ফ্যাসিস্ট তকমা পাওয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতা ধরে রাখার পেছনে নিয়ামকের ভূমিকায় ছিল পুলিশ বাহিনী। আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত এই বাহিনীকে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করায়নি বিগত সরকার। এজন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ দেশের মানুষের ব্যাপক ক্ষোভ ছিল পুলিশের ওপর। ফলে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সবচেয়ে বেশি রোষানলে পড়ে পুলিশ। অনেক সদস্যকে প্রাণ দিতে হয়। রক্ত ঝরেছে শত শত পুলিশের। দেশের সিংহভাগ থানা জনরোষে পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। দেশের ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পুলিশ বাহিনী ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশে বড় ধরনের রদবদল করা হয়েছে। তবে নৈতিক অবস্থান থেকে দুর্বলতার কারণে পুলিশ বাহিনী গত পাঁচ মাসেও পুরোপুরি সক্রিয় হতে পারেনি। হাজার হাজার মানুষের রক্তের দাগ গায়ে থাকায় পুলিশ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এখনো সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে হচ্ছে পুলিশ বাহিনীকে। এই অবস্থায় নতুন বছরে পুলিশের সামনে ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জটাই বড় হয়ে দেখা দেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
মাঠে বল প্রয়োগ করছে না পুলিশ
গত কয়েক মাসে পতিত সরকারের লোকজন বিভিন্ন মোড়কে ও ব্যানারে নানা আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা করেছে। বর্তমান সরকারের পতন ঘটানোর অপচেষ্টাও চালিয়েছে। তবে জোরালোভাবে বল প্রয়োগ করে সেগুলো দমন করতে পারেনি পুলিশ বাহিনী। বাড়তি সহায়তার নিতে তাদের সেনাবাহিনীর দ্বারস্থ হতে হয়েছে। ৫ আগস্টের কয়েক দিন পর দেশের থানাগুলো চালু হলেও সেনাবাহিনীকে পাহারা দিতে হয়েছে। পাশাপাশি এখনো পুলিশ কোনো আন্দোলন, মিছিল ও সমাবেশ ঠেকাতে অন্য বাহিনীর সদস্যদের সাহায্য নিতে হচ্ছে।
পুলিশ হঠাৎ করে বলহীন হয়ে পড়ায় অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে আগের পুলিশ গেল কোথায়? আগে পুলিশ তো কথায় কথায় লাঠিচার্জ ও গুলি করে বসত। কিন্তু এখন সেটি করছে না কেন? প্রশ্ন উঠেছে, হাসিনার আমলে নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশ পুলিশ সদস্য অন্তবর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করতেই কি মাঠে সক্রিয় হচ্ছে না? তবে পুলিশ বাহিনীর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশকে অনৈতিক কাজে ব্যবহার করেছে পতিত সরকার। এজন্য পুলিশের পুরনো সেই ছন্দে ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে। পুলিশ বাহিনীকে জনমুখী করা এবং যেকোনো অনৈতিক কাজ থেকে বিরত রাখার প্রতি বর্তমান প্রশাসন সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
পুলিশ যে আগের মতো কাজ করছে না, এটি পুলিশের ঊর্ধ্বতনরাও স্বীকার করছেন। খোদ আইজিপি থেকে শুরু করে ডিএমপি কমিশনার পর্যন্ত পুলিশের এই সংকটের কথা স্বীকার করেছেন। আগের মতো পুলিশ সক্রিয় নয়, এই অভিযোগ এসেছে নাগরিকদের পক্ষ থেকেও। ফলে সম্প্রতি প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও মহানগরে নাগরিকদের সঙ্গে পুলিশেল মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তারা জনসাধারণের অভিযোগ ও পরামর্শ সরাসরি এসব মতবিনিময় সভায় শুনছেন। সেই অনুযায়ী পুলিশের প্রতিটি সদস্যকে কাজ করার তাগাদাও দিচ্ছেন ঊর্ধ্বতনরা।
পুলিশি নীরবতায় বেড়েছে অপরাধ
গত পাঁচ মাসে দেশে অপরাধ বাড়লেও মামলা তেমন হয়নি। আর যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোর নিয়মিত তদন্তেও তেমন আগ্রহ নেই পুলিশের। ফলে অপরাধীরা ঠিকঠাক ধরাও পড়ছে না। রুটিনমাফিক পুলিশ থানার কাজ করলেও মাঠে তেমন ছুটছে না। আগে জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ এ কল করলে দ্রুত নিকটস্থ থানার পুলিশ চলে আসত ঘটনাস্থলে। কিন্তু এখন সেটি ঘটছে না। ফলে অভিযোগকারীরা সুফল পাচ্ছেন না।
আরও পড়ুন
গত ৫ আগস্টের পর ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যায়। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে জনসাধারণ। পরে পুলিশি তৎপরতা বাড়িয়ে সেটি কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও ইদানীং ঢাকাসহ সারাদেশে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। বিশেষ করে ঢাকা সিটিতে গত পাঁচ মাসে শতাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেই অনুপাতে মামলার সংখ্যা কম।
ঢাকার নগরবাসীরা বলছেন, পুলিশ আগে রাত জেগে ভালো করে ডিউটি করত। যদিও ডিউটির চেয়ে তাদের ধান্দাটাই মুখ্য ছিল। এরপরও অপরাধীরা ছিল তটস্থ। কিন্তু ইদানীং তারা ডিউটি করলেও অপরাধী তেমন ধরতে পারছে না। তাদের সামনেই অনেক সময় ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। পুলিশ নীরব হয়ে দেখছে।
রদবদলে তছনছ, নতুন মুখের ছড়াছড়ি
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর পুলিশ প্রশাসনে একটা বড় রদবদল হয়। বিশেষ করে ঢাকা মহানগরে যেসব দলীয় অফিসার ছিলেন তাদের সবাইকে বদলি ও ওএসডি করা হয়। থানাগুলোতে এর প্রভাব পড়ে। জেলার পুলিশ এনে ডিএমপির থানাগুলোতে ওসি থেকে ডিসি পর্যন্ত করা হয়েছে। এই রদবদলে পুলিশে বিশাল পরিবর্তন এলেও তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না বাহিনীটি। এরই মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আইজি ও কমিশনারও করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও গতি আসছে না। পুলিশে তবে গতি আসবে সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে।
ঢাকায় উচ্চতর পদগুলোতে আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মীরা পুলিশ হয়ে বসেছিলেন। যা বিভিন্ন সময়ে তারা কথা ও কাজেও প্রমাণ দিয়েছেন। সেই অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য ঢাকা মহানগর থেকে শুরু করে সব ইউনিটে নতুন মুখের লোকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যারা কোনোদিন তদন্ত করেননি, সেই পদে দায়িত্ব পালন করেননি, সেই কাজের অভিজ্ঞতা নেই সেসব অফিসার ও সদস্যরা কতটুকু ভালো করবে সেটা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ডিএমপির এডিসি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আগের অফিসাররা ছিলেন দক্ষ। কিন্তু হঠাৎ করে একজন এডিসিকে ধরে এনে ডিসি পদে প্রমোশন দেওয়া হচ্ছে। এতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রশাসনে। কারণ সেই পদে তো তার অভিজ্ঞতা নেই।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশের ঊর্ধ্বতন পদগুলোতে ৫ আগস্টের পর ব্যাপক রদবদল হয়েছে। আইজিপি থেকে শুরু করে এসআই পর্যন্ত এখনো রদবদল হচ্ছে, সামনে আরও হবে। রদবদলের ফলে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে নতুন নতুন মুখ আসছে। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় এসব অফিসার সেইসব ইউনিটে কতটুকু ভালো করবেন, তা নিয়ে খোদ পুলিশে প্রশ্ন উঠেছে।
এমআইকে/জেবি