ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনরোষে পড়ে পুলিশ। স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার অভিযোগে বাহিনীটির ওপর ক্ষুব্ধ ছিল দেশের বেশিরভাগ মানুষ। এই অবস্থায় ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলে বড় ধাক্কা খায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটি। জনরোষে দেশের বেশিরভাগ থানা কার্যত পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ে জনগণের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা বাহিনীটির চেইন অব কমান্ড। থানায় থানায় হামলা, অগ্নিসংযোগ, মারধর ও হত্যার ঘটনা ঘটে। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি পড়া বাহিনীটির অনেক সুবিধাভোগী কর্মকর্তা জনরোষ থেকে বাঁচতে চলে যান আত্মগোপনে। আবার অনেকে গ্রেফতার হন।
এমন অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পুলিশকে নতুনভাবে সক্রিয় করে। বাহিনীটিকে পেশাদার ও জনমুখী করতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে এই বাহিনীতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। চলমান আছে পুলিশে সংস্কার প্রক্রিয়াও। এতে ইতিবাচক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীটিতে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশকে সবসময় ক্ষমতাসীন দলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে এই বাহিনীর সদস্যরা জনগণের সেবক ভাবার পরিবর্তে নিজেদের প্রচণ্ড ক্ষমতার অধিকারী ভাবতে শুরু করেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারে থাকাকালীন বিগত ১৫ বছরে পুলিশে পদোন্নতিতে দলীয় পরিচয় প্রাধান্য পেত। প্রভাব দেখিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটানো, বাসা থেকে ধরে এনে মারধর, ঘুষ দাবি, রাজনৈতিক সভা সেমিনারে বাধা দেওয়াসহ নানা অপকর্মে নাম আসতো পুলিশের। এসব কাজ করে বাহিনীটির ভাবমূর্তি ধ্বংস করা হয়েছিল। ফলে জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জনরোষে পড়তে হয় বাহিনীটিকে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সংস্কার কার্যক্রমের মধ্যেই ধীরে ধীরে স্বরূপে ফিরছে পুলিশ। জনগণের আস্থা ফেরানোর জন্য সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। নানা কারণে বিতর্কিত এবং আওয়ামী লীগের হয়ে পুলিশকে রাজনৈতিক ব্যবহারে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তাদের কাউকে কাউকে সরানো হয়েছে আর কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন ইউনিটে ব্যাপক রদবদল করা হয়েছে।
এখনো পলাতক অনেক পুলিশ সদস্য
বিজ্ঞাপন
হাসিনা সরকারের পতনের দিন গত ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা করে বিক্ষুব্ধ জনতা। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেলে দেশের বহু থানা পুলিশশূন্য হয়ে পড়ে। সংকট নিরসনে এগিয়ে আসেন বিভিন্ন সময় বঞ্চিত থাকা পুলিশের সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতনরা। তারা পালিয়ে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। সরকারের তরফ থেকেও তাদের কর্মস্থলে ফেরার আহ্বান জানানো হয়। সাড়া পেয়ে অধিকাংশ পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দিলেও অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এখনো অনুপস্থিত।

পলাতকদের মধ্যে আছেন ডিএমপির সাবেক ডিবি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, অ্যাডিশনাল ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার, ঢাকা জেলার সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, সিটিটিসির সাবেক এডিসি আব্দুল মান্নান, সিটিটিসির বোম ডিসপোজাল টিমের প্রধান সানাউল হক সানিসহ প্রায় অর্ধ শত উর্ধতন কর্মকর্তা।
পলাতকের সংখ্যা কয়েক শ হবে বলে ধারনা করা হলেও বাহিনীটির দাবি এই সংখ্যা ১৮৭ জন।
পলায়নের নেপথ্যে
গত ১৫ বছরে ঢাকাসহ সারাদেশে দলীয় পরিচয়ে পুলিশে নিয়োগ হয়েছে। ফলে এসআই থেকে শুরু করে আইজিপি পর্যন্ত অনেক বড় পদধারীর ভূমিকা ছিল অনেকটা ‘দলীয় কর্মী’র মতো। পেশাগত কাজে তাদের ভূমিকা ছিল দলীয় কর্মীর মতো। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় পুলিশ সামনের সারিতে থেকে সরকারের নানা অন্যায় নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছেন তারা। বিশেষ করে সরাসরি গুলি করে হত্যার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধেই বেশি। তাদের গুলিতেই বেশি সংখ্যক আন্দোলনকারী প্রাণ হারান। আর এসব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে দলীয় পুলিশ অফিসারদের ভূমিকা ছিল সক্রিয়। তাদের নির্দেশে আন্দোলনকারীদের গুলি করে হত্যা করা হয়। ফলে শেখ হাসিনার পতনের দিনই পালিয়ে যান পুলিশের এসব বড় বড় কর্তা। তারা থানা, ফাঁড়ি ও অফিসগুলো থেকে পালিয়ে যান। আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে জুলুম, নির্যাতন করায় তারা পালিয়ে গেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। বিশেষ করে জুলাই-আগস্টে যারা সরাসরি গুলি চালিয়েছে তাদের মধ্যে ১৩৬ জন কনস্টেবল এখনো লাপাত্তা। আর অফিসার পর্যায়ে এই তালিকায় রয়েছে ৫১ জন।
কারাবন্দি অনেকে
শেখ হাসিনার পতনের পর অনেক পুলিশ সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যান। অনেকে দেশ ছেড়ে পালানোর সময় বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার হন। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই দুই মাস বিমানবন্দরে করা নজরদারি ছিল। পাশাপাশি যারা জুলাই আগস্টে গণহত্যায় জড়িত ছিল সেসব পুলিশ সদস্যরা যাতে কোনোভাবে দেশ ছাড়তে না পারে তার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। এর ফলে বিমানবন্দর ব্যবহার করে পালাতে গিয়ে কেউ কেউ গ্রেফতার হন। তার মধ্যে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফিসহ এক কন্সটেবলও আছেন। তাদের বিচার চলছে। শুধু এই দুজনই নন, গণহত্যায় জড়িত থাকায় পুলিশের সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুনকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
বন্ধ হয় হারুনের ‘ভাতের হোটেল’
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২৩ সালে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ কার্যালয়। বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভাত খাইয়ে টাইমলাইনে আসে ডিবি কার্যালয় ও সাবেক ডিবি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ। যা নেটিজেনদের মুখে ‘ডিবি হারুনের ভাতের হোটেল’ হিসেবে পরিচিত লাভ করে। তবে এই নামে ডাকলেও হারুন বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখতেন।
রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের খুব কাছের মানুষ হিসেবেও পরিচিতি ছিল ছাত্রলীগ করে আসা হারুনের। ডিবি প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার আগে তেজগাঁও বিভাগের ডিসি এবং নারায়ণগঞ্জ জেলার এসপি হয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের এসপি থাকাকালীন গুলশানের এক শিল্পপতির ছেলে ও তার স্ত্রীকে তুলে এনে ব্যাপক সমালোচনা জন্ম দেন। বিষয়টি আলোচনায় এলেও পরে তা ধামাচাপা পড়ে যায়।
হাসিনা সরকারের পতনের পর পালিয়ে যান হারুন। বন্ধ হয়ে যায় তার ‘ভাতের হোটেল’।
সংস্কার চলছে পুলিশে
মানুষের হারানো আস্থা পুনরুদ্ধার করতে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনসহ পুরো বাহিনী সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই অংশ হিসেবে সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা।
তারা বলেছেন, পুলিশ যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সংস্কার প্রস্তাবনায় তার প্রস্তাবনা আনা হয়েছে। যেকোনো সময় সংস্কার প্রস্তাবগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হবে বলে বাহিনীটির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
এমআইকে/এমআর