ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে চলছিল সম্পর্কের টানাপোড়েন। দুই দেশের সরকার ও জনসাধারণের পক্ষ থেকেই পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ-অনুযোগ, কথার লড়াই চলছিল। অবশেষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় আট মাস পর শুক্রবার (৪ এপ্রিল) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রথম বার দুই সরকারপ্রধানের এই বৈঠককে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে দুই দেশই। দুই নেতার মধ্যে প্রায় ৪০ মিনিটের এই বৈঠকে সম্পর্কে নতুন করে উষ্ণতা ফিরতে পারে বলে আশা করছেন দুই দেশের জনসাধারণই।
শুক্রবার এই বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, বৈঠকে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ, ভারতে বসে উনি (শেখ হাসিনা) বিভিন্ন ইনসেনডিয়ারি (আক্রমণাত্মক) মন্তব্য করছেন, সেসব বিষয়ে কথা বলেছেন। এছাড়া সীমান্ত হত্যা, গঙ্গা চুক্তি নবায়ন এবং তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়েও কথা হয়েছে বৈঠকে।
বিজ্ঞাপন
বৈঠক শেষে ব্যাংককে সাংবাদিকদের এ ব্যাপারে ব্রিফ করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদি) একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।
ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বলেন, তিনি (মোদি) জোর দিয়ে বলেন, ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে জনকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাস করে। নরেন্দ্র মোদি দীর্ঘ সময় ধরে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার কথা তুলে ধরেন, যা উভয় দেশের জনগণের জন্য বাস্তব সুবিধা দিয়েছে। এই চেতনায়, তিনি আবারও বাস্তবতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ইতিবাচক এবং গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভারতের আকাঙ্ক্ষার ওপর জোর দেন।
বিজ্ঞাপন
বিক্রম মিশ্রি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আরও আহ্বান জানিয়েছেন, পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে যেকোনো বক্তব্য এড়িয়ে চলাই ভালো। সীমান্তে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং অবৈধ সীমান্ত পারাপার প্রতিরোধ বিশেষ করে রাতে, সীমান্ত স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বজায় রাখা প্রয়োজন।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি বাংলাদেশে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সম্পর্কে ভারতের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ সরকার তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নৃশংসতার সকল ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্যও জোর দিয়েছেন।
শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে বিক্রম মিশ্রি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক পত্র দিয়েছে। তবে হাসিনার প্রত্যর্পণের ব্যাপারে এ মুহূর্তে এরচেয়ে বেশি বলা তার জন্য ঠিক হবে না বলে জানান ভারতীয় কূটনীতিক।
ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সুসম্পর্ক রয়েছে। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং তার ভারতে আশ্রয় নেওয়াকে ঘিরে দুই দেশের মধ্য অস্বস্তি শুরু হয়।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে- এমন বক্তব্য দিতে দেখা যায় ভারতের গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে। মূলত এ ধরনের পরিস্থিতিতে দুই দেশের সম্পর্কের অস্বস্তি বাড়ে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার নিশ্চিত করতে চাইছে। কিন্তু শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর প্রশ্নে ভারতের অবস্থান পরিষ্কার নয় বলে অভিযোগ করে আসছে বাংলাদেশ। এছাড়া ভারতে বসে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার বিষয় নিয়েও ঢাকা আপত্তি জানিয়েছে একাধিকবার। এ নিয়ে দুই দেশই একে অন্যের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে এর আগে।
সেই সাথে গত বছরের জুলাই থেকেই বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসা দেওয়া প্রায় বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গ তো আছেই।
আর সবশেষ সম্প্রতি চীন সফরের সময় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য সম্পর্কে অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্য নিয়ে আরও সম্পর্কের টানাপোড়েন বেড়ে যায় বলে বিশ্লেষকেরা বলছেন। সেখানে তিনি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যকে 'ল্যান্ডলকড" বা ভূ-বেষ্টিত বলে উল্লেখ করেছিলেন। ড. ইউনূস বলেন, এই অঞ্চলে বাংলাদেশ হলো সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক। তার এই মন্তব্য ভারতের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
ড. ইউনূসের কথার সূত্র ধরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বিমসটেকে ভারতের কৌশলগত ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। তিনি মূলত দেশটির ৬৫০০ কিলোমিটার উপকূলরেখা এবং বিমসটেকের ৫টি সদস্য দেশের সঙ্গে ভৌগোলিক সংযুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরেন।
এমন নানা ইস্যুতে গত আট মাস ধরে দুই দেশের সম্পর্কে আস্থার ঘাটতি দেখা দেওয়ার প্রেক্ষাপটে ব্যাংককে ড. ইউনূস এবং নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার বৈঠকের রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে ড. ইউনূস ও মোদির মধ্যে বৈঠক হওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। সে সময় দুই নেতার সফরসূচির মধ্যে ভিন্নতার কারণে বৈঠক হয়নি। তবে ডিসেম্বরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বাংলাদেশ সফর করেছেন। এছাড়া পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন একাধিকবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবেশী দুই দেশেরই পরস্পরকে দরকার। এজন্য নিজেদের স্বার্থেই সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। দুই সরকারপ্রধানের এই বৈঠকের ফলে সম্পর্ক উন্নতি হবে বলেই মনে করছেন তারা।
জেবি