শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

ব্লু-ইকোনমি খুলে দিতে পারে অপার সম্ভাবনার দ্বার

মোস্তফা ইমরুল কায়েস
প্রকাশিত: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:০৮ পিএম

শেয়ার করুন:

loading/img
  • অন্য দেশের সাথে ক্রুজ লাইন চালুর উদ্যোগ নিতে হবে
  • পোর্টগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে
  • আধুনিক জাল ও উন্নতি প্রযুক্তি প্রয়োজন
  • জেলেরা যেসব মাছ ধরেন সেগুলো নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার

বিশ্বে সাগরের তলদেশ ও উপরিভাগকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দেশ বিপুল অর্থ উপার্জন করছে। আবার কোনো কোনো দেশ শুধু সাগরের ওপর ভরসা করেই তাদের অর্থনীতি চালাচ্ছে। যাকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হচ্ছে ব্লু ইকোনমি বা নীল সাগর অর্থনীতি।


বিজ্ঞাপন


বাংলাদেশও এখন ব্লু -ইকোনমি নিয়ে ভাবছে। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর ব্লু -ইকোনমির একটি অংশ ব্লু -ট্যুরিজম। আর এই ব্লু -ইকোনমিকে কাজে লাগাতে পারলে খুলে যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির অপার সম্ভাবনার দ্বার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ইকোনমিকে সমৃদ্ধ করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এজন্য পরিকল্পনার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তিও যুক্ত করতে হবে। কারণ এই অর্থনীতির অংশ হিসেবে সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

জানা গেছে,  বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতি বছর প্রায় ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ ধরেন জেলেরা। কিন্তু তাদের কাছে আধুনিক জাল ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় কাঙ্ক্ষিত মাছ তারা পাচ্ছেন না। এর ফলে প্রতি বছর মাত্র ০.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ ধরতে পারছেন বাংলাদেশের জেলেরা। তবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে মাছ আহরণের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব।

ব্লু -ইকোনমির মূল ভিত্তি হচ্ছে টেকসই সমুদ্র নীতিমালা। বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতি বহুবিধভাবে অবদান রেখে চলেছে। বিশ্বে সারাবছর সমুদ্রকে ঘিরে ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা হয়ে থাকে। আর বিশ্বের প্রায় ৮০৯ কোটি মানুষের প্রোটিনের ১৫ ভাগ যোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও প্রাণি। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। এসব মিলে সাগর অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখছে।


বিজ্ঞাপন


বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ব্লু -ইকোনমির একটা বড় দিক হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। তারপর আরেকটি দিক ট্রান্সপোর্টেশন। বাংলাদেশে সামুদ্রিক ট্রান্সপোর্টেশনের মাধ্যমে বড় একটা অর্থনৈতিক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এটি নির্ভর করবে পোর্টগুলোর (বন্দর) ধারণ ক্ষমতা ও ক্যাটাগরির ওপর। এছাড়াও একটি দিক হলো মেরিন সার্ভিস। আর এই কাজ করে থাকে সিঙ্গাপুর ও দুবাই।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

সাগর পর্যটন ও স্কুবা ডাইভিং বিশেষজ্ঞ এস এম আতিকুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, বাংলাদেশে ব্লু -ইকোনমিতে প্রবেশ করার জন্য যেসকল উদ্যোগ ও যন্ত্রপাতি থাকা দরকার তা নেই। ওয়াটার বোট, স্পিড বোট, ডাইভিং ইকুইপমেন্ট ও দক্ষ চালক দরকার। মেরিন সার্ভিসের মধ্যে হাল স্পেকশনটাও পড়ে। ডকইয়ার্ড, এটা মেরিন সার্ভিসের মধ্যেই পড়ে। জাহাজকে অনেক সময় ডকইয়ার্ডে ওঠানোর প্রয়োজন হয়। আমাদের উপকূলে যদি কোনো আন্তর্জাতিক মানের ডকইয়ার্ড থাকে; তবে সিঙ্গাপুর, দুবাই ও ভারতের তুলনায় আমাদের দেশে যদি বেশি সুবিধা হয় তাহলে ব্লু -ইকোনমির একটা নতুন অধ্যায় উম্মুক্ত হতে পারে। অনেক দেশ শিপইয়ার্ডের ব্যবসা করে যাচ্ছে; যেমন: মাল্টা ও সিঙ্গাপুর। গত ১০ বছরে কিন্তু আমাদের দেশে অনেক মেরিন আর্কিটেক্ট, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার গড়ে উঠেছে এবং তারা বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের মেরিন ইঞ্জিনিয়াররাই কাজ করছে। বাংলাদেশের শিপইয়ার্ডের ব্যবসাটাকে আন্তর্জাতিক মানের করতে পারলে ব্লু -ইকোনমির আরেকটি দিক অর্জন করতে পারব।

তিনি বলেন, অধিকাংশ মানুষ ব্লু -ইকোনমি মানে মনে করে খনিজ সম্পদ। যত দিন যাচ্ছে খনিজ পদার্থ উত্তোলনের মাত্রা বাড়ছে। খনিজ সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে যদি জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব পড়ে; তবে বহুদেশে সেটির কাজ বন্ধ করে দেওয়ার নজির রয়েছে। আমরা সাগরের তলদেশ থেকে তেল-গ্যাস আহরণ করব; এটা নিয়ে বেশি প্রত্যাশা করা যাবে না। এটাকে যদি এখন থেকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ ও সংরক্ষণ না করা যায় তবে সেক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্য একটা বড় ধরনের হুমকিতে পড়বে।

