শুক্রবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

দামেস্কের যে মসজিদে ঈসা (আ.) অবতরণ করবেন

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৭ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে অবস্থিত উমাইয়া মসজিদ। এটি গ্রেট মস্ক অব দামাসকাস নামেও পরিচিত। এটি শুধুমাত্র একটি মসজিদ নয় বরং পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং অতি মূল্যবান এক স্থাপনা। বর্তমান বিশ্বে যে কয়টি প্রাচীন ইসলামি স্থাপত্য আদি অবকাঠামোর ওপর এখনো টিকে আছে, তার মধ্যে অন্যতম এটি। এর বয়স ১৩শ’ বছরের বেশি। এ মসজিদকে ইসলামি স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম পথিকৃত হিসেবে বিবেচনা করা হয় সারাবিশ্বে। অনেকের মতে, কেয়ামতের আগে এই মসজিদের ওপরই অবতরণ করবেন হজরত ঈসা (আ.)

হজরত নাওয়াস ইবনে সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিসে এসছে, নবী ঈসা (আ.) জাফরানের রঙের দুটি পোশাক পরে এবং দুজন ফেরেশতার পাখার ওপর হাত রেখে দামেশক শহরের পূর্বে অবস্থিত সাদা মিনারের উপরে অবতরণ করবেন।’ (মুসলিম: ২৯৩৭)


বিজ্ঞাপন


তিনি ফজরের নামাজের সময় যখন তাকবিরে উলা বলা হয়ে যাবে তখন অবতরণ করবেন। নামাজের জন্য প্রথম কাতারে দাঁড়াবেন। দায়িত্বরত মুসলিম ইমাম (ইমাম মাহদি) তখন শ্রদ্ধাভরে অনুরোধ করবেন, হে রুহুল্লাহ, আসুন, আমাদের ইমামতি করুন। তিনি বলবেন, না, তোমরা বরং একে অন্যের আমির। এটাই সেই সম্মান, যা আল্লাহ তাআলা এই উম্মতকে দান করেছেন।’ (মুসলিম: ১৫৬)

umaia-mosque-5

আরও পড়ুন: কেয়ামতের যেসব আলামত সৌদি আরবে প্রকাশ পাবে

পৃথিবীতে তখন দাজ্জালের আবির্ভাব হবে। সে ধোঁকাবাজির জাল বিস্তার করে নিজেকে মাসিহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়াবে। এক পর্যায়ে সে নিজেকে খোদা বলে দাবি করবে। নবী ঈসা (আ.) ‘লুদ’ ফটকের কাছে তাকে হত্যা করবেন। মুজাম্মি ইবনে জারিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) বলেন, ঈসা ইবনে মরিয়ম দাজ্জালকে বাবে লুদে হত্যা করবেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৩৮৬৮৯)


বিজ্ঞাপন


লুদ হচ্ছে বাইতুল মাকদিসের পশ্চিমে উপকূলীয় নগরী তেল আবিব ইয়াফু থেকে রামাল্লাহগামী রাজপথের ধারে ফিলিস্তিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরী। বর্তমানে ইসরাঈল সেখানে একটি বিশাল বিমানবন্দর বানিয়ে রেখেছে। (আউনুল মা‘বুদ, মুহাম্মদ আবাদিকৃত: ১১/৩০২)

উমাইয়া মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে হজরত ইয়াহইয়া (আ.)-এর কবর। এছাড়া এ মসজিদের পাশে অনেক বীরযোদ্ধার কবর রয়েছে। জেরুজালেম বিজয়ী বীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবীসহ তার বংশধরদেরও অনেকের কবর রয়েছে এ মসজিদের পাশে। বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এ মসজিদে বসে কোরআনে কারিমের ব্যাখ্যা করতেন মানুষের কাছে। মসজিদের তিনটি মিনারের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ঈসা মিনার ২৫৩ ফিট।

umaia-mosque-3

আরও পড়ুন: যে ফেতনাকে সাহাবিরাও ভয় পেতেন

মসজিদ নির্মাণের হাজার বছর আগে থেকে বিভিন্ন দেবতার উপাসনা করা হতো এখানে। দীর্ঘকাল ধরে এখানে ছিল রোমনাদের জুপিটার মন্দির। পরে ৩৯১ সালে জুপিটার মন্দিরকে খ্রিস্টান চার্চে পরিণত করা হয়। পরে এ চার্চ হজরত ইয়াহইয়া (আ.)-এর নামে উৎসর্গ করা হয়। প্রাচীনকাল থেকে বিদ্যামন উপাসনালয় এবং পরবর্তীতে মসজিদ নির্মাণের পরে এখানে থাকা অনেক মূল্যবান প্রত্ন নিদর্শন বর্তমানে সিরিয়ার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

৬৩৪ সালে খালিদ ইবনে আল ওয়ালিদের নেতৃত্বে দামেস্ক জয় হয়। ৬৬১ সালে ইসলামি খেলাফত উমাইয়া বংশের অধীনে আসে। এরপর দামেস্ক হয় মুসলিম বিশ্বের প্রশাসনিক রাজধানী। ষষ্ঠ উমাইয়া খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদ ৭০৫ সালে এখানে মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।

পারস্য ইতিহাসবিদ ইবনে আল ফকিহ লিখেছেন, ৭০৫ সালে মসজিদ নির্মাণ শুরুর পর খননের সময় এর নিচে একটি গোপন বাক্সে রক্ষিত একটি মস্তক পাওয়া যায়। এ মস্তক হজরত ইয়াহইয়া (আ.)-এর বলে বিশ্বাস। খলিফা প্রথম ওয়ালিদ এটি জানার পর তিনি মস্তকটি মসজিদের মধ্যে সমাহিত করে তার ওপর একটি বিশেষ পিলার নির্মাণের নির্দেশ দেন। পরে এ স্থানে মাজার ও গম্বুজ নির্মাণ করা হয়। হজরত ইয়াহইয়া (আ:)-কে খ্রিস্টানরাও তাদের নবী দাবি করে। সে কারণে এ মসজিদ খ্রিস্টানদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া আগে থেকেই এখানে ছিল তাদের চার্চ।

umaia-mosque-4

এ মসজিদ যখন নির্মাণ করা হয় তখন এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল একটি প্রকল্প। ভারত, ইরান, গ্রিস ও মরক্কো থেকে ১২ হাজার দক্ষ কারিগর সংগ্রহ করা হয় এর স্থাপত্যশৈলীর জন্য। এ ছাড়া বাইজানটাইন কারিগরদের নিয়োজিত করা হয় এর মোজাইকের কাজে। ৭১৫ সালে শেষ হয় মসজিদ নির্মাণ।

আরও পড়ুন: ‘দাসী তার মনিবকে জন্ম দেবে’ হাদিসের অর্থ কী?

৭৫০ সালে উমাইয়াদের পতনের পর আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় আসে এবং ইসলামি খেলাফতের রাজধানী হয় বাগদাদ। আব্বাসীয়দের সময়ও এ মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মিসরের ফাতিমিদের দখলে আসে এ শহর। এরপর আবার তুরস্কের সেলজুক রাজার মাধ্যমে উদ্ধার হয় এ শহর। এরপর ক্রুসেডের সময়ও এ শহরের আধিপত্য নিয়ে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে লড়াই চলে এবং শেষ পর্যন্ত নুরউদ্দিন জঙ্গি দখল করেন এ নগরী। পরে সুলতান সালাহউদ্দিন আইউবী, তার কাছ থেকে মামলুক এবং মামলুকদের কাছ থেকে তুরস্কের উসমানীয়রা ১৫১৬ সালে দখলে নেয় এ নগরী।

umaia-mosque-2

দখল-পাল্টা দখলে বিভিন্ন সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ মসজিদ। বিশেষ করে ১৪০০ সালে তিমুর দামেস্ক নগরী পুড়িয়ে দেওয়ার আদেশ দিলে মসজিদের মূল গম্বুজসহ একটি মিনার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। বিভিন্ন সময় এ মসজিদ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি বিভিন্ন সময় মুসলিম শাসকরা এ মসজিদের সংস্কারও করেন। উসমানীয়দের পর সর্বশেষ বড় আকারে এ মসজিদ সংস্কার করেন সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ।

১৩ শ’ বছর পার হলেও এখনো এ মসজিদের আদি অলঙ্করণ এবং সাজসজ্জা অমলীন যা মুগ্ধ করে দর্শকদের। এ মসজিদ সিরিয়ার অন্যতম দর্শনীয় স্থান।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন