সোমবার, ৬ মে, ২০২৪, ঢাকা

‘এরকম একটি সন্তান হওয়াটা আমার মায়ের যেন বড় অপরাধ’

হাবীব ইমন
প্রকাশিত: ১৪ মে ২০২৩, ০২:৫৮ পিএম

শেয়ার করুন:

‘এরকম একটি সন্তান হওয়াটা আমার মায়ের যেন বড় অপরাধ’

এক। 

ষোল কী সতের বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছে। বয়সটা ছিল ঘুরে বেড়ানো। কলেজের ফাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো— আড্ডা মারা, হই-হই করে ছুটে চলা, এটাই হওয়ার কথা ছিল। ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন। চিরাচরিতভাবে মানুষের সেবা করবে, এইরকম মনোবাসনা ছিল তার ছোটবেলা থেকে। কিছুই হলো না। বহু প্রতিভা নিয়ে জন্মেও অনেক কিছুই অর্জন করতে পারেনি। তার-ওপর আমার জন্ম! একটা অসুস্থ সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে এদেশের মেয়েদের যে কী কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় উর্ত্তীণ হতে হয়, তা যারা ভালোভাবে জানতে চান, তারা আমার মায়ের জীবন বিশ্লেষণ করতে পারেন। 


বিজ্ঞাপন


আমার স্মৃতিতে পুরনো অনেক কথাই আর তেমন স্পষ্ট নেই। প্রথম প্রথম আত্মীয়-পরিজন, সমাজের অনেকের নানা বঞ্চনা শুনতে শুনতে মাকে ভীষণ অসহায় দেখতাম। কতরকম অভিযোগ-অনুযোগ, এরকম একটি সন্তান হওয়াটা আমার মায়ের যেন বড় অপরাধ।

আমার জন্মের পর অনেকজনের কথা তাকে শুনতে হয়েছে। তাতে ভেঙে পড়েননি তিনি। অথবা অস্পৃশ্য রাখেনি আমাকে। ছোটবেলায় মাইজদীতে তার সঙ্গে গার্লস স্কুলের বাসে চড়ে জিলা স্কুলে যেতাম। এ নিয়ে হয়তো মাঝে মাঝে তাকে বিভিন্নজনের কাছে বিব্রত হতে হয়েছে। গোপনে গোপনে চোখের পানি ফেলেছে। মেয়েদের সঙ্গে বাসে করে স্কুলে যেতে আমারও কেমন জানি লাগতো। 

ছোটবেলা থেকে যে পরিবেশ-প্রতিবেশে আমরা বড় হয়েছি সেখানে আমরা বিপথগামী-ই হতাম না শুধু, নিঃশেষও হতে পারতাম হয়তো! যদি সেখানে আম্মু আমাদের আগলে না রাখতেন, শাসনের ভেতরে না রাখতেন। তার আদর্শ আমাদের ভেতরে প্রকাশ না করতেন। হয়তো তাই হতো।

দুই।


বিজ্ঞাপন


আমার বাবা সারাজীবন বাইরে বাইরে চাকরি করেছেন। বদলির চাকরি ছিল তার। প্রথম দিকে আমরা তার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ফেনী ছিলাম। কিছুদিন চৌমুহনীতেও। বাবাকে পেতাম মাঝে মাঝে সাপ্তাহিক বন্ধগুলোতে। কোনো কোনো সপ্তাহে একদমই পেতাম না। পরে পুরো সময়টা কেটেছে বসুরহাট আর মাইজদীতে। এখন ঢাকায়।

কাজেই আমার মা শুধু জননী নন, বাবাও বটে —সংসারের সমস্ত অকল্যাণ থেকে সন্তানদের রক্ষা করার সম্পূর্ণ দায়িত্বটুকুই তাকে তুলে নিতে হয়েছিল নিজের কাঁধে। নিরাশ্রয়, নির্বান্ধব, অর্থহীনা, গৃহবধূর ঘাড়ে কীভাবে এমন দায়িত্ব পালন করে গেলেন, তা একমাত্র তিনিই জানেন।

আমার বয়স তখন চার বছর। সাবেক পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রখ্যাত নিউরো সার্জন ডা. রশিদ উদ্দীন আহমেদ আমার ব্রেইন অপারেশন করেন। একটা দোদুল্যমান অবস্থায় হাসপাতালে চার মাস আমাকে নিয়ে থাকতে হয়েছিল তাকে। কখনো ওয়ার্ডে, কখনো বারান্দায় বিছানা পেতে। আম্মুকে একা একা ডাক্তারের কাছে ছুটে যাওয়া, বাইরে থেকে ওষুধ আনা সবই করতে হয়েছে। অনেক কষ্ট করেছেন তিনি। কাল এখানে তো, পরশু সেখানে। নিজে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, কিন্তু আমার মুখে খাওয়া ঠিকই তুলে দিয়েছে। নিজের সুখ-স্বচ্ছন্দ্য সব ঢেলে দিয়েছেন আমার পেছনেই। আমার জীবনে আম্মুর মূল্য যে কতখানি তা একমাত্র আমি জানি। কোনদিন-ই আমি তা প্রকাশ করিনি। আপনজনদের প্রতি ভালোবাসা আমি কখনো প্রকাশ করতে পারি না। এটা আমার সলাজ। 

আমরা কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে থাকতাম তখন। ছোট্ট একটি বাসা। প্রখর রোদ এসে ভিড় করতো সেখানে। সারা ঘর গরমে তেঁতে থাকত। আমাদের তখন কোনো ফ্যান ছিল না। গায়ে বাতাস লাগার কোনো সুযোগও ছিল না। আব্বুর বেতন ছিল কম। আমার ওষুধের পেছনে বেতনের অনেক টাকাই চলে যেতে। আম্মু তখন আমাকে খাটের নিচে রাখতেন, যাতে কোন রোদ কিংবা গরম না ছোঁয়।

চোখের চিকিৎসার জন্য মাদ্রাজে গিয়েছি তখন। শংকর নেত্রনালয়ে আমার চোখের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তাররা অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে বলছে। আম্মু তো অপারেশনের কথা শুনে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সারাদিন একটা মাত্র হালকা রুটি খেয়ে কাটিয়ে দিলেন।

তিন। 

আমি কি আমার মায়ের ভক্ত! মাতৃভক্ত হওয়ার মধ্যে গর্ব আছে। এদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষরা ছিলেন গর্ভধারিণী জননীর পূজারী। বিদ্যাসাগর থেকে বিবেকানন্দ পর্যন্ত কেউ এর আলাদা নন। সন্ন্যাসী হয়ে সর্বস্ব ত্যাগ করেও বিবেকানন্দ তার জননী-চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারেননি; মৃত্যুর কিছুদিন আগেও তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করছেন সমস্ত কাজ থেকে ছুটি নিয়ে কিছুদিন মাতৃসেবা করবেন।

‘মা কেমন আছো?’ বললেই মায়ের বুক জুড়িয়ে যায়। তোমার ভালো হলেই তার সুখ, তোমার সাফল্যই তার স্বর্গ। এ-এক আশ্চর্য সৌভাগ্যের চাবিকাঠি, কত সহজেই আমরা আনন্দের এই স্বর্গলোকে পৌঁছাতে পারি, অথচ সেখান থেকে আমরা স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হচ্ছি।

আমার মা প্রচুর বই পড়েন। সেখান থেকে আমরা ভাইবোনরা বইপড়ার আনন্দটুকু খুঁজে পেয়েছি। বাসায় বইয়ের সংগ্রহ সবসময় ছিল। দস্যিবেলায় বইগুলো শুধু নেড়ে-চেড়ে দেখতাম। পড়তাম না কখনোই। আম্মু বই পড়তে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। আমাদের প্রচুর গল্প শোনাত। মুক্তিযুদ্ধের গল্প। রাক্ষস-খোক্কসের গল্প। মাঝে মাঝে কবিতা আবৃত্তি করেও শোনাত। একবার আম্মু স্কুলে পড়ার সময় নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটি আবৃত্তি করে প্রথম হয়েছিল। মাঝে মাঝে গুণগুনিয়ে গানও গাইত।

ছোটবেলা থেকে দেখতাম আম্মু প্রচুর পত্র-পত্রিকা পড়তেন। ম্যাগাজিন পড়তেন। এর মধ্যে বেগম পত্রিকাটা ছিল উল্লেখযোগ্য। বেগম পত্রিকাটা ছিল নারীদের একটি আদর্শ পত্রিকা। এখানে লেখক ছিল নারীরা। তাদের ছবিও ছাপা হতো।

চার। 

২০১০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সেদিন। আমার সম্পাদনায় একটি বই প্রকাশিত হয়। আব্বু-আম্মুকে দিয়ে মোড়ক উন্মোচন করাবো বলে সেদিন রাতে আমি বাসায় র‌্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে দুটো কপি নিয়ে আসি। আম্মু আমার বইটি দেখে কী যে খুশি হলেন। বইটা উৎসর্গ করি আব্বু-আম্মুকে। আমাদের সাফল্যে সবসময় তিনি হেসেছেন। ব্যর্থ হয়েছি, ঘুরে দাঁড়াতে সাহস দিয়েছে অকাতরে।

আমার মা সবসময় বলেন, তার সন্তানদের মধ্যে আমি নাকি সবচাইতে সুন্দর ছিলাম। রাজপুত্তের মতো। ধবল দুধের মতো আমার গায়ের রঙ ছিল। অসুস্থতার কারণে আমার সব রঙ উড়ে গেল। আমার সৌন্দর্য সারা শরীরের সবদিক থেকে ঝরে পড়েছে। এমন কোনো অসুখ নেই যা আমার শরীরে বাঁধেনি, এটা অবাক বিষয়; তাতে যে পরিমাণ ওষুধ গিলতে হয়েছে, তার প্রতিক্রিয়া কিছু তো রয়েছে। 

যার কথা বলছি, খালেদা পারভীন—আমার মা। শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন দীর্ঘদিন—৩৬ বছর যাবত। খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি। বহু প্রতিভা নিয়ে জন্মেও অনেক কিছুই অর্জন করতে পারেননি। অনেকটা নিজের চেষ্টায় পড়ালেখায় কিছুটা এগিয়েছেন, মাস্টার্স পাস করেছেন। শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে গেলেন। বিরামহীনভাবে কাজ করে গেছেন। চারিদিকে কত ছাত্র-ছাত্রী তার! কী করে তিনি আমাদের নিয়ে এ জীবন ভাসিয়ে রেখেছিলেন তাও এক বিস্ময়ের ব্যাপার। নিজের সেরাটা দেব, যাতে ওরা নিজেদের সেরা দিতে পারে এই সমাজকে। আমার মা আমার চোখে বিস্ময়, চোখে আনন্দ।

এনএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর