যা তিন, সুরাটি আল্লাহর সাহায্য, বিজয় ও ইসলাম প্রতিষ্ঠার সুসংবাদবাহী। এই সুরায় বিজয়োল্লাসে আত্মহারা না হয়ে মহান আল্লাহর প্রশংসা, তাসবিহ ও মাগফেরাত কামনার মাধ্যমে বিজয় উদযাপনের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে নবী কারিম (স.)-এর বিদায়ের ইঙ্গিত দেওয়া হয়।
আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যই রাসুল (স.)-কে পাঠানো হয়েছিল। চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে সেটার যথার্থ বাস্তবায়ন হওয়ার পর সুরা নাসর নাজিল হয় এবং এতে করে তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, আপনার প্রস্থানের সময় কাছে চলে এসেছে। হজরত উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাকে ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, তুমি কি জানো কোরআনের সর্বশেষ নাজিলকৃত পূর্ণাঙ্গ সুরা কোনটি? আমি বললাম হ্যাঁ, তা হলো ইজা জায়া নাসরুল্লাহি ওয়াল ফাতহু। তিনি বললেন, তুমি সত্য বলেছ। (সহিহ মুসলিম: ৭২৬৫)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: নবীজির ইন্তেকালের যে বর্ণনা দিয়েছেন আয়েশা (রা.)
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যখন সুরা নাসর নাজিল হলো, তখন আল্লাহর রাসুল (স.) ফাতেমাকে (রা.) ডেকে বললেন, আমাকে আমার মৃত্যুর কথা জানানো হয়েছে। এ কথা শুনে ফাতেমা (রা.) কাঁদতে লাগলেন। তখন আল্লাহর রাসুল (স.) তাকে বললেন, কেঁদো না, আমার পরিবারের মধ্যে তুমি সবার আগে আমার সাথে মিলিত হবে। এ কথা শুনে তিনি হাসলেন।
আল্লাহর রাসুল (স.)-এর কয়েকজন স্ত্রী এ ঘটনা দেখে বললেন, হে ফাতেমা, একবার তোমাকে আমরা কাঁদতে দেখলাম, এরপরই আবার হাসতে দেখলাম, ব্যাপারটা কী? তখন ফাতেমা (রা.) বললেন, রাসুল (স.) আমাকে বললেন যে, তাঁকে তাঁর মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে, তা শুনে আমি কেঁদেছিলাম। এরপর তিনি আমাকে বললেন, কেঁদো না, আমার পরিবারের মধ্য থেকে তুমিই সর্বপ্রথম আমার সাথে মিলিত হবে। তখন আমি হাসলাম।
আল্লাহর রাসুল (স.) আরও বলেছেন, আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এসে গেছে। আর ইয়েমেনবাসীরাও এসে গেছে। তখন একজন লোক বলল, হে আল্লাহর রাসুল! ইয়েমেনের অধিবাসী কারা? তিনি বললেন, তারা হলো নরম হৃদয়ের অধিকারী। ইয়েমেনেই রয়েছে ঈমান আর ইয়েমেনীদের জন্যই রয়েছে হিকমাহ বা প্রজ্ঞা। (সুনানে দারেমি: ৮০)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: নবীজির জানাজা ইমাম ছাড়া কীভাবে সম্পন্ন হলো!
আরেকটি বর্ণনায় ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ওমর (রা.) আমাকে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সাহাবিগণের সাথে তার কাছে প্রবেশাধিকার দিয়েছিলেন। (আমার বয়স অল্প হওয়ায়) তারা এটাকে মনে-প্ৰাণে মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা বলেই ফেললেন, এই ছেলে আবার আমাদের সাথে কেন? আমাদের তো তার সমবয়সী সন্তান-সন্ততি আছে। ওমর (রা.) বললেন, তোমরা তো জানো সে কোত্থেকে এসেছে। তারপর একদিন তিনি তাদের মজলিসে তাকে ডেকে পাঠালেন। আমি বুঝতে পারলাম যে, তিনি আমাকে তাদের মাঝে ডেকে আমাকে তাদের সাথে রাখার ব্যাপারটি স্পষ্ট করতে চাচ্ছেন।
ওমর (রা.) বললেন, তোমরা মহান আল্লাহর বাণী, ‘ইযা জাআ নাসরুল্লাহি ওয়াল ফাতহ’ অর্থাৎ যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এলো, এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে কী বল? তাদের কেউ বলল, আমাদের বিজয় লাভ হলে যেন আমরা আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর কাছে ক্ষমা চাই তা-ই বলা হয়েছে। আবার তাদের অনেকেই কিছু না বলে চুপ ছিল।
তখন তিনি আমাকে বললেন, ইবনে আব্বাস! তুমি কি তাই বলো? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তাহলে কী বল? আমি বললাম, এটা তো রাসুলের মৃত্যুর সংবাদ, যা তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এসে যাবে’ আর এটাই হবে আপনার জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার আলামত, সুতরাং আপনি আপনার রবের সপ্ৰশংস তাসবিহ পাঠ করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চান; কেননা তিনিই তো তওবা কবুলকারী। ওমর (রা.) বললেন, তুমি যা বললে এ সুরা সম্পর্কে আমিও তাই জানি। (সহিহ বুখারি: ৪৯৭০)
আরও পড়ুন: অন্য নবীদের তুলনায় প্রিয়নবীজির বিশেষত্ব
সুরা নাসর (অর্থ ও উচ্চারণসহ)
اِذَا جَآءَ نَصۡرُ اللّٰہِ وَالۡفَتۡحُ ‘ইযা-জাআ নাসরুল্লা-হি ওয়াল ফাতহ’ ‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়’
وَرَاَیۡتَ النَّاسَ یَدۡخُلُوۡنَ فِیۡ دِیۡنِ اللّٰہِ اَفۡوَاجًا ‘ওয়ারাআইতান্না-ছা ইয়াদখুলূনা ফী দীনিল্লা-হি আফওয়া-জা’ ‘এবং আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন’
فَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّکَ وَاسۡتَغۡفِرۡہُ اِنَّہٗ کَانَ تَوَّابًا ‘ফাছাব্বিহবিহামদি রাব্বিকা ওয়াছতাগফিরহু ইন্নাহূকা-না তাওওয়া-বা’ ‘তখন আপনি আপনার পালনকর্তার পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাকারী।’
সুরা নাসরই কোরআনের অবতীর্ণ সর্বশেষ সুরা। এরপর কিছু আয়াত অবতীর্ণ হলেও কোনো পূর্ণাঙ্গ সুরা অবতীর্ণ হয়নি।
এ সুরায় আল্লাহর তিনটি নির্দেশ হলো আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা, প্রশংসা ও তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা। তা এভাবে করা যায়- سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي উচ্চারণ: ‘সুবাহানাকাল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা আল্লাহুম্মা-গফিরলী’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, আপনার প্রশংসা করছি। হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, এই সুরা নাজিল হওয়ার পর আল্লাহর রাসুল (স.) প্রত্যেক নামাজের পর এই দোয়া পাঠ করতেন (সহিহ বুখারি: ৭৯৪)