মানবজাতিকে দীনের পথে অটল রাখতে আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় সবশেষে পাঠিয়েছেন আমাদের প্রিয়নবী (স.)-কে। অন্য নবী-রাসুলদের তুলনায় তিনি ব্যতিক্রমী ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। নিচে বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো।
শ্রেষ্ঠ নবী: প্রিয়নবী (স.) হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন আমি আদম সন্তানদের সর্দার হব। আমিই সকলের আগে কবর হতে উত্থিত হব। সকলের আগে আমিই সুপারিশ করব এবং সর্বপ্রথম আমার শাফায়াত গ্রহণ করা হবে’ (মেশকাত: ৫৭৪১; সহিহ মুসলিম: ৩/২২৭৮; আবু দাউদ: ৬৪৭৩, তিরমিজি: ৩৬১৬)। অন্য হাদিসে এসেছে, কেয়ামতের দিন আমিই হব আদমসন্তানদের নেতা, এটা গর্ব নয়। আর সেদিন আমার হাতেই থাকবে ’মাকামে হামদের পতাকা’, এতেও গর্ব নয়। সেদিন আদম (স.)সহ সকল নবীগণই আমার পতাকার নিচে এসে একত্রিত হবেন। আর সকলের আগে আমি কবর ফেটে উত্থিত হব, এতেও গর্ব নয়। (মেশকাত: ৫৭৬১; তিরমিজি: ৩১৪৮; ইবনে মাজাহ: ৪৩০৮)
বিজ্ঞাপন
সারা বিশ্বের নবী: আদম (আ.) থেকে শুরু করে ঈসা (আ.) পর্যন্ত যত নবী-রাসুল এসেছেন তাঁরা ছিলেন গোষ্ঠী, এলাকা ও জাতিকেন্দ্রিক। কিন্তু আমাদের প্রিয়নবী (স.)-কে পাঠানো হয়েছে বিশ্বনবী হিসেবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের রহমতস্বরূপ প্রেরণ করছি’ (সুরা আম্বিয়া: ১০৭)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘হে নবী! বলে দিন, হে মানবজাতি, আমি হচ্ছি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসুল।’ (সুরা আরাফ: ১৫৮)
আরও পড়ুন: যে আমলের জন্য প্রতিযোগিতা করতে বলেছেন মহানবী (স.)
শেষ নবী: প্রিয়নবী (স.)-কে পাঠানো হয়েছে শেষ নবী হিসেবে। তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবেন না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘মুহাম্মদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন। বরং তিনি আল্লাহর রাসুল ও সর্বশেষ নবী’ (সুরা আহজাব: ৪০)। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি মুহাম্মদ, আমি আহমদ, আমি মাহি, অর্থাৎ আমার মাধ্যমে কুফরি বিমোচিত হবে, আমি হাশির, আমার (যুগের) পরই মানুষকে হাশরের মাঠে একত্রিত করা হবে এবং আমি হলাম আকিব (অর্থাৎ যার পরে আর কোনো নবী নেই)।’ (সহিহ বুখারি: ১/৫০০, ২/৭২৭; সহিহ মুসলিম: ২/২৬১; সুনানে তিরমিজি: ২/১১১)
চিরন্তন মুজেজা: অন্য নবী-রাসুলদের মুজেজা তাঁদের জীবদ্দশায়ই বর্তমান ছিল। তাঁদের ওফাতের পর তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। মুসা (আ.)-এর লাঠি, সালেহ (আ.)-এর উষ্ট্রী এবং নূহ (আ)-এর নৌকা এখন আর অবিকৃত অবস্থায় নেই। তাঁদের কাছে প্রেরিত কিতাবও অবিকৃত অবস্থায় নেই। কিন্তু আমাদের প্রিয়নবী (স.)-এর মুজেজা চিরন্তন। তাঁর ওফাতের পরও তাঁর অনেক মুজিজা এখনো বিদ্যমান আছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। তাঁর প্রধান মুজেজা হলো কোরআন মাজিদ।
বিজ্ঞাপন
সর্বোত্তম আদর্শ: প্রিয়নবী (স.)-কে সর্বোত্তম আদর্শ দিয়ে পাঠিয়েছেন মহান আল্লাহ। পবিত্র কোরআনে নবীজিকে ‘উসওয়ায়ে হাসানা’ বলা হয়েছে। মহানবী (স.)-এর গোটা জীবনে সব স্তরের মানুষের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই তোমাদের প্রত্যেকের জন্য রাসুলের মধ্যেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ’ (সুরা আহজাব: ২১)। মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আমি আল্লাহ তা’আলার পাঠানো অনুগ্রহ।’ (মেশকাত: ৫৮০০; শুআবুল ঈমান: ১৪০৪; দারিমি: ১৫; সিলসিলাতুস সহিহাহ: ৪৯০; সহিহুল জামি ২৩৪৫)
আরও পড়ুন: যে কারণে অমুসলিমরা নবীজির কাছে ঋণী
সর্বোত্তম চরিত্র: প্রিয়নবী (স.)-এর পুরো জীবনে হাজারো উত্তম চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে। তাঁর উত্তম চরিত্রের কথা ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর অবশ্যই আপনি মহান চরিত্রের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত রয়েছেন’ (সুরা আল-কলম: ৪)। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, নিশ্চয়ই আমি চারিত্রিক গুণাবলি পরিপূর্ণ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি। (মুসনাদে আহমদ: ৮৯৩৯)
প্রথম সৃষ্টি: আল্লাহ তাআলা মহানবী (স.)-কে সৃষ্টির আদিতে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু পাঠিয়েছেন সবশেষে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যখন আদম (আ.)-এর অস্তিত্ব ছিল না তখনো আমি নবী ছিলাম। সব নবী-রাসুল আমাদের প্রিয়নবী (স.)-কে চিনতেন। আল্লাহ তাআলা রুহের জগতে তাঁদের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন। যেমন—আল্লাহ তাআলার বাণী, ‘আর আল্লাহ যখন নবীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন যে আমি যা কিছু তোমাদের দান করেছি কিতাব ও জ্ঞান অতঃপর তোমাদের নিকট কোনো রাসুল আসেন তোমাদের কিতাবকে সত্যায়নের জন্য, তখন সে রাসুলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তার সাহায্য করবে।’ তিনি বলেন, ‘তোমরা কি অঙ্গীকার করেছ এবং এই শর্তে আমার ওয়াদা গ্রহণ করে নিয়েছ?’ তারা বলল, ‘আমরা অঙ্গীকার করেছি। ’ তিনি বললেন, ‘তাহলে এবার তোমরা সাক্ষী থাকো। আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী রইলাম।’ (সুরা আলে ইমরান: ৮১)
ব্যতিক্রমী ১০ গুণ: আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিবকে ব্যতিক্রমী ১০টি গুণ দান করেছেন। দুটি হাদিসে এই ১০ গুণের বর্ণনা রয়েছে। আমিরুল মুমিনিন আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স.) বলেছেন, আমাকে এমন কতিপয় বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছে, যা অন্য কোনো নবী-রাসুলকে প্রদান করা হয়নি। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! এ বৈশিষ্ট্য কী কী? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন—
১) ‘ভয়-ভীতি দিয়ে আমাকে সাহায্য করা হয়েছে।’ মহানবী (স.)-এর চেহারায় আল্লাহ তাআলা এমন আকর্ষণীয় রূপ দান করেছিলেন, যা দেখে শত্রুরা ভীত-শঙ্কিত হয়ে পড়ত। তাঁর ক্ষতি করার সাহস পেত না।
২) ‘আমাকে গোটা দুনিয়ার চাবি দেওয়া হয়েছে।’ অর্থাৎ দুনিয়া নবী (স.)-এর করতলগত এবং অধীন হবে। এ ক্ষমতা অন্য কোনো নবী-রাসুলকে দেওয়া হয়নি।
৩) ‘আমার নাম রাখা হয়েছে আহমদ, তথা অতি প্রশংসাকারী।’ এমন নাম কোনো নবী-রাসুলের রাখা হয়নি।
৪) ‘আমার জন্য মাটি পবিত্র বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।’ ফলে পানির বিকল্প হিসেবে এই উম্মতের জন্য মাটি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ। যেমন—তায়াম্মুমের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা যায়।
৫) ‘আমার উম্মতকে শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।’ রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, আমার উম্মতকে এমন তিন বৈশিষ্ট্য দান করা হয়েছে, যা অন্য কোনো উম্মতকে দান করা হয়নি। এক. সালাম, তা জান্নাতিদের অভিবাদন। দুই. সারিবদ্ধ হয়ে ইবাদত করা। এটি ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্য। তিন. আমিন বলা। এটি মুসা ও হারুন (আ.) ছাড়া কোনো নবীর সময় ছিল না। (ইবনে খুজাইমা)
মুসলিম শরিফের অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, ‘আমাকে ছয় জিনিস দিয়ে অন্য নবীদের ওপর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তন্মধ্যে একটি আগের মতো। ব্যতিক্রমগুলো হলো—
৬) ‘আমাকে সংক্ষেপে অধিক অর্থবহ কথা বলার যোগ্যতা দান করা হয়েছে।’
৭) ‘আমার জন্য গনিমত তথা যুদ্ধলব্ধ মাল হালাল করা হয়েছে, যা অন্য নবী-রাসুলদের সময় হালাল ছিল না।’
৮) ‘গোটা জমিনকে আমার জন্য মসজিদ ও পবিত্র স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।’ ফলে এই উম্মতের জন্য যেকোনো স্থানে নামাজ পড়া জায়েজ। অন্য নবীদের সময় এ সুযোগ ছিল না, তাদের উপাসনাগৃহে নামাজ আদায় করতে হতো।
৯) ‘আমি সমগ্র সৃষ্টির প্রতি প্রেরিত হয়েছি।’ নবী (স.) হলেন বিশ্বনবী। আর কেউ বিশ্বনবী নন। সবাই ছিলেন আঞ্চলিক ও নির্দিষ্ট এলাকার নবী এবং একই সময়ে কয়েকজন নবী ছিলেন।
১০) ‘আমার দ্বারা নবুয়ত সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।’ রাসুল (স.) বলেছেন, ‘আমি শেষ নবী, আমার পরে আর কেউ নবী হবে না।’ (মুসলিম)
আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবিব রাহমাতুল্লিল আলামিন মুহাম্মদ (স.)-কে প্রতিশ্রুত মর্যাদাপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত করুন। আমিন।