শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

কেমন যাবে চব্বিশের অর্থনীতি

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:৫৫ পিএম

শেয়ার করুন:

কেমন যাবে চব্বিশের অর্থনীতি
কোলাজ ঢাকা মেইল

# রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েছে

# বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে

# ডলার সংকটে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি

# মূল্যস্ফীতির বড় ধাক্কা

# জীবনযাপনের খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ

রিজার্ভ কমে যাওয়া, ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতিসহ নানা সংকটে কেটেছে ২০২৩ সালের দেশের অর্থনীতি। ২০২২ সালের গোড়ার দিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর যে প্রভাব সারা বিশ্বে পড়ে তার আঁচ লাগে বাংলাদেশেও। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বেড়ে যায় ডলারের দাম। শুরু হয় সংকট। ডলারের এমন সংকটে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি। এর মধ্যে জ্বালানি সংকটও চরমে ওঠে। এসব সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টার মধ্যে যোগ হয় মূল্যস্ফীতির ধাক্কা। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের খরচ বেড়ে যায় কয়েক গুণ।


বিজ্ঞাপন


নানা সংকটের মধ্যে যোগ হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। দেশের অত্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি সংসদ নির্বাচনে বর্জন করায় ভোট অংশগ্রহণমূলক হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আবার নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে বহির্বিশ্বের চাপের কথা শোনা যাচ্ছে খুব জোরেসোরে।

সার্বিক বিষয় মিলেই খুব একটা ভালো নেই দেশের অর্থনীতি। এত চাপ মাথায় নিয়ে শুরু হওয়া নতুন বছরের (২০২৪) অর্থনীতি কেমন যাবে? তা নিয়ে কথা হয় কয়েকজন অর্থনীতিবিদের সঙ্গে। ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপে কেউ কেউ ২০২৪ সালের অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জ আছে মনে করলেও কেউ কেউ আশার বাণী শুনিয়েছেন। তবে সবাই রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই নতুন বছরের অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন।

আরও পড়ুন

নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা ১৫ জানুয়ারি

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নতুন বছরের অর্থনীতি কেমন যাবে সেটা নির্ভর করছে সরকার কীভাবে দেশ পরিচালনা করবে তার ওপর। দেশের নির্বাচন কীভাবে হয়, কতখানি পার্টিসিপেটরি হয় সেটার ওপর নির্ভর করে সরকারের ম্যান্ডেট। ৪০ শতাংশের ওপর মানুষ যদি ভোট দেয়, তাহলে হয়তো সরকারের এক্সেপ্টেডটা হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা যদি ১০-২০ পার্সেন্ট হয় সেটা আসলে ম্যান্ডেট হয় না।’


বিজ্ঞাপন


taka

বাস্তবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হচ্ছে না জানিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এবার ইলেকশনটা তো ম্যানেজড ইলেকশনই হচ্ছে। এটার জন্য দুই পক্ষকেই আমি দায়ী করব। সরকারও দায়ী, বিএনপিও দায়ী। একগুঁয়েমি করার কোনো মানে হয় না। মানুষ যদি এর মধ্যেও মনে করে তার ভোটে আগ্রহ আছে, যদি ভোটটা মোটামুটি অন্যবারের মতো না হয়, যার জেতার সেই জিতে এবং সরকার যদি ৪০ শতাংশ ভোটারকে আকৃষ্ট করতে পারে তাহলে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হবে এবার। এটা হচ্ছে রাজনৈতিক দিক।’

‘এই গ্রহণযোগ্যতা অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশে দুইটা জায়গাতেই দরকার আছে। সরকারের গ্রহণযোগ্যতা সরকারকে শক্তিশালী অর্থনৈতিক পদক্ষেপ দিতে পারবে। তার একটা ম্যান্ডেট থাকবে তখন। সরকার তখন আমাদের যে ইকোনোমিক ইস্যুগুলা আসে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা, ডলারকে স্ট্যাবল করা, রিজার্ভ বাড়ানো এগুলো বেশ কঠিন কাজ। ব্যাংকিং খাতকে রিফর্ম, সরকারের যারা পছন্দের লোক তাদেরকে এই খাত থেকে সরাতে হবে, এসব করতে হলে সরকারের শক্তিশালী ইকোনোমিক টিম থাকতে হবে। শুধু সরকারি কর্মকর্তা দিয়ে এটা হবে না। সেই ধরনের অর্থমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী দরকার। সেটা গঠন করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি।’-বলেন আহসান মনসুর।

আরও পড়ুন

রিজার্ভ থেকে ৬.৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অর্থনৈতিকভাবে আমরা একটু বেকায়দায় আছি। বিশেষ করে ভোট ও রাজনীতিকেন্দ্রিক যে ইস্যুগুলো এগুলোর বাইরে কিন্তু ইকোনোমি না। একটা একসেপ্টেবল ইলেকশন আরেকটা পর্শিয়ালি একসেপ্টেবল ইলেকশনের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। বাংলাদেশের হিউম্যান রাইটস, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, একসেপ্টেবল ইলেকশন এই ইস্যুগুলো কিন্তু এখন স্টিল অ্যালাইয়েন্স। যারা সরকারের সঙ্গে আছে তাদের কাছে এটা বড় ম্যাটার নাও হতে পারে। বাট আদার পিপলের কাছে বিদেশের কাছে এটা ম্যাটার করে। ওইসব কারণে যদি ইকোনোমি ক্ষতিগ্রস্তের দিকে যায়, তাহলে সেটা হবে খুব অনাকাঙিক্ষত। এজন্য আমরা হয়তো শিওর কিছু বলতেও পারছি না।’

ctc

আবু আহমেদ আরও বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল রেটিং এজেন্সিগুলো আমাদেরকে ডাউন গ্রেটেড করে দিয়েছে। আমরা বাইরে থেকে সহজে লোন সহযোগিতাগুলো পাব না। আমাদের ফরেন রিজার্ভ বিল্ডাপ হওয়া কঠিন হবে। এটা এখানে ধরে রাখা হয়তো প্লাস পয়েন্ট হবে কিন্তু আমাদেরকে যদি হায়ার প্রাইসে আমদানি করতে হয় তাহলে ফরেন একচেঞ্জের ওপর একটা বড় রান দেখা দেবে। দেশে জিডিপি গ্রোথের কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে দেশে ১০ শতাংশ মানুষের হাতে সমস্ত সম্পদ চলে যাচ্ছে। আজকে যারা সংসদ সদস্য তাদের অনেস্ট থাকা উচিত ছিল। তাদের সম্পদ যদি এভাবে বাড়ে তাহলে আমাদের সোসাইটি দুর্নীতিমুক্ত কীভাবে করা যাবে।’

ইনফ্লেশনকে আরেক বড় সমস্যা উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এটা কন্টেন করতে পারবে বলে আমার কাছে মনে হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত টাকা ভার্সেস ডলারের রেটটা স্টেবল করা না যায়। সিন্ডিকেট করে টাকা সাপ্লাইয়ের যে মেকানিজম করানো হয়েছে বিভিন্ন সেক্টরে, সেটাকে যদি ডিস্কেন্টেন না করানো যায় তাহলে কোনো ক্রমেই ইনফ্লেশন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ইন্টারনাল সিন্ডিকেট স্ট্রাকচার যে তৈরি হয়েছে, ভোজ্যতেল, চিনি পেঁয়াজ এটাকেই যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায় তাহলে তো ইনফ্লেশন নিয়ন্ত্রণে মানিটরি পলিসি দিয়ে, সুদের হার বৃদ্ধি করে বইপুস্তকে যে সনাতন ধারনা সেটা এখানে কাজ করবে না। আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা ঠিকই রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। কিন্তু এটা যারা পাচার করে তারা নিয়ে যাচ্ছে, তারা অ্যাকাউন্ট সিস্টেমে না গিয়ে অন্যভাবে পাঠাচ্ছে।

আরও পড়ুন

সংকটেও পরিচালন মুনাফা বেড়েছে অনেক ব্যাংকের

‘কয়েকটা ব্যাংকের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রথমবারের মতো মানুষ আঁচ করতে পারছে এসব ব্যাংক নিরাপদ কি না। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে আমাদের বর্তমানে অর্থনীতির যে অবস্থা এতে ২০২৩ এর চেয়ে ২০২৪ অর্থনীতি ভালো যাবে এটা বলা যায় না। আমাদের ইন্টারনাল নির্বাচনকে আমরা যদি পার্টিসিপেটরি না করি এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করতেছে।’-বলেন আবু আহমেদ।

dollar

তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ না হলে ২০২৪ সালের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নতি হবে বলে মনে করছেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির সভাপতি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি ২০২৪ সালে ইকোনোমি ইম্প্রুভ হবে। আমাদের গার্মেন্টসের এক্সপোর্ট নতুন বছরের মাঝামাঝি থেকে পিক করবে। ২০২২ সালে আমাদের ভালো গ্রোথ ছিল, ২০২৩ আমরা আগে থেকেই জানি যে নেগেটিভ গ্রোথ হবে। যেসব দেশ গার্মেন্টস এক্সপোর্ট করে সবার জন্যই নেগেটিভ গ্রোথ ছিল। ২০২৩ সাল যে চ্যালেঞ্জিং ইয়ার গেছে আমাদের জন্য তো গ্যাসের দাম বেড়েছিল, ইলেকট্রিসিটির দাম বেড়েছিল। আমরা নতুন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। আমাদের সেক্টরে আমরা বেশ কিছু ইম্প্রুভ করেছি।

ফারুক হাসান বলেন, ‘আগামীতে আমাদের একটা চ্যালেঞ্জ হলো যে ফরেন কারেন্সির ওপর যে একটা বড় প্রেসার আছে, জানি না এটা কতদিন থাকে। তবে ইনফ্লেশন মোটামুটি কন্ট্রোলে এসে গেছে। আমি মনে করি গ্লোবাল সিচ্যুয়েশন যদি খারাপ না হয় তাহলে নেক্সট ইয়ারের মাঝামাঝির পর থেকে ইম্প্রুভ করা যাবে। এখন পলিটিক্যাল একটা বিষয় আছে। যদি পলিটিক্যাল অবস্থা খারাপ না হয়। কারণ পলিটিক্যাল সিচ্যুয়েশন কী হবে এখনও কেউ ক্লিয়ার করে বলতে পারছে না। আমরাও আশাও করি না যে খারাপ হবে। কোনো কিছু আমাদের হাতেও নাই। আমি মনে করি, স্বাভাবিক থাকলে আমরা আমাদের সেক্টরে যে কাজ করেছি এবং করে যাচ্ছি, আশা করছি ভালো করব।

‘আমরা ভালো করলেই ব্যাংক ভালো করবে, ইন্সুরেন্স ভালো করবে, পোর্ট ভালো করবে সব কিছুই ভালো করবে। আমাদের ওপর নির্ভর করছে পুরো দেশের ইকোনোমি, আর আমরা নির্ভর করছি পলিটিক্যাল ও গ্লোবাল সিচ্যুয়েশেনের ওপর।’-বলেন ফারুক হাসান।

টিএই/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর