রোববার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

জলাতঙ্ক: যে রোগে মৃত্যু অনিবার্য

মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশিত: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১১:৫৫ এএম

শেয়ার করুন:

জলাতঙ্ক: যে রোগে মৃত্যু অনিবার্য

# জলাতঙ্কে মৃত্যু শতভাগ
# হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু কষ্ট কমানোর চেষ্টা করা হয়
# সড়কের অনিয়ন্ত্রিত কুকুর ও পোষা প্রাণীর কামড়ে বাড়ছে টিকা দেওয়ার সংখ্যা
# ভাদ্র মাসে কামড়ের ঘটনা বাড়ে, সতর্ক হওয়ার তাগিদ

জলাতঙ্ক, বহুল পরিচিত একটি রোগের নাম। রেবিস ভাইরাস জনিত এই জুনোটিক (প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়) রোগ এন্টার্কটিকা ছাড়া প্রায় সব মহাদেশেই দেখা যায়। জলাতঙ্ক রোগের কারণে প্রতি বছর বিশ্বে ২৪ থেকে ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশেও এই রোগে প্রকোপ রয়েছে। তবে কামড়ের পরপর ভ্যাকসিন গ্রহণ এবং সম্ভাব্য প্রাণীদের ব্যাপকভাবে ভ্যাকসিন প্রদানের ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেকাংশেই কমে এসেছে। এরপরেও শতভাগ প্রাণঘাতী এ রোগে মৃত্যু ঘটনা এখনও ঘটছে। 


বিজ্ঞাপন


জলাতঙ্ককে হাইড্রোফোবিয়া কিংবা পাগলা রোগও বলা হয়। আক্রান্ত রোগী পানি দেখে বা পানির কথা মনে পড়লে প্রচণ্ড আতঙ্কিত হয়ে পড়ে বলে এই রোগের নাম হয়েছে জলাতঙ্ক। প্রাণীবাহিত র‌্যাবিস ভাইরাসঘটিত রোগটির লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর আক্রান্ত রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশ পরিস্থিতি

দেশে জলাতঙ্ক ও কুকুরসহ প্রাণীর কামড়ের ঘটনার প্রধান চিকিৎসা কেন্দ্র রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। বর্তমানে হাসপাতালটিতে রোগীর অবস্থা জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. আরিফুল বাশার ঢাকা মেইলকে বলেন, একদম সঠিক সংখ্যাটি বলতে পারছি না। তবে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ রোগী ভ্যাকসিন নিতে আসে। এসব ব্যক্তি জলাতঙ্কে আক্রান্ত নয়। তারা নানাবিধ কামড় নিয়ে আমাদের কাছে আসে। এরা বেশিরভাগই কুকুর-বিড়ালের কামড় নিয়ে আসে। আবার অনেকে শিয়ালসহ অশনাক্ত প্রাণীর কামড় নিয়ে আমাদের এখানে টিকা নিতে আসে। এছাড়া চলতি বছরে আমাদের এখানে ৩০ জন জলাতঙ্ক রোগী ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন এখনও বেঁচে আছে। 

dog-special-news2-20221102231338


বিজ্ঞাপন


তিনি আরও বলেন, ভাদ্র-আশ্বিন মাসে টিকা নেওয়া মানুষের সংখ্যা কিছুটা বাড়ে। এ সময় কুকুরের কামড়ের ঘটনা বেড়ে যায়। এছাড়া বর্তমানে ঢাকায় বাইটের ঘটনা অনেকটাই বেড়ে গেছে। অনেকেই এখন কুকুর-বিড়াল লালন-পালন করেন। তারা কবে নাগাদ এসব প্রাণীকে টিকা দিয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন না। ফলে কামড় বা আচরের ঘটনায় আমাদের কাছে আসেন। কারণ জলাতঙ্ক নিয়ে আতঙ্ক রয়েছে। যারা প্রাণী পালন করেন, আমরা তাদের ওইসব পোষা প্রাণীকে ভ্যাকসিনেশন করিয়ে নিতে বলি। আর সড়কের কুকুর নিয়ন্ত্রণ ও ভ্যাকসিনেশনটা জরুরি। 

মৃত্যু অনিবার্য কেন?

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, জলাতঙ্ক খুবই মারাত্মক রোগ। কারণ যদি জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে মৃত্যু অনিবার্য। এ কারণে এ রোগে শতভাগ মৃত্যু বলা হয়। জলাতঙ্কের ভাইরাস মানুষের মস্তিষ্কে আক্রমণ করে। মস্তিষ্কের এরকম কিছু অংশ আক্রান্ত হয়, যার মাধ্যমে আমাদের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস চলে। এর ফলে রোগীর শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। পানি খেতে পারে না। তার খিচুনী হয়। কোনো কোনো ভাইরাস রোগের ওষুধ রয়েছে। যেমন- এইচআইভির, আবার করোনার সময় আমরা কোনো এন্টিভাইরাল ওষুধ পাইনি। যে ভাইরাল রোগের কোনো এন্টিভাইরাল নেই, আমরা তার কোনো চিকিৎসা করতে পারি না। ফলে রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত। জলাতঙ্ক তাদের একটি। 

