আজকাল অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের দ্বারা পরিচিতি পাচ্ছেন। হচ্ছেন ভাইরাল। এই তালিকায় রয়েছে অপ্রাপ্ত বয়স্করাও। পরিচিতি পেয়ে তারাও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতামত প্রকাশ করছে। অনেক সময় তাদের বক্তব্যগুলো হয়ে যাচ্ছে পরামর্শ বা উপদেশমূলক। এসব কারণে সম্প্রতি আলোচনা-সমালোচনায় রয়েছে শিশু সেলিব্রেটি ও শিল্পী সিমরিন লুবাবা। নেটিজেনদের অনেকেই তার ওপর বিরক্ত। লুবাবাকে নিয়ে তারা করছেন ট্রল।
অনেকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন এই শিশু সেলিব্রেটির অভিভাবকের ওপর। তাদের বক্তব্য, সন্তানকে উপযুক্ত স্থানে লাগাম টানতে না শিখিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা উপভোগ করছেন তারা। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা মেইল।
বিজ্ঞাপন
সামাজিক মাধ্যমে শিশু সেলিব্রেটিদের অবাধ বিচরণ। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তারা কথা বলছে। অনেক সময় তা সীমা ছাড়াচ্ছে। এসব নিয়ে ডা. তাজুল বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে, আমাদের প্রত্যেকেরই বুদ্ধিবৃত্তিক মেধার বিকাশে পরিপক্ক হওয়ার কতগুলো পর্যায় আছে। এরমধ্যে একটি হচ্ছে, শিশুদের মেধাকে যত্নের সঙ্গে পরিচর্যা করা যেন পরবর্তীকালে তা স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হয়। প্রাপ্ত বয়সে অবদান রাখতে পারে। তবে যাদের আজকাল সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা যাচ্ছে তারা ওই মাপের প্রতিভাবান কেউ না। অল্প পানির মাছ যেরকম বেশি লাফালাফি করে তারা অনেকটা সেরকম। আর আমাদের মধ্যে লোক দেখানোর বাতিক রয়েছে। যেমন ধরুন একটি শিশু ভালো কথা বলতে পারে বা বিশেষ কিছু গুণ আছে যা মানুষকে টানছে সেগুলো করে সে দর্শক তৈরি করতে পারে। এটা অসম্ভব কিছু না। কিন্তু এটাকে পুঁজি করে তারা যখন ভাইরাল হওয়ার চেষ্টা করে তখনই তা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে।’
এক্ষেত্রে ওই শিশুর অভিভাবকদের দায় আছে বলে মনে করেন ডা. তাজুল। তিনি বলেন, ‘ওই পরিবারের মা-বাবা যারা আছেন তারা আরও উৎসাহ দেন । আমি মনে করি, তাদের নিজেদের আসলে গর্ব করার মতো তেমন কিছু নেই। তারা মনে করেন আমার সন্তান সেলিব্রেটি হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে আমি বিশাল কিছু হয়ে যাচ্ছি। তারা এটাকে প্রশ্রয় দেন। উপভোগও করেন। এটা তো একটি সামাজিক অনর্থ।’
বিজ্ঞাপন
তবে সন্তানের তারকা খ্যাতি উপভোগ করতে গিয়ে ওই অভিভাবকেরা নিজের সন্তানকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাবা-মা এটা করে অন্যদের যতটা ক্ষতি করছেন তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ওই ছেলেমেয়েদের। তাদের সত্যিকার অর্থে যে মেধা আছে সেটাও ব্যাহত হচ্ছে। অনেক ফুল আছে ফোটে আর ঝরে পড়ে। ওই ফুলের তো কোনো ঘ্রাণ নেই। যে ফুল আস্তে আস্তে ফল দেয় সেটি সফল। এই ভাইরাল শিশুরাও অল্প সময়েই ঝরে পড়বে। শুধু ঝরে পড়বে না, মুখ থুবড়ে পড়বে। এর অনেক উদাহরণ আছে। প্রতিভাবান শিশুশিল্পী অনেক ছিল। তারা বেশি প্রচারের আলোয় আসায় তেমন কিছুই করতে পারেনি। এগুলো থেকে আজকের শিশু সেলিব্রেটি ও তাদের বাবা-মায়ের শিক্ষা নেওয়া উচিত। যদি তারা সন্তানকে টেকসইভাবে সফল দেখতে চান তাহলে তথাকথিত এই উন্মাদনা পরিহার করতে হবে। আর যদি তারাও বিষয়টি এড়িয়ে চলেন তাহলে বুঝতে হবে ওই পরিবারের সদস্যরা পরিপক্ক না। প্রকৃত শিক্ষিত, সচেতন ও সংস্কৃতিবান্ধব কোনো পরিবার শিশুর এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে উৎসাহ দেয় না।’
এ সময় সিমরিন লুবাবাকে নিয়ে ডা. তাজুল বলেন, ‘আব্দুল কাদের সাহেবের নাতনি স্বাভাবিকভাবে হয়তো প্রতিভাটি পেয়েছে। বংশগত কারণে হতে পারে। তার ভেতরে যে প্রতিভা আছে সেটা নষ্ট না করে লালন করতে হবে। একটি চারা গাছকে লালন-পালন করলে অনেকদিন পর এটা বড় হয়। তখন ফলে ফুলে এটা ভরে ওঠে। ওর পরিবারের উচিত তাকে সেভাবে পরিচর্যা করা।’
এই বিশেষজ্ঞ সামাজিক মাধ্যমকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করান। তিনি বলেন, ‘তার স্বাভাবিক প্রতিভা আছে। সেটা সুযোগ পেলে প্রকাশ করবেই। এটা অস্বাভাবিক না। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া যদি না থাকত তাহলে তার এভাবে ভাইরাল হওয়ার সুযোগ থাকত না। সেক্ষেত্রে তার যা মেধা আছে সেটার চর্চা করতে থাকত। চর্চা করতে করতে একসময় সত্যিকার অর্থেই সে বিশাল কিছু হতে পারত। এমনিতেই তখন প্রচারের আলোয় আসত। তবে এখন যেটা হচ্ছে সেটাকে সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার বলা যায়। এখানে যেমন ভালো কিছুও করা যায় তেমনই খারাপ কিছুও। যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই সেহেতু অভিভাবককে ভাবতে হবে এটা। শিশুকে সামাজিক মাধ্যমে অবাধ বিচরণ করতে দেওয়া যাবে না। সেইসঙ্গে তাকে কোন অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে হবে, কোথায় কথা বলতে দেওয়া ঠিক হবে এটাও ভাবতে হবে তাদের। আমরা প্রশংসা ও সম্মান করি তার প্রতিভার। আশা করি এটা যাতে টেকসইভাবে টিকে থাকে তার অভিভাবকের সে ব্যাপারে মনযোগী হওয়া উচিত। সামাজিক মাধ্যমের উন্মাদনায় যেন নষ্ট না হয়।’
লুবাবাকে নিয়ে ট্রলে মেতে উঠেছেন নেটিজেনরা। বিষয়টি অমানবিক বলে মনে করছেন ডা. তাজুল। তিনি বলেন, ‘সাইবার বুলিং, ট্রলিং খুবই নেতিবাচক একটি কাজ। এর শিকার হয়ে অনেকে আত্মহত্যাও করেছে। লুবাবাকে নিয়ে যারা ট্রল করছেন তাদের বুঝতে হবে অন্যকে উপহাস করে তারা যে মজা পাচ্ছেন বিষয়টি মোটেও সেরকম নয়। এটি একটি অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতা। এগুলো থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আর এতে হতাশ হয়ে তার স্বাভাবিক প্রতিভা যেন ব্যহত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটিও দেখতে হবে।’
বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলার পর যোগাযোগ করা হয় লুবাবার মা জাহিদা ইসলামের সঙ্গে। শিশু সেলিব্রেটিদের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের করণীয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের বক্তব্য তুলে ধরা হয় তার সামনে।
এদিকে তিনি মনে করছেন লুবাবা গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা না বললে হিতে বিপরীত হতে পারে। তিনি বলেন, ‘লুবাবা যেখানে যায় সেখানে সাংবাদিকরা ঘিরে ধরে। সে যদি ক্যামেরার সামনে বলে, আমি আপনাদের ইন্টার্ভিউ দেব না সেটাও ভাইরাল হয়ে যাবে। তখন তাকে অহংকারী বলা হবে। সেকারণেই ও বলে, ঠিক আছে কথা বলি। এছাড়া ওর দাদাও বলেছেন, কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ না করতে। আর আমার কথা হচ্ছে, আরও অনেক শিশুশিল্পী আছে। সাংবাদিকদের উচিত তাদের সঙ্গে কথা বলা। কিন্তু তারা কেন সেটা না করে ওর পেছনে লেগে থাকে? যেকোনো অনুষ্ঠানে ওর সঙ্গে আমরা কয়েকজন থাকি। কিন্তু ক্যামেরার সামনে আসি না। কোনো প্রশ্নের উত্তরে আমরা হস্তক্ষেপ করলে বলা হয় শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এজন্য কিছু বলি না।’
এরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লুবাবার উপস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা লুবাবাকে সব কাজ করাই না। প্রত্যেক মাসে দেখা যায় ১০-১৫টি কাজের প্রস্তাব আসে। কিন্তু করাই না। তবে কাজের চেয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতার শিকার হয় লুবাবা। বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে ওকে ইনভাইট করা হয় বলেই ও যায়। কিন্তু যাওয়ার পর এতকিছুর সম্মুখীন হতে হয় যে ও আসলে বুঝে উঠতে পারে না। ও তো ছোট মানুষ। ও চায় না যে কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে।’
কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিক ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ দেখতে যায় লুবাবা। সেখান থেকে তার কিছু বক্তব্য ভাইরাল হয়। এরপরই ট্রলের শিকার হতে হচ্ছে তাকে। এ প্রসঙ্গে জাহিদা ইসলাম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ছবিটির প্রতি ওর দুর্বলতা ছিল। কারণ ছবিটিতে অভিনয়ের জন্য ও অডিশন দিয়েছিল, সিলেক্টও হয়েছিল। কিন্তু তার দাদা (আব্দুল কাদের) অসুস্থ হওয়ার কারণে যেতে পারেনি। ওই জায়গা থেকে ছবিটা নিয়ে ওর আগ্রহ ছিল। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ওর ভীষণ আগ্রহ। সেকারণেই ছবিটা দেখতে গিয়েছিল ও।’
বিশেষজ্ঞের মতে শিশুদের সামাজিক মাধ্যমে অবাধ বিচরণে বাবা-মায়ের লাগাম টানা উচিত। পরিবারের সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে। লুবাবার মা জানান, এ ব্যাপারে তারা শতভাগ সতর্ক। তিনি বলেন, ‘লুবাবা ফেসবুক চালায় না। ওর নামে যে আইডি আছে সেটা অ্যাডমিন, মডারেটররা চালায়। ও ব্যক্তিগতভাবে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ব্যবহার করে না। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ার কোনোকিছু তাকে জানানোও হয় না। ওর আইডি থেকে যত পোস্ট করা হয় সেসব আমিসহ আরও কয়েকজন আছে তারা নিয়ন্ত্রণ করে থাকি। ওর টুইটার অ্যাকাউন্ট শুধু ভারতের জন্য। সেখানে বাংলাদেশের কেউ নেই।’
সম্প্রতি ট্রলের ব্যাপারটি জেনে বেশ বিব্রত লুবাবা। মানসিকভাবেও কিছুটা বিপর্যস্ত। এরকম উল্লেখ করে জাহিদা ইসলাম বলেন, ‘ ‘বিষয়টা ও জানতে পেরেছে স্কুল থেকে। ও যখন স্কুলে গেছে তখন ওকে দেখে অনেকেই ‘কেন্দে দিয়েছি’ বলেছে, ছবি তুলতে এসেছে। তখন ওর মাথায় এসেছে ‘কেন্দে দিয়েছি’ এটা তো আমি বলেছিলাম। ও বাসায় এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে আসলে কী হয়েছে? ওরা কেন এটা বলছে। আমি তখন বললাম তুমি যে ‘কেন্দে দিয়েছি’ বলেছ সেটা ভাইরাল হয়েছে। তখন ও বলল, আমি যখন কথাটা বলেছি সাংবাদিক আংকেলরা তখন শুনেছেন আমি ভুল বলেছি। তারা তো ওই জায়গাটি ফেলেও দিতে পারত। এতে ও বিব্রত বোধ করছে। ও যেখানেই যাচ্ছে মানুষ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কেন্দে দিছি লুবাবা বলে ছবি তুলতে আসছে। তখন কষ্ট লাগে যে কেন্দে দিছিও বলছে আবার ছবিও তুলতে আসছে। তার মানে কী? ওর জন্য আমিও অসুস্থ হয়ে গেছি। কারণ ও ছোট মানুষ। কীভাবে নেবে বিষয়টি?’ ’
তবে জাহিদা ইসলাম মনে করছেন এসব ট্রল লুবাবার ক্ষতি করতে পারবে না। কেননা তারা এসব পাত্তা দিচ্ছেন না। তিনি মনে করছেন, যারা আজ হাসাহাসি করছে তারা একদিন লুবাবার দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তার কাছে আসতে বাধ্য হবেন। সেইসঙ্গে ট্রলকারীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও জানান লুবাবার মা।
আরআর