মুন্সিগঞ্জে পদ্মায় অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধের দাবিতে অর্ধ শতাধিক ট্রলার নিয়ে, নদীতে মহড়া দিয়ে, অভিনব প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এতে অংশ নেন ভাঙ্গনকবলিত ভিটে মাটিহীন শত শত অসহায় মানুষসহ স্থানীয় সংসদ সদস্য।
সোমবার সকাল সাড়ে ১০ টায় লৌহজংয়ের ঘোড়দৌর এলাকা থেকে নানা রকম ব্যানার ফেস্টুন হাতে ট্রলারে করে পদ্মাসেতু পর্যন্ত মহড়া দিয়ে,সেতুর নিচে দাঁড়িয়ে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ জানায় স্থানীয়রা।
বিজ্ঞাপন
এ সময় অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে নানারকম স্লোগান দিয়ে আগামীতে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি জানান।
এতে অংশ নেয় স্থানীয় সংসদ সদস্য, সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি ও বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সহ প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, দিনের পর দিন পদ্মায় অবৈধ বালু উত্তোলনের নৈরাজ্য চললেও, স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে কোন ধরনের জোরালো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন, এতে বর্ষা মৌসুমের আগেই ভাঙন ঝুঁকিতে পড়তে হয়েছে অসংখ্য পরিবারকে।
এছাড়াও প্রভাবশালী একটি মহল নিয়ন্ত্রণ করছে অবৈধ বালু উত্তোলনকারী এই সিন্ডিকেটকে,ফলে দ্রুত অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধের দাবি সকলের। পদ্মা নদী জুড়ে অভিনব এই প্রতিবাদ চলে বিকেল পর্যন্ত।
বিজ্ঞাপন
রহিম দেওয়ান নামের নদী ভাঙ্গন কবলিত এক ভুক্তভোগী বলেন, পদ্মার ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে আমার ভিটে মাটি বসত ঘর,হারিয়েছি বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন টুকু, বর্তমানে চারটি সন্তানসহ স্ত্রীকে নিয়ে, কোনরকমে দিন এনে দিনকে চলছে আমাদের সংসার,এসব অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে, ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বারবার দ্বারস্থ হয়েছি, শুধু আশার বাণী দিয়ে গেছে সবাই আমাদের,কেউ কথা রাখেনি নাইনি কোন ধরনের ব্যবস্থা,পরিনাম নিঃস্ব করেছে আমাদের।
প্রতিবাদে অংশ নিয়ে জুলেখা আক্তার নামের আরেক ভুক্তভোগী বলেন, তিল তিল করে প্রায় ৪৪ বছরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মানুষের বাড়িতে কাজ করে, সাঁজিয়েছিলাম স্বপ্নের সংসার, স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে ভালোই কাটছিল আমাদের দিন, তবে এসব অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের কারণে, ভিটে মাটি সহায় সম্বল হারিয়ে,পথে বসে আমার পরিবারটি আমি এইসব প্রভাবশালীদের বিচার চাই, মার মত কেউ যেন আর ভিটেমাটি হারা না হয়।
লৌহজংয়ের বড় বেজগাঁও এলাকার, ভাঙ্গন কবলিত ভুক্তভোগী সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ ফজলু মাতবর বলেন, দিনের পর দিন এসব অবৈধ ভালো উত্তোলনকারী বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি, কিন্তু কেউ কথা শোনেনি। যখনই প্রতিবাদ করেছি,তখনই মারধর সহ হুমকি ধামকি সইতে হয়েছে প্রতিটি দিন, অথচ প্রভাবশালী এইসব লোকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। কে বলবে আমাদের কথা, কে শুনবে আমাদের মত নিঃস্ব মানুষের হাহাকার, কেউ দাঁড়ায়নি ভিটামাটি হারিয়ে পথে বসে যাওয়া মানুষগুলো পাশে। আমি এদের বিচার চাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই জীবনের সব হারিয়েছি, প্রয়োজন হলে জীবন টুকুও দিয়ে দিব তবে পদ্মা থেকে আর ১ ইঞ্চি বালুও কাটতে দেয়া হবে না।
পদ্মা ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যাওয়া লৌহজং তেঊটিয়া ইউনিয়নের ভিটেমাটিহীন আরেক পঞ্চাশোর্ধ বৃদ্ধা ফুল বানু স্বপ্না বলেন, আমার মত কতশত পরিবার নিঃস্ব হয়ে আজ পথে বসে গেছে, যুগের পর যুগ কাটিয়েছি পদ্মা পাড়ে,গড়েছিলাম সাজানো সংসার, হঠাৎই পদ্মার ভাঙ্গন পথে বসিয়ে দিয়েছে আমাদের,স্বামীকে হারিয়েছি ২০ বছর পেরিয়ে গেছে,শুধুমাত্র স্বামী স্মৃতি চিহ্ন ভিটে মাটি টুকু বুকে আগলে ধরে বেঁচে ছিলাম সেটুকু হারিয়েছি এবছর,গেল কয়েক বছর ধরে যেভাবে পদ্মায় অবৈধভাবে বালুকাটা হচ্ছে,এ ব্যাপারে যদি ব্যবস্থা নিতো প্রশাসন অথবা জনপ্রতিনিধিরা। তাহলে আজ পথে বসতে হতো না,অনেক পরিবারকে।
শুধু ভিটে মাটিই নয়, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের কারণে, শশুর-শাশুড়িসহ স্বামীর কবর টুকুও বিলীন হয়েছে নদীতে,চোখের জলে বুক ভেসেছে আমাদের। কেউ শোনেনি আমাদের কথা, এখন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি,নিজেদের যার কাছে যা কিছু আছে তা দিয়েই প্রতিরোধ গড়ে তুলবো এসব বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে। প্রয়োজনে একাত্তরের এর মত যুদ্ধ করবো তবুও এসব বালু দস্যুদের কোন ছাড় দেয়া হবে না।
এদিকে প্রতিবাদ র্যালিতে অংশ নিয়ে মুন্সিগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য, অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, ৪৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চলছে পদ্মা সেতুর বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ,অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে প্রকল্প এলাকায়, ভিটে মাটিসহ বিভিন্ন গাছপালা বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদী গর্ভে, ভাঙ্গন প্রতিরোধে চলতি মাসের ১৮ মে আবারো বরাদ্দ দেয়া হয় ৩২ কোটি টাকা, একদিকে বালু কেটে নিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের সদস্যরা ওদিকে ভাঙ্গন ঠেকাতে বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে যাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। স্থানীয় প্রশাসন গেল ছয় মাসে ১০০ টি ড্রেজার জব্দ করে মামলা দিয়েছে, প্রায় আড়াই কোটি টাকা জরিমানা করেছে,তবুও ঠেকানো যাচ্ছে না এসব প্রভাবশালীদের, গেল কয়েক বছরের ভাঙ্গনে নদীগর্ভে পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে উপজেলার দুটি ইউনিয়ন, একজন সংসদ সদস্য হিসেবে নিজের কাছে নিজেকে অসহায় মনে হয়, যখন কিছুই করতে পারিনা এসব ভাঙ্গন কবলিত মানুষগুলোর জন্য, স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে পারিনা নদী থেকে শতশত ড্রেজারে করে অবৈধ বালু উত্তোলন।
এমিলি বলেন, আমি প্রশাসন ও মন্ত্রণালয়ের কাছে জোরালো অনুরোধ করবো, দ্রুত এসব অবৈধ বালু উত্তোলন কারীদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়ে এটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে, সন্ধ্যে নামলেই শত শত বাল্কহেড এসে সিরিয়াল ধরে পদ্মা থেকে বালু নিতে। রাত গভীর হলেই শুরু হয় মাটিকাটা চলে ভোর পর্যন্ত। নিরুপায় সংসদ সদস্য হিসেবে আজ ভাঙ্গন কবলিত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে নিয়ে একজোট হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছি, আর যদি পদ্মা থেকে বালু উত্তোলন হয়, আর যদি কারো ভিটে মাটি ভেঙ্গে যায়, নিজেদের জীবন দিয়ে হলেও কাউকে এক ইঞ্চি ছাড় দেয়া হবে না।পদ্মার কোথাও ১ ইঞ্চি বালু কাটতে দেয়া হবে না। ঐক্যবদ্ধভাবে শতশত নিঃস্ব পরিবারকে সাথে নিয়ে প্রতিহত করবো বালুর দস্যু দের।
এজেড