 

মাছ আহরণ বিষয়ক গবেষণা থাকা দরকার
 
আতিকুর রহমান মনে করেন, বাংলাদেশের সাগর থেকে যেসব মাছ আহরণ করা হয় সেগুলোর ব্যাপারে ইলিশের মতো গবেষণা হওয়া দরকার। তাহলে কখন কোন মাছের প্রজনন, ডিম ছাড়া, ডিম থেকে পোনার জন্ম ও সেই মাছের বৃদ্ধির ব্যাপারে সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে। তাতে জেলেরা কোন সময় কোন মাছ ধরতে হবে তা জানতে পারবে। এতে করে সেসব মাছের বংশবৃদ্ধি হবে। আর এটা জীববৈচিত্র্যের একটি অংশ। জীববৈচিত্র্যের একটি বড় বিষয় হচ্ছে, সমুদ্রের মাঝে থাকা প্রাণীদের বেড়ে ওঠা ও জীবন চক্র, জন্ম ও উপকূলের ম্যানগ্রোভ। এই দুটি জায়গাকে নিরাপদ রাখা খুবই জরুরি। আমরা এটি করতে পারলে মৎস্য সম্পদ আহরণ বাড়বে। তখন বাকি জায়গাগুলোও সংরক্ষিত হবে। তখন জীববৈচিত্র্যের পরিমাণ সঠিক থাকবে।

তার মতে, জীববৈচিত্র্য থেকে অনেক অর্থনৈতিক আয় হবে। এই অর্জন এমনভাবে বন্টন হয় যে এটাকে একা কোনো ‘রাঘববোয়াল’ বাগে রাখতে পারবে না। দেশের উপকূলীয় ১৯ এলাকার সকল মানুষ এর সুফল পাবে। জীববৈচিত্র্যকে কেন্দ্র করে ইকো-ট্যুরিজম, ওয়াটার স্পোর্টস, ডাইভিং ট্যুরিজম; এই জিনিসগুলো বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে হতে পারে। যদি এ বিষয়ে আরও সুশৃঙ্খলভাবে হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মহল ভালোভাবে মনিটরিং করে। কক্সবাজারে স্পোর্টস ট্যুরিজম, সেলিং এঙ্গলিং’র মাধ্যমে ইকো-ট্যুরিজমকে আরও বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) এর সাবেক প্রেসিডেন্ট শিবলুল আযম কোরেশী বলেন, ব্লু -ইকোনমিতে ক্রুজ লিংকের মাধ্যমে মানুষ ভালো বিনোদন পেতে পারে এবং অর্থ আয় করে জিডিপিতে দারুণ অবদান রাখতে পারে। এটি সুন্দরবন, চট্টগ্রাম, সেন্টমার্টিন পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি বাড়ানো যেতে পারে। এটি ডোমেস্টিক ক্রুজ লিংকের জন্য। এছাড়াও আমাদের বড় বড় নদীগুলোতে এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে এটা সব জায়গায় ব্যয়বহুল বিনোদন। ভ্যাট ও ট্যাক্স কমিয়ে এটি সহজ করা যেতে পারে। কারণ জাহাজে যাতায়াতে অনেক তেলের প্রয়োজন হয়। দেশের অভ্যন্তরের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভারত, পাকিস্তানের সাথে ক্রুজ লাইন চালুর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। আর এভাবে ব্লু -ইকোনমির প্রসার ঘটানো সম্ভব।

কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, আমরা পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ বালুকাময় সৈকত ও একটি সাগর পেয়েছি। এই দুটি বিরল উপাদানের সমন্বয়ে আমাদের কক্সবাজার পর্যটন হাবটা আন্তর্জাতিক মান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাটা আগেই নেওয়া উচিত ছিল। অপূর্ব সম্ভাবনার হাব হচ্ছে একটি ব্লু -সি। সমন্বয়হীনতার কারণে আমরা একটি পরিকল্পিত পর্যটন হাব গড়ে তুলতে পারছি না।

পর্যটন বোর্ড যা বলছে
 
বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের নির্বাহী প্রধান কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা পর্যটন বোর্ডের পক্ষ থেকে ব্লু -ট্যুরিজমকে উন্নত করার জন্য কয়েকটা জায়গায় ফিজিবিলিটি স্টাডি শুরু করেছি। একটি হচ্ছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, আর অন্যটি আনোয়ারা এবং পতেঙ্গা। আমরা নির্ধারণ করার চেষ্টা করছি যে এসব জায়গায় কি ধরনের স্থাপনা করা যেতে পারে। ফিজিবিলিটির রিপোর্ট আসার পর সে রিপোর্ট দেখে আমরা ডেভেলপমেন্ট করব। ব্লু-ট্যুরিজমকে উন্নত করার জন্য ব্যক্তি উদ্যোগে প্রচুর কার্যক্রম আছে। উপকূলে ট্যুরিজমের যত কার্যক্রম রয়েছে সবগুলো কিন্তু ব্লু -ট্যুরিজমের অংশ। মন্ত্রিপরিষদের পক্ষ থেকে ব্লু -ইকোনমিকে উন্নত করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; পাশাপাশি আমরা আছি। 

এমআইকে/এফএ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর