- ভালো আচরণের তাগিদ পুলিশ সদর দফতরের
- থানায় মিলছে সেবা, নেই দালালের উৎপাত
- পরিবর্তন এসেছে ট্রাফিক পুলিশের আচরণে
- বদলাচ্ছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আচরণও
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে সবচেয়ে বেশি জনরোষে পড়ে পুলিশ বাহিনী। স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার অভিযোগে বাহিনীটির ওপর ক্ষুব্ধ ছিল দেশের বেশির ভাগ মানুষ। এই অবস্থায় ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলে বড় ধাক্কা খায় পুলিশ। জনরোষে দেশের বেশির ভাগ থানা পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। কার্যত কয়েক দিন প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল পুলিশ বাহিনী। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুলিশকে নতুনভাবে সক্রিয় করে। ইতোমধ্যে এই বাহিনীতে আনা হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। পুলিশে সংস্কার প্রক্রিয়াও চলমান। এতে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত এই বাহিনীতে।
বিজ্ঞাপন
পুলিশের আচরণে পরিবর্তন আসার কথা স্বীকার করছেন সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, আচরণ ও কথায় পুলিশ এখন অনেকটা নম্র। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আচরণ পাল্টানোর তাগিদ এসেছে খোদ বাহিনীটির সদর দফতর থেকে। আইজিপি থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের আচরণ পাল্টাতে বারবার নির্দেশ দিচ্ছেন। এতে পুলিশ আগের চেয়ে অনেকটা জনবান্ধব বাহিনীতে পরিণত হওয়ার চেষ্টা করছে। পরিবর্তনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে পুলিশ বাহিনী অনেকটা পাল্টে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) সন্ধ্যায় গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে পুলিশের একটি গাড়ি পল্টন মোড়ে এসে বাঁক নেবে দৈনিক বাংলার দিকে। এসময় হঠাৎ গাড়ির সামনে পড়ে যান এক ব্যক্তি। তিনি থেমে গিয়ে গাড়ি চালককে চলে যেতে বলেন। কিন্তু চালক তাকে বলতে থাকেন- আপনি আগে যান, পরে আমি যাব। এভাবে প্রায় ৪০ সেকেন্ড চলার পর সেই ব্যক্তি রাস্তা পার হয়ে পূর্ব দিকের মোড়ে ওঠেন। এরপর পুলিশের সেই গাড়িটি দৈনিক বাংলার দিয়ে চলে যায়।
আরও পড়ুন
এমন অভিজ্ঞতা ঢাকা মেইলের কাছে বিনিময় করছিলেন চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র সাকিব আহমেদ চৌধুরী। পুলিশের এমন আচরণ দেখে তিনি অবাক হয়েছেন। তার মতে, পুলিশ আগের মতো নেই। আচার-আচরণ পুরো বদলে যাচ্ছে। যার চিত্র মিলছে রাস্তাঘাটে। বিষয়টিকে ইতিবাচক বলছেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
থানাগুলোতে মিলছে স্বস্তি
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর থানাগুলোতেও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। আগে থানায় গিয়ে সেবা নিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো ভুক্তভোগীদের। এছাড়াও ছিল দালালদের দৌরাত্ম। কিন্তু এখন চিত্র ভিন্ন। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা দ্রুত মামলা নিচ্ছেন। সেবা ও পরামর্শে দিয়ে দ্রুত বিদায় করছেন থানা থেকে। এতে জনমনে স্বস্তি ফিরছে।
সম্প্রতি মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে দেখা গেল, চারজন পুরুষ ও একজন নারী এসেছেন জমিসংক্রান্ত বিষয়ে অভিযোগ করতে। এসময় ডিউটি অফিসার পুলিশ সদস্য তাদের সব কথাবার্তা শুনে বিষয়টি আদালতের এবং এখানে পুলিশের কোনো এখতিয়ার নেই বলে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন। পরে তারা চলে যান। এভাবেই থানা পুলিশের সদস্যরা সুন্দর সেবা ও আচরণে মুগ্ধ করছেন আগন্তুকদের।
সদর দফতর থেকে ভালো আচরণের তাগিদ
এদিকে পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, এখন পুলিশের প্রতিটি ভার্চুয়াল মিটিংয়ে মাঠ পর্যায়ের পুলিশের আচরণে সংযত, বিনয়ী ও জনমুখী হওয়ার জন্য এসপিদের বলা হচ্ছে। এই বার্তা মাঠ পর্যায়ের প্রতিটি সদস্যকে দিতে তাগিদ দিচ্ছেন ঊর্ধ্বতনরা। এছাড়া জেলা থেকে বিভাগীয় পর্যন্ত প্রতিটি প্যারেডে অংশ নেওয়া পুলিশ সদস্যদের আলাদাভাবে মোটিভেশন করা হচ্ছে। ফলে অল্প দিনেই অনেকটা বদলে গেছে পুলিশের আচরণ ও কথার টোন।
পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া বিভাগের এআইজি ইনামুল হক সাগর ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আইজিপি স্যার সব সময় তার বক্তব্যে পুলিশকে জনগণের সাথে আরও ভালো আচরণ ও জনমুখী হওয়ার জন্য বলছেন, নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি এটা অব্যাহত রেখেছেন। এর মাধ্যমে তিনি তাদের উজ্জীবিত করছেন।’
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বাহিনীর কার্যক্রমকে আরও বেগবান করতে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিটি পুলিশ। মাঝে কমিউনিটির সাথে যে গ্যাপ তৈরি হয়েছিল সেটা পূরণ করার চেষ্টা চলছে। কাজের মাধ্যমে কমিউনিটির কাছে একটি আস্থার জায়গা তৈরির চেষ্টাও করছেন সাধারণ পুলিশ সদস্যরা।’
বদলাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশের আচরণ
ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই সাধারণ মানুষের। তবে সেই অভিযোগও আস্তে আস্তে কমে আসছে। ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের বিনয়ী হতে দেখা যাচ্ছে। অযথা গাড়ি থামিয়ে হয়রানির চিত্রও কমে আসছে।
শাহবাগ এলাকায় রিকশা চালান রুবেল সরকার। তিনি বলছিলেন, ‘স্যারেরা এখন আমদের আর গালাগালি করে না। কোনো ভুল করলে বুঝিয়ে বলে।’
শুধু রুবেলই নন, এমন ইতিবাচক কথা আরও অনেকেই বলেছেন। কথা হচ্ছিল ‘পাঠাও’ চালক চঞ্চলের সাথে। তিনি বলছিলেন, আগে যাত্রীর মাথায় হেলমেট না পেলে ট্রফিক সদস্যরা নানা কটুকথা বলতেন, জরিমানা করতেন। কিন্তু এখন তারা বুঝিয়ে বলছেন, কেন হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। ফলে আমরাও যাত্রীদের বুঝিয়ে হেলমেট পরাচ্ছি। তার মতে, আগের তুলনায় ট্রাফিক পুলিশের আচরণ অনেক বদলেছে। আগে ডিএমপিতে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যরা মারমুখী ও অসৎ ছিলেন বলে দাবি তার। এখন সেই সেই পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টে গেছে বলে মনে করেন তিনি।
আরও পড়ুন
কথা হয় ধানমন্ডি এলাকায় দায়িত্ব পালনরত এক সার্জেন্টের সঙ্গে। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, এখন আমাদের ভালো আচরণ করতে ওপর থেকে বলা হচ্ছে। আমরা যাতে রাগ হয়ে কারও সাথে কথা না বলি সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যারা আইন ভঙ্গ করছে তাদের বোঝাচ্ছি। আইন মানার তাগিদ দিচ্ছি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার খন্দকার নাজমুল ইসলাম ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা আমাদের সদস্যদের বলেছি তারা যাতে ভালো আচরণ করে। এরপরও অনেকে তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন।
তিনি সম্প্রতি একটি ঘটনা তুলে ধরেন। ঘটনাটি ঘটে আবুল হোটেলের সামনে। সেই সড়কে একটি রিকশায় দুই তরুণী উল্টো পথে আসছিল। এ সময় সার্জেন্ট আটকে দেন। এতে রিকশায় থাকা এক তরুণী ক্ষেপে যান এবং তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকেন। যার ভিডিও এখন সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে।
বদলাচ্ছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতনরাও
শুধু পুলিশের নিচের পদের নয়, ওপর লেভেলের কর্মকর্তাদেরও কথা ও আচরণের ধরন বদলাতে শুরু করেছে। যার চিত্রও মিলছে মাঠ পর্যায়ে। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে ছাত্র-জনতা বঙ্গভবন ঘেরাও করতে যান। সেখানে ডিউটি পালনকারী পুলিশ সদস্যদের মধ্যে মতিঝিল বিভাগের ডিসি ও ওসিও ছিলেন। সেখানে এক পর্যায়ে মতিঝিলের বিভাগের ডিসি শাহরিয়ার হাসান কনস্টেবলদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ডেকে বলছিলেন, ‘বাবারা তোমরা কে কোথায় এদিকে আসো।’ তখন তার পাশে থাকা এক কনস্টেবলের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলছিলেন, আমাদের এখনকার স্যারেরা খুবই ভালো। তারা ‘বাবা’ ‘ভাই’ ছাড়া কথাই বলে না। আর আগে তো গালি দিয়ে কথা বলতো।
আরও পড়ুন
রাজধানীতে অপরাধ বিটে কাজ করেন এমন কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিএমপির ঊর্ধ্বতনদের এখনকার আচরণ আগের তুলনায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এখন যারা দায়িত্বে আছেন তাদের কল করলে সুন্দরভাবে সময় নিয়ে কথা বলেন। সংবাদকর্মীরা কী বলতে চান তা তারা মনোযোগ দিয়ে শোনেন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পুলিশের ওপর যে ধকল গেছে তাতেই তারা পরিবর্তন হতে বাধ্য হয়েছেন। এরকম আচরণ বজায় থাকলে পুলিশ জনবান্ধব হয়ে উঠবে বলে প্রত্যাশা সবার।
এমআইকে/জেবি