আরও পড়ুন

নীরবেই প্রাণ কাড়ছে জলাতঙ্ক

সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালেন ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. আরিফুল বাশার ঢাকা মেইলকে বলেন, জলাতঙ্কে মৃত্যু শতভাগ হলেও কিছু রোগী বেঁচে যায়। আমাদের এখনও তিনজন রোগী বেঁচে আছে। তবে তারা পুরোপুরি সুস্থ হয় না। এই তিনজন একদম পঙ্গু হয়ে আছে। এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন, কিছু রোগী কামড়ের পর ভ্যাকসিন নেয়নি। আবার অনেকে নিয়েছে কিন্তু দেরি করে। কামড়ের পর ইমিউনোগ্লোবুলিন নিতে হয়, তা অনেকে নেয়নি। এসব রোগীর প্রেজেন্টেশন একদম রেবিসের মতো হয় না। যদিও এসব রোগী রেবিস হিসেবে শনাক্ত হয় কিন্তু তারা সারভাইব করতে পারে। 

জলাতঙ্ক রোগীকে হাসপাতালে কী চিকিৎসা দেওয়া হয়?

অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, জলাতঙ্কে মৃত্যু নিশ্চিত। তবুও হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মৃত্যুটা যেন অনেক কষ্টের না হয় সে চেষ্টা করা হয়। যেমন, এসব রোগী পানি খেতে পারে না। পানি দেখে ভয় পায়। আমরা তাদের আইভি ফ্লুইড দেই। বাতাসের কারণে খিচুনি বেড়ে যায়, ফলে তাকে ফ্যান ছাড়া রাখি। শব্দ পেলে এসব রোগী ভয় পায়, তাই কোনো শব্দ যেন না হয় এমন ঘরে রাখা হয়। আমরা আসলে তার মৃত্যুর জন্যই অপেক্ষা করি। কিন্তু সেটা যেন তুলনামূলক সহজ হয় সেই চেষ্টা করি।

dog-special-news3-20221102231441

ডা. আরিফুল বাশার বলেন, সারা পৃথিবীতে পরীক্ষামূলকভাবে যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হয় আমরা তাই রোগীদের দিয়ে থাকি। একটা সময় জলাতঙ্ক রোগীকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। যেহেতু তাদের কোনো চিকিৎসা নেই। তবে তারা খুবই কষ্ট করে অমানবিকভাবে মারা যেত। আমরা এমনটা চাই না। আমরা তাদের ভর্তি রাখি। আমরা মানবিক দিকটা বিবেচনা করি, তারা যেন অন্তত সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্টটা পায়। মৃত্যুটা যেন সহজ হয়। যেমন, আমরা তাদের নিশব্দ ও অন্ধকার কক্ষে রাখি। যেহেতু আলো-বাতাসে তাদের কষ্ট বেড়ে যায়। 

সরকারি উদ্যোগ ও সচেতনা

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন,  প্রতি বছর আনুমানিক চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষকে কুকুর, বিড়াল, শেয়াল, বানর, বেজির মতো জলাতঙ্ক ছড়াতে পারে এমন প্রাণী কামড় দেয়। একটা সময় বাংলাদেশে দুই হাজারের অধিক রোগী জলাতঙ্কে মারা যেত। ২০১১ সাল থেকে জলাতঙ্ক নির্মূল কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এখানে দুইটি মূল বিষয় রয়েছে। প্রথমত, ব্যাপকভাবে কুকুরকে টিকাদান এবং যাদেরকে সম্ভাব্য বাহক কামড় দেবে তাদের জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া। এটি কার্যকর করায় এখন মৃত্যু ১০০-এর নিতে নেমে এসেছে। এটিকে আরও নির্মূল করা সম্ভব যদি আমরা তিন রাউন্ড গণটিকা (কুকুরসহ সম্ভাব্য বাহক) কার্যক্রম শুরু করি। এর মধ্যে এক রাউন্ড টিকা সারাদেশে দেওয়া হয়েছে। দুই রাউন্ড টিকা ৪০ থেকে ৫০টি জেলায় এবং তিন রাউন্ড ছয় থেকে সাতটি জেলায় দেওয়া হয়েছে। এটি যদি সম্পূর্ণ এবং টানা কয়েক বছর করা যায় তাহলে সারাদেশ থেকেই জলাতঙ্ক নির্মূল করা সম্ভব হবে।

সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়ে প্রখ্যাত এই চিকিৎসক বলেন, জলাতঙ্ক খুবই মারাত্মক রোগ। লক্ষণ দেখা দিলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই কেউ কুকুর বা অন্যকোনো প্রাণীর কামড়ের শিকার হলে ক্ষত স্থান ১৫ মিনিট ধরে ধুতে হবে। আমাদের সকল জেলা হাসপাতাল এবং অনেকগুলো উপজেলা হাসপাতালেও টিকা নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এছাড়া খোলা বাজারেও টিকা পাওয়া যায়। 

ভাদ্র মাস কুকুরদের মেটিং উল্লেখ করে এ সময় কুকুর কিছুটা চঞ্চল হয়ে যায়। আর কামড়ের ঘটনা বেশি ঘটে। তাই সকলকে অধিক সাবধান থাকা ও কামড়ের ঘটনায় অবশ্যই টিকা নেওয়ার পরামর্শ দেন অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ।

এমএইচ/এমএইচএম

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর