বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

‘সিন্ডিকেটের’ কাছে অসহায় ভোক্তা

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৩৯ এএম

শেয়ার করুন:

‘সিন্ডিকেটের’ কাছে অসহায় ভোক্তা

রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ জায়গায় সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডার। সাধারণত বাসা-বাড়িতে রান্নার কাজে ১২ কেজি সিলিন্ডার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়। গত ২ ফেব্রুয়ারি ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম এক ধাক্কায় ২৬৬ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। যা এতদিন ১ হাজার ২৩২ টাকা ছিল।

দাম বৃদ্ধির এই ঘোষণার বেশ আগে থেকেই অস্বাভাবিক দামে বিক্রি হতে থাকে এলপিজি সিলিন্ডার। ১ হাজার ২৩২ টাকার সিলিন্ডার তখন বিক্রি হতো ১৫০০ টাকার উপরে। কোথাও কোথাও ১৬০০-১৭০০ টাকায় বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার অনেক জায়গায় এলপিজির কৃত্রিম সঙ্কটের খবরও পাওয়া গেছে।


বিজ্ঞাপন


ক্রেতাদের অভিযোগ, সরকারের নির্ধারিত দামে কোথাও এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে না। প্রায় সব দোকানেই সিলিন্ডার প্রতি ২০০-৩০০ টাকা বেশি নিচ্ছে।

রাজধানীর বাছিলা এলাকার শাহিন নামে একজন বলেন, এখানে কয়েকটা দোকানে এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হয়। সবাই ১৭০০-১৮০০ টাকার বেশি নিচ্ছে। সরকার নির্ধারিত দামের ধার ধারে না। বাধ্য হয়েই আমাদেরকে বেশি দামে কিনতে হয়। আমরা তো অসহায়। কে শুনবে আমাদের কথা।

ভোক্তা অধিকার বা সংশ্লিষ্ট কোথাও অভিযোগ করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযোগ করে আর কি হবে। তখন তো আমাকে আর সিলিন্ডারই দিবে না।

রাজধানীর বাসাবো এলাকার সাইদুর বলেন, আমরা তো ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি। এলপিজি সিলিন্ডার সরকার নির্ধারিত দামে কোথায়ও পাওয়া যায় না। বাড়তি দামে কিনতে চাইলেও অনেক সময় সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে সরকার দাম বেঁধে দিয়ে কি লাভ হচ্ছে?


বিজ্ঞাপন


এলপিজির দাম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অনেকে। হাফিজুর রহমান নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, গতকাল এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম আজ কত টাকা বেড়েছে? একটু ম্লান মুখে উত্তর দিলো, আজ টাকা দিলেও গ্যাস দিতে পারব না। কারণ জানতে চাইলে জানাল, সরবরাহ নেই। ডিলাররা ফোন রিসিভ করে না। গত চারদিনে চারশ টাকা বাড়িয়েছে গ্যাসের দাম। প্রতিদিন একশ করে বাড়ছে। তাও যদি গ্যাস পাওয়া যেত। এভাবে চলতে থাকলে কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে। পাশের বাসায় একগাদা মেহমান এসেছে। বাসায় রান্নার গ্যাস না থাকায় রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে এনেছে। রেস্টুরেন্টের রান্নার গ্যাস কখন শেষ হয়ে যায় কে জানে। ছোট বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য দুধ গরম করতে পারছে না আগুনের অভাবে। পুরোই আতঙ্কগ্রস্ত কারবার। বাসায় বলে দিয়েছি যেটুকু গ্যাস আছে তা কৌশলে কম খরচ করতে। রাইস কুকারে ভাতের সাথে আলু সিদ্ধ খেতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ডিম সিদ্ধ করা যেতে পারে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার রান্না করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গ্যাস সঙ্কট মোকাবেলায় আর কি কি ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা নিয়ে পারিবারিক আলোচনা অব্যাহত থাকবে।

আব্বাস মাতব্বর নামে আরেকজন লিখেছেন, ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম ১,৭০০ টাকা। দেশের সাধারণ জনগণ এখন বাপ-মা ছাড়া এতিমের মতো। জনগণের পক্ষে হক কথা বলার মতো কেউ নাই। এই দেশে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটই সব।

তবে খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, কোম্পানিগুলো বাড়তি দাম নিচ্ছে। তাই তারা বেশি দামে বিক্রি করছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকার এনএন ট্রেডার্সের বিক্রেতা বলেন, হঠাৎ করে কোম্পানিরা সঙ্কট দেখাচ্ছে। দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কাস্টমারদেরকে অনেক কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে।

কমলাপুর এলাকার আরেক খুচরা বিক্রেতা বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরেই গ্যাসের সরবরাহ কমিয়েছে কোম্পানিগুলো। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ খুবই কম। সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কোম্পানির কাছ থেকে আমাদের কিনতে হচ্ছে। ১২ কেজির একটি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে ১,৪৯৮ টাকা। কিন্তু কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে ১,৬০০ থেকে ১,৬৫০ টাকায়। আমরা বিক্রি করছি ১,৭০০ থেকে ১,৭৫০ টাকায়। আমাদের কিছু লাভ করতে হয়। বেশি দামে কিনে সরকার নির্ধারিত দামে তো বিক্রি করা সম্ভব না।

এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির কোষাধ্যক্ষ আবু তাহের করোশী গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে সরকার যে প্রাইস নির্ধারণ করেছে আমরা সেই রেটে গ্যাস পাচ্ছি কি না। এলপি গ্যাস উৎপাদক বা ম্যানুফ্যাকচারারদের জন্য সরকার যে রেট নির্ধারণ করে দিয়েছে তার চেয়ে বেশি দামে আমরা তাদের কাছ থেকে কিনছি। সেটার কাগজও আমার কাছে আছে। বেশি দাম দিয়েও তাদের কাছ থেকে আমরা গ্যাস পাচ্ছি না। কয়েক দিন সিরিয়াল দিয়ে বসে থাকতে হয়।

বাজারে গ্যাস সঙ্কটের বিষয়টি স্বীকার করেছেন এলপিজি অপারেটররা। তারা বলছেন, এলপিজির কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে না পারায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই জটিলতা না কমলে আসন্ন রমজানে পরিস্থিতি আরও তীব্র হতে পারে। সারা দেশে এলপিজি সিলিন্ডারের গ্রাহক প্রায় ৫০ লাখ। ২৬টি বেসরকারি কোম্পানি এসব গ্যাস বাজারজাত করে। ডলার সঙ্কটে চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে না পারায় বেশিরভাগ কোম্পানি লোকসানে পড়েছে। এরইমধ্যে সব কোম্পানির বিপণন ৪০-৫০ শতাংশ কমেছে।

এদিকে নাগরিক সমাজের নেতারা বলছেন, চিনি, তেলের মতো এখন এলপিজিতেও একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে। সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বাবায়ক মহিউদ্দীন আহেমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, এখানে একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে। এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বাড়ার কয়েকদিন আগে থেকেই ব্যবসায়ীরা জানে যে দাম বাড়ছে। তখন তারা সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে। গ্রাহকদের কাছে দাম বেশি নেয়। অপারেটর থেকে শুরু করে ডিলার, রিটেইলার, সাপ্লায়ারদের মধ্যে একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে। সবাই যার যার মুনাফা ভাগ করে নেওয়ার অপকৌশলে লিপ্ত।

তিনি আরও বলেন, একটা সিলিন্ডার যদি ১৮০০ টাকায় কিনতে হয়, একটা পরিবারকে দেড়-দুইটা সিলিন্ডার মাসে কিনতে হয়। একটা পরিবারে যদি চুলা জ্বালাতেই তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা যায়, তারপর বিদ্যুৎ, পানির বিলসহ কত কিছু আছে। দ্রব্যমূল্যের কথা নাইবা বললাম। এসবের পেছনে যদি এত ব্যয় হয় তবে সাধারণ মানুষ কিভাবে চলবে। মানুষের তো ইনকাম বাড়ছে না। মানুষ যাবে কোথায়। এসব লুটপাটের বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, গ্রাহকের কাছ থেকে অতিরিক্ত দাম নিলে আইন অনুযায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে। কেউ নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে গ্যাস কিনলে সরাসরি বিইআরসিতে অথবা জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এসব বিষয়ে তদারকি বাড়ানো উচিত।

উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ১২ এপ্রিলের আগ পর্যন্ত এলপিজির দর ছিল কোম্পানিগুলোর ইচ্ছাধীন। তবে ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল প্রথমবারের মতো দর ঘোষণা করে বিইআরসি। তখন বলা হয়, আমদানিনির্ভর এই জ্বালানির দাম নির্ধারণে সৌদি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে ভিত্তি হিসেবে ধরা হবে। ফলে সৌদির দর ওঠানামা করলে ভিত্তিমূল্যও ওঠানামা করবে। সেই ঘোষণার পর থেকে প্রতি মাসে এলপিজির দর ঘোষণা করে আসছে বিইআরসি।

টিএই/জেএম/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর