শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

যন্ত্রণার নাম হাইড্রোলিক হর্ন, বিকট শব্দে কান ঝালাপালা

ওয়াজেদ হীরা
প্রকাশিত: ৩১ আগস্ট ২০২২, ০২:৪৭ পিএম

শেয়ার করুন:

যন্ত্রণার নাম হাইড্রোলিক হর্ন, বিকট শব্দে কান ঝালাপালা
ছবি: ঢাকা মেইল

পাঁচ বছর আগে ২০১৭ সালে যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। এরপর থেকে যানবাহনে এমন হর্ন বাজালে গাড়িসহ তা জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু আদালতের এমন নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে অধিকাংশ যানবাহনে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার চলছেই। মামলা আর জরিমানাতেই পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সব উদ্যোগ সীমাবদ্ধ থাকলেও এমন হর্ন ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না। হাইড্রোলিক হর্নের যন্ত্রণার পাশাপাশি উচ্চ শব্দের সাইরেনের অহেতুক ব্যবহার মানুষের অস্বস্তির কারণ দাঁড়িয়েছে। বিরক্ত হয়ে কখনও তর্কাতর্কি বা হাতাহাতিতে জড়ানোরও ঘটনা ঘটছে। মানুষকে সচেতনতার পাশাপাশি ট্রাফিক বিভাগ অভিযান জোরদার করলে হাইড্রোলিক হর্নের এমন তাণ্ডব থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে কাজ করা সংগঠন নিসচা বিভিন্ন সময় হাইড্রোলিক হর্নের যত্রতত্র ব্যবহারে অতিষ্ট হওয়ার কথা তুলে ধরে তা বন্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদক্ষেপও চেয়েছেন। গতবার নিসচা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নিসচার উপদেষ্টা ম হামিদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, এটা চালকদের ঔদ্ধত্য বাড়িয়ে দেয়, তাদের বেপরোয়া করে তোলে।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: শিশুস্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে শব্দ দূষণ

ঢাকার পুলিশ কমিশনার এ বিষয়ে একবার আহ্বান জানালে অনেক গাড়িচালক ও মালিক হাইড্রোলিক হর্ন খুলে ফেলেছিলেন। তবে সম্প্রতি আবার তা বাড়ছে। বিশেষ করে বাইকারদের বেশি হর্ন ব্যবহার করতে দেখা গেছে। অনেক বাইকার তাদের গাড়ির নিজস্ব হর্ন খুলে দিয়ে বাস বা প্রাইভেটকারের হর্ন লাগাচ্ছেন।

গাড়ির হর্ন এভাবে পরিবর্তন করা অনুচিত বলে ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান। হাইড্রোলিক হর্নের পাশাপাশি উচ্চ শব্দের হুটার বা সাইরেনের অহেতুক ব্যবহার মানুষের বিরক্তির বিষয় জানা গেছে। ঢাকা মেইলের সরেজমিনে এই উচ্চ শব্দ নিয়ে মানুষের বিরক্তির প্রতিক্রীয়া উঠে এসেছে।

সম্প্রতি সাভার থেকে ঢাকা মেডিকেলে রোগী নামিয়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ফিরছিল একটি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স। উচ্চমাত্রার সাইরেন বাজায় অতিষ্ঠ হয়ে রোকেয়া হল গেটের একটু সামনে ফুটপাতে বসে থাকা কয়েকজন শিক্ষার্থী সেটিকে আটকায়। কেন এভাবে সাইরেন বাজাচ্ছেন জানতে চাইলে চালক কোনো জবাব না দিয়ে বলেন, এটি অ্যাম্বুলেন্স। রোগী না থাকলে সাইরেন বাজাতে হয় না শিক্ষার্থীরা জানালে চালক বলেন, জ্ঞান দেবেন না। ১০ বছর ধরে গাড়ি চালাই। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাড়তি তর্ক করায় সেই চালককে উত্তমমাধ্যম দিয়ে ছেড়ে দেন।


বিজ্ঞাপন


গত শনিবার (২৭ আগস্ট) মধুবাগে একটি মোটরবাইকের চালক হঠাৎ একটি গলির ভেতরে হর্ন দেন। প্রাইভেটকারের হর্নের কারণে মধুবাগের বায়োজ্যেষ্ঠ এক ব্যক্তি হাজি আক্কাস উদ্দিন অনেকটাই ধমকের সুরে মহল্লার ভেতর এমন হর্নের কারণ জানতে চান। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওই তরুণ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন আপনাকে বলতে হবে, আপনার টাকায় গাড়ি কিনেছি না রাস্তা আপনার?

burhanএকদিকে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজিয়ে অপরাধ করেছে তার ওপর বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে ব্যবহার খারাপ করায় এলাকার কতিপয় তরুণ কিল ঘুষি দিয়ে বাইক থেকে হর্ন খুলে রাখেন। পরে জানা যায়, ওই শিক্ষার্থীর নাম রাশেদুল হাসান। উত্তরায় থাকেন। ছুটির দিনে রামপুরায় বন্ধুদের বাসায় আড্ডা দিয়ে মধুবাগ হাতিরঝিল হয়ে ফেরার পথে এমন ঘটনা ঘটান তিনি।

মধুবাগ এলাকার বাসিন্দা জুলহাস উদ্দিন জানান, ‘মেইন রাস্তায় জ্যাম হলে মধুবাগের ভেতর দিয়ে হাতিরঝিল বের হয় অনেকেই। এখন গাড়ির চাপ বাড়ছে সারাক্ষণ প্যাঁ-পো কতো ভালো লাগে বলেন?’

আরও পড়ুন: ঢাকায় ৫৬ ভাগ ট্রাফিক পুলিশ কানে কম শোনেন

রাজধানীর অনেক মূল সড়কের পাশে অবস্থিত দোকানদাররা সারাদিন বিভিন্ন গাড়ির হর্ন শুনে অনেকটাই বিরক্ত। পান্থপথে ফার্নিচারের দোকানদার খালেদুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘সকালে দোকান খোলার পর থেকেই রাতে বন্ধ করা পর্যন্ত শব্দের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। এসি করা দোকান হলে শব্দ একটু কম লাগে। নানা রকম গাড়ির হর্ন এর মধ্যে পুলিশের, অ্যাম্বুলেন্সের বাজানো সুরতো আছেই।’

উচ্চ শব্দ নিয়ে গত বছর ডিসেম্বরে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, ধানমন্ডির যে বাসায় থাকি, সরকারি বাসা সেখানে রাত আড়াইটার সময় শুনি ট্যাঁ-ট্যাঁ শব্দ। একটা অ্যাম্বুলেন্স বোধ হয় যাচ্ছে। অথচ রাস্তা ফাঁকা, কোনো পথচারী নেই। তবুও সে সাইরেন বাজিয়েই চলেছে। আমাদের ঘুম ভাঙাল, পথচারী বা অন্য যারা রয়েছে কারও প্রতি ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপ নেই।

রাজধানী ছাড়াও ঢাকার বাইরের অনেক সড়কে রোগী না থাকলেও অনেক অ্যাম্বুলেন্সের চালককে বিনা কারণে সাইরেন বাজিয়ে চলতে দেখা গেছে। অনেক সময় অন্য গাড়ির আগে যাওয়ার জন্য, সাইড পাওয়ার জন্য বা উল্টোপথে চলার জন্য এমন করেন বলে একাধিক চালক ঢাকা মেইলকে জানিয়েছেন।

গাজীপুর থেকে আসা একটি অ্যাম্বুলেন্সের চালক টঙ্গিতে উল্টোপথে প্রবেশ করলে সেটিকে থামানো হয়। ভেতরে রোগী না থাকলেও কেন উল্টো দিকে ঢুকেছেন জানতে চাইলে চালক ওয়াহাব মিয়া বলেন, ‘জ্যাম আছে। দ্রুত যেতে হবে তাই উল্টো যাচ্ছি।’

২০১৮ সালের সর্বশেষ হালনাগাদ গাইডলাইনে সড়কে শব্দের তীব্রতা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হলেও রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের প্রতিনিয়ত জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া সীমার দ্বিগুণ মাত্রার শব্দের অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে। নগরবাসি নানা ধরনের হর্নে বিরক্ত। নগরে সুনশান পরিবেশ হয়তো হবে না, তবে এমন শব্দ দূষণ যতোটা কমানো সম্ভব সেই উদ্যাগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ।

রোগী না থাকলে সাইরেন বাজানো অপরাধ এটি জানেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আইন অনেক ভালো জানি। এসব আমাদের ডান-বাম হাতের খেলা।’

রাজধানীর অনেক সড়কে এমন উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানো নিয়ে অনেক সময় মারামারিও ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন সড়কে দেখা যায় হরহামেশাই অ্যাস্বুলেন্স প্রবেশ করছে উল্টো সড়কে। কখনো উচ্চ শব্দে হর্নও বাজছে। এর ভেতরে রোগী আছে না নেই তা তদারকি করতে দেখা যায়নি কোনো ট্রাফিক কর্মকর্তাকে।

sound-pollution1অ্যাম্বুলেন্স যেহেতু রোগী থাকবে এটি ধরেই নেন ট্রাফিকের কর্মকর্তারা। হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধের বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু তার কোনো বাস্তবায়ন তেমন নেই বলে অনেন সাধারণ মানুষ এটি নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন।

ঢাকার অনেক সরকারি কর্মকর্তা নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়িতে উচ্চ শব্দের হুটার বা সাইরেন লাগিয়ে শব্দ দূষণ বাড়াচ্ছেন বলে জানায় পুলিশ। পুলিশের এক কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাদের কর্মকর্তারা যারা মাঠে কাজ করছে, রাস্তাঘাট চলাচলের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তাদের অনেক অভিজ্ঞতাই খারাপ। অনেক উচ্চ কর্মকর্তাদের গাড়িতেও এমন সাইরেন আছে।’

আরও পড়ুন: শব্দ দূষণ রোধে আইন আছে, প্রয়োগ নেই

বিজয় সরণীতে দায়িত্বরত এক সার্জেন্ট বলেন, ‘আমরা অনেক সময় হাইড্রলিক হর্ন নিধনের অভিযান চালাই। এসব ব্যবহার নিষেধ থাকলেও বন্ধ হয়নি উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি উঠতি বয়সী তরুণরা বাইকে কিংবা প্রাইভেটকারে হাইড্রোলিক হর্ন লাগাচ্ছেন। দেখামাত্র আমরা সেগুলো খুলে নিচ্ছি।’

মিরপুরের এক সার্জেন্ট বলেন, জিপগাড়ি, পাজারো, প্রাডো, সেডান কারগুলোতেও ভিআইপি হর্ন নিয়মিত ঘটনা। অন্যান্য গাড়িতেও এখন ব্যবহার হচ্ছে। তবে ব্যক্তিগত গাড়িতে ভিআইপি হর্ন পেলে বড় জরিমানা করলেও সরকারি গাড়িতে করা যাচ্ছে না।’

জানা গেছে, তিনশ থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে বিভিন্ন মোটরপার্টসের দোকানগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে হুটার যা এক ধরনের ইলেকট্রিক হর্ন। সাধারণ মেকানিকরাই এগুলো গাড়িতে লাগিয়ে দিতে পারেন।

কারওয়ান বাজারে পিকআপ চালক কবির উদ্দিন এমন হর্ন লাগিয়েছেন। তিনি বলেন, এখনো পুলিশে ধরেনি। অনেক সময় পুলিশের সামনে বাজালেও কিছু বলে না।

কবির উদ্দিন আরও বলেন, এটি ভিআইপি হর্ন। সাধারণ হর্ন বাজালে পাত্তা দেয় না। তাই রাস্তায় চলতে গেলে হাইওয়েতে এটি খুব কাজে লাগে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (১৯৯৯ সালের গাইডলাইন) মানদণ্ড অনুসারে, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। ২০১৮ সালের সর্বশেষ হালনাগাদ গাইডলাইনে সড়কে শব্দের তীব্রতা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হলেও রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের প্রতিনিয়ত জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া সীমার দ্বিগুণ মাত্রার শব্দের অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে। নগরবাসি নানা ধরনের হর্নে বিরক্ত। নগরে সুনশান পরিবেশ হয়তো হবে না, তবে এমন শব্দ দূষণ যতোটা কমানো সম্ভব সেই উদ্যাগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ।

পরিবেশ অধিদফতরের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, দূষণে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন সচেতনতা। অধিদফতরের একটা শাখা শব্দ দূষণ রোধে কাজ করে যাচ্ছে অনবরত। আমাদের অভিযানও অব্যাহত আছে।

পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক মো. জিয়াউল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নীরব এলাকা ঘোষণা করেও খুব একটা কাজে আসছে না। ম্যাজিস্ট্রেট বসিয়ে (মোবাইল কোর্ট) কতক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ট্রাফিক পুলিশ সার্বক্ষণিক রাস্তায় থাকেন। শব্দ দূষণ কামাতে পুলিশকে ক্ষমতা দিতে হবে। ট্রাফিক যখনই অযাচিত হর্ন দেওয়া দেখবে তখনই জরিমানার আওতায় আনতে হবে। আর নাগরিকদের অনুরোধ করব, দেশটা সবার। পরিবেশ রক্ষায় সবারই ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।

ডব্লিউএইচ/এমআর

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর