বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

আলেকজান্ডার থেকে চন্দ্রগুপ্ত: ভারতবর্ষের ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন

আজিম বাপ্পি
প্রকাশিত: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫০ এএম

শেয়ার করুন:

আলেকজান্ডার থেকে চন্দ্রগুপ্ত: ভারতবর্ষের ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন

বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজেতাদের মধ্যে অন্যতম, গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের একমাত্র লক্ষ্য ছিল পৃথিবীর প্রতিটি ভূখণ্ডকে জয় করা। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল সীমাহীন, এবং ভারতবর্ষ, যার বিশালতা ও সমৃদ্ধি তখনকার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল, তার দৃষ্টির বাইরে ছিল না। ভারতবর্ষের নদী, সমভূমি, বনভূমি, এবং সোনালি সমৃদ্ধি আকৃষ্ট করেছিল তাকে।

তবে, আলেকজান্ডার ভারতবর্ষে পা রেখেই জয়ের সব আশা হারালেন। ভারতবর্ষের সীমান্ত পার করার পর, তাকে এক কল্পনাতীত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। ভারতের জনযুদ্ধে তার সেনারা পরাস্ত হয়, এবং সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন একজন উদীয়মান নেতৃবর্গ—চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। সিংহাসন দখল করে, নন্দ রাজবংশকে পরাজিত করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মৌর্য সাম্রাজ্য। এভাবেই ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নিজের নামটি অমর করে রাখেন।


বিজ্ঞাপন


চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শুধু এক মহান যোদ্ধা ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক নিবেদিত রাজনৈতিক কৌশলবিদ। তার সাফল্য প্রায় এককভাবে চাণক্যের চিন্তাধারার ফল ছিল। চাণক্য, যিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিক, মৌর্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। চাণক্য, যাকে কৌটিল্য বা বিষ্ণুগুপ্ত নামেও জানা যায়, ছিলেন একজন অতীন্দ্রীয় কূটনীতিক। তার প্রজ্ঞা ও কৌশলে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রথমে নন্দ রাজবংশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে একের পর এক অভিযান চালান। ধননন্দের অপমানের প্রতিশোধ হিসেবে চাণক্য এমন একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন যা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি মজবুত করে।

kalinga-1024x557
কলিঙ্গ যুদ্ধ

প্রথম দিকে কিছু পরাজয়ের পর, চন্দ্রগুপ্ত এবং চাণক্য ধননন্দের বিরুদ্ধে বিজয়ী হন। ধননন্দের পতনের পর, খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১ সালে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধের পাটলিপুত্রে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন এবং নতুন রাজবংশের সূচনা করেন।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন এক অসামান্য শাসক, যিনি মিত্রতা, যুদ্ধ কৌশল, এবং রাজনৈতিক কূটনীতি একযোগে প্রয়োগ করে তার সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত করেছিলেন। ২৪ বছর পর্যন্ত রাজ্য পরিচালনার সময় তিনি একাধিক রাজনৈতিক চুক্তি এবং যুদ্ধের মাধ্যমে পরাধীন অঞ্চলগুলোকে একত্রিত করেছিলেন।


বিজ্ঞাপন


আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর, তার সাম্রাজ্য ভাগ হয়ে যায়, এবং তার সেনাপতি, সালোকাস নিকাটোর ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে অধিকার স্থাপন করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রথমে তার সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন এবং সালোকাস নিকাটোরের কাছ থেকে আক্রশিয়া, গেদ্রোসিয়া, পারোপামিসাদাই, এবং সিন্ধু নদ উপত্যকার বিশাল এলাকা অধিকার করেন। এর ফলে মৌর্য সাম্রাজ্যের পরিধি উত্তর-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হয়।

City_of_Patna_on_the_River_Ganges
শিল্পীর তুলিতে প্রাচীন পাটলীপুত্র

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যখন তার রাজত্বের শীর্ষে পৌঁছেছিলেন, তখন তিনি ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে ৪২ বছর বয়সে সিংহাসন ছেড়ে দেন। জৈন ধর্ম গ্রহণ করে দক্ষিণ ভারতে প্রবেশ করেন। তার পরবর্তী শাসক ছিলেন তার পুত্র বিন্দুসার। বিন্দুসারও সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে।

এমনকি, সম্রাট অশোকের আমলে মৌর্য সাম্রাজ্য তার পূর্ণ শ্রী বৃদ্ধির শিখরে পৌঁছায়। অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের পর, সাম্রাজ্যকে শান্তির পথে পরিচালনা করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটান। কিন্তু অশোকের মৃত্যুর পর, মৌর্য রাজবংশে শাসক শক্তির অভাব দেখা দেয়, এবং রাজ্য একের পর এক দুর্বল হতে থাকে।

অশোকের পর রাজ্য ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। তার মৃত্যুর ৫০ বছর পর, সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ, মৌর্য রাজবংশের শেষ সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করে শুঙ্গ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। পুষ্যমিত্রের হাতে মৌর্য সাম্রাজ্য পতিত হয়, এর মাধ্যমে প্রায় দেড় শতক পর মৌর্য রাজবংশের সূর্য অস্তমিত হয়।

Ashoka-the-Great-an-Indian-emperor-of-the-Maurya-dynasty-played-a-critical-role-in-helping-make-Buddhism-a-world-religion-1-1024x550
বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সম্রাট অশোক

মৌর্য সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ছিল জোরালো, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, কর এবং রাজকোষ থেকে রাজ্য পরিচালনা হয়ে আসত। সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখত সম্পদ, শিল্প, ও পণ্যবিক্রির উপর। রাজ্য ছিল সংগঠিত, সুচারু প্রশাসন ব্যবস্থা ও গুপ্তচরদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হতো।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য হিন্দু ছিলেন, কিন্তু শেষ জীবনে জৈন ধর্ম গ্রহণ করেন। তার পুত্র বিন্দুসারও অজীবিক ধর্মের অনুসারী ছিলেন, এবং অশোক পুরো রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্মের বাণী প্রচার করেন। মৌর্য সাম্রাজ্যে নানা ধর্মের অনুসারীরা বাস করতেন, যেমন হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, এবং নাস্তিকদেরও স্থান ছিল।

বিশেষজ্ঞদের মতে—মৌর্য রাজবংশের পতনের পিছনে ছিল শাসকশূন্যতা। অশোকের পর তার মতো কোনো শক্তিশালী এবং যোগ্য শাসক না থাকায় রাজ্য অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। ফলে মৌর্য সাম্রাজ্য ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যায় এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিকূলতা, অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও প্রতিবেশী রাজাদের আক্রমণের মুখে পতিত হয়।

অথচ একসময় ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ এলাকা, দক্ষিণ থেকে উত্তর-পশ্চিম পর্যন্ত, মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। শেষ পর্যন্ত, খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৫ সালে, পুষ্যমিত্র শুঙ্গের হাতে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয় এই মহাকাব্যিক সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত।

এইউ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর