শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

লোকমান হাকিম কি নবী ছিলেন? ছেলের প্রতি তাঁর উপদেশ কী?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৪:১১ পিএম

শেয়ার করুন:

লোকমান হাকিম কি নবী ছিলেন? ছেলের প্রতি তাঁর উপদেশ কী?

লোকমান হাকিমের নাম শোনেননি—এমন মানুষ খুব কমই আছে। জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। অনন্তকাল জ্ঞানপিপাসুরা তার জ্ঞান দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করবেন। তাঁকে আল্লাহ তাআলা বিশেষ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছিলেন এবং পবিত্র কোরআনে মানুষের নসিহত হিসেবে তাঁর কথাগুলো বর্ণনা করেছেন। তাঁর নামে পবিত্র কোরআনে একটি সুরা রয়েছে। নিজের ছেলেকে দেওয়া তাঁর উপদেশগুলো বিশ্বখ্যাত। 

আফ্রিকারই একটি অঞ্চল হচ্ছে হাবশা। যার বর্তমান অঞ্চল হলো ইথিওপিয়া এবং সুদানের কিছু অংশ। ইসলামের প্রথম হিজরত স্থল, সেখানকার বাদশা নাজ্জাসির ইসলাম গ্রহণ ও রাসুলুল্লাহ (স.)-এর প্রসিদ্ধ সাহাবি বেলাল (রা.)-এর জন্মস্থান হওয়ার কারণে অঞ্চলটি মুসলমানদের কাছে বেশ পরিচিত। আমাদের আলোচিত ব্যক্তি হজরত লোকমান হাকিম (আ.)-ও ছিলেন সেই হাবশার বাসিন্দা। হাবশিরা কালো ও মোটা ঠোঁটবিশিষ্ট হয়ে থাকে। জাবির (রা.) লোকমান হাকিমের দৈহিক বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, তিনি বেঁটে, চেপ্টা নাকবিশিষ্ট। ইমাম মুজাহিদ (রহ.) বলেন, তিনি ফাটা পা ও পুরো ঠোঁটবিশিষ্ট ছিলেন। তা সত্ত্বেও আজও লোকমান হাকিমের সুনাম ও নসিহতপূর্ণ কথা পুরো বিশ্বে পরিচিত। এর মাধ্যমে বুঝা যায়, জ্ঞান ও বুদ্ধি কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, বংশ বা সম্পদ দিয়ে অর্জনের বিষয় নয়। দুনিয়ার যে কোনো অঞ্চলে, বংশ বা জাতে জ্ঞানী ব্যক্তি জন্ম নিতে পারেন।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: নবীদের মধ্যে মহানবী (স.)-এর বিশেষত্ব

লোকমান (আ.) সকলের কাছে হাকিম হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হাকিম মানে হচ্ছে যার মুখ থেকে প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা বের হয়। লোকমান হাকিমের কথা ছিল অর্থবহ। মানুষের মাঝে তাঁর কথার প্রভাব ছিল ব্যাপক। এখনো তার কথাকে বাণী হিসেবে লিখে রাখা হয়। লোকমান (আ.) পেশাগত দিক থেকে ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি। সামান্য আয়ের মানুষ হলেও তিনি কখনো অর্থের জন্য অনৈতিক কাজে জড়াননি। সৎভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়েই তিনি জীবন চালাতেন। 

ওয়াহাব ইবনু মুনাব্বেহ (রহ.) এর মতে, লোকমান (আ.) আইয়ুবের (আ.) ভাগ্নে ছিলেন। তিনি দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন। ইমাম বায়জাবি (রহ.), অন্য মতানুসারে তিনি দাউদ (আ.)-এর সময়ও জীবিত ছিলেন। ইবনু আব্বাস (রা.)-এর বর্ণনায় আছে, লোকমান (আ.) একজন আবিসিনীয় ক্রীতদাস।

লোকমান হাকিম নবী ছিলেন কিনা সে ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। ইবনু আববাস (রা.), জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রা.) এবং সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (রা.) এর বর্ণনা উদ্ধৃত করে সুফিয়ান সাওরি রহ. বলেন, তিনি নবী নন, বরং আল্লাহর একজন সৎ বান্দা ছিলেন। ইমাম বাগবি (রহ.) বলেন, এ কথা সর্বসম্মত, তিনি নবী নন; বরং ফকিহ ও প্রাজ্ঞজন। যে আছার দ্বারা তাঁর নবী হওয়া প্রমাণ হয়, তা মূলত জইফ বা দুর্বল (মাজহারি, ইবনে কাসির, তাফসিরে সুরা লোকমান: ১২) 


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: পবিত্র কোরআনে কার নাম কতবার এসেছে

সাহাবি কাতাদা (রা.)-কে উদ্ধৃত করে ইবনু কাসির (রহ.) বলেন, মহান আল্লাহ লোকমান (আ.)-কে নবুয়ত ও হেকমতের মধ্যে একটি গ্রহণের অবকাশ দেন। তখন তিনি হেকমত (প্রজ্ঞা) গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আর আমি তো লোকমানকে হেকমত দিয়েছিলাম (এবং বলেছিলাম) যে, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো। আর যে শুকরিয়া আদায় করে সে তো নিজের জন্যই শুকরিয়া আদায় করে এবং যে অকৃতজ্ঞ হয় (তার জেনে রাখা উচিত) আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, প্রশংসিত।’ (সুরা লোকমান: ১২)

কেউ একজন তাকে নবুয়ত গ্রহণ না করার কারণ জিজ্ঞাস করলে তিনি বলেন, ‘যদি আমাকে নবুয়ত দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হত; তাহলে আমি তা গ্রহণ করলে আল্লাহর সাহায্য পেয়ে তাতে সফল হতাম। কিন্তু তা চূড়ান্ত না করে ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে, যে কারণে এ দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে আমি শঙ্কিত ছিলাম। তাই আমি হেকমতকে অগ্রাধিকার দিয়ে তা গ্রহণ করেছি।’ 

কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, লোকমান হাকিম বলেছেন, যে গুণগুলোর কারণে আল্লাহ তাআলা আমাকে এত উপরে উঠিয়েছেন, কোনো ব্যক্তি যদি সেগুলো অর্জন করতে পারে, তাহলে সেও আমার মতো মর্যাদার আসনে সমাসীন হতে পারবে। সেই গুণগুলো হলো- নিজের দৃষ্টিকে নিচের দিকে রাখা, জবানকে বন্ধ রাখা তথা চুপ থাকা, হালাল আয়ের ওপর সন্তুষ্ট থাকা, লজ্জাস্থানের হেফাজত করা, সত্য কথা বলা, অঙ্গিকার পূর্ণ করা, মেহমানের ইজ্জত করা, প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়া, অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার করা।

এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, লোকমান হাকিমকে একলোক এসে বলে, তুমি ওই ব্যক্তি না, যে আমার সঙ্গে মাঠে ছাগল চড়িয়েছ? আচ্ছা বলো তো, তুমি এত বড় হলে কীভাবে, লোকজন দূরদূরান্ত থেকে তোমার কথা শোনার জন্য আসে এবং তোমার এত বড়বড় মজলিস বসে? উত্তরে তিনি দুটি গুণের কথা বলেন। দুটি গুণের কারণেই আল্লাহ তাআলা তাকে এত বড় করেছেন। (এক) সদা সত্য কথা বলা। (দুই) অনর্থক কথা বলা থেকে বিরত থাকা।

আরও পড়ুন: সত্য বলার পুরস্কার

সাহাবি আবু দারদা (রা.) এর বর্ণনায় এসেছে, তিনি ছিলেন নীরবতা অবলম্বনকারী, সর্বদা চিন্তায় নিমগ্ন ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন ব্যক্তি। দিনে কখনো ঘুমাতেন না। কেউ তাকে থুথু ফেলা, নাক পরিষ্কার ইত্যাদি মানবীয় কাজ করতে দেখেননি (অর্থাৎ এগুলো তিনি নীরবে সেরে ফেলতেন)। (ইবনে কাসির) 

লোকমান হাকিম তাঁর ছেলেকে ১০০ উপদেশ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে সাড়াজাগানো ১০ উপদেশ এখানে তুলে ধরা হলো। যেগুলো পবিত্র কোরআনে সুরা লোকমানে উল্লেখ করা হয়েছে। 

১) আল্লাহর সঙ্গে শিরক না করা
২) মাতা-পিতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা এবং আল্লাহর পরে তাদেরও কৃতজ্ঞতা আদায় করা।
৩) পিতা-মাতা শিরক-কুফরি করতে নির্দেশ দিলে তাদের কথা মানা যাবে না। তবে তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক ভদ্র আচরণ অব্যাহত রাখতে হবে।
৪) অপরাধ যত ছোটই হোক, তা হতে বিরত থাকা অপরিহার্য। কারণ কেয়ামতের দিন আল্লাহ তা উপস্থিত করবেন।
৫) সালাত কায়েম করা।
৬) মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দেওয়া এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ করা।
৭) বিপদাপদ ও মানুষের দেওয়া কষ্টে ধৈর্যধারণ করা।
৮) মানুষকে অবহেলা করা যাবে না।
৯) চলাফেরায় অহংকারী মনোভাব পরিহার করে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা (খুব দ্রুতও নয়, মন্থরও নয়)
১০) নরম ও নিচু আওয়াজে কথা বলা। (সুরা লোকমান: ১৩-১৯)

আরও পড়ুন: পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত একমাত্র সাহাবি

উপদেশগুলো পবিত্র কোরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে—‘আর স্মরণ করুন, যখন লোকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল, ‘প্রিয় বৎস, আল্লাহর সাথে শিরক করো না; নিশ্চয় শিরক হলো বড় জুলুম। আর আমি মানুষকে তার মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দুই বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে আমার প্রতি ও তোমার মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। মাতা-পিতা যদি তোমাকে আমার সঙ্গে এমন বিষয়কে শরিক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই, তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে সহাবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে।

অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদের জ্ঞাত করবো। হে আমার প্রিয় বৎস, নিশ্চয় তা (পাপ-পুণ্য) যদি সরিষা দানার পরিমাণ হয়, অতঃপর তা থাকে পাথরের মধ্যে কিংবা আসমানসমূহে বা জমিনের মধ্যে, আল্লাহ তা-ও নিয়ে আসবেন; নিশ্চয় আল্লাহ সুক্ষ্মদর্শী, সর্বজ্ঞ। হে আমার প্রিয় বৎস, সালাত কায়েম করো, সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎকাজে নিষেধ করো এবং তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধরো। নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ। আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর জমিনে দম্ভভরে চলাফেরা করো না; নিশ্চয় আল্লাহ কোনো দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না। আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করো, তোমার আওয়াজ নিচু করো; নিশ্চয় সবচেয়ে নিকৃষ্ট আওয়াজ হলো গাধার আওয়াজ।’  (সুরা লোকমান: ১৩-১৯)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হজরত লোকমান হাকিমের জ্ঞানগর্ভ উপদেশ থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর