মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ঢাকা

নীরবেই প্রাণ কাড়ছে জলাতঙ্ক

বোরহান উদ্দিন
প্রকাশিত: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:৫৫ পিএম

শেয়ার করুন:

নীরবেই প্রাণ কাড়ছে জলাতঙ্ক
দেশে প্রতি বছর আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ শুধু কুকুরে কামড়ের চিকিৎসা নেন। ফাইল ছবি

# এক যুগে মারা গেছেন ৭৫১ জন

# প্রতিবছর আক্রান্ত হয় আড়াই লাখেরও বেশি


বিজ্ঞাপন


# সময়মতো টিকা নিলে জলাতঙ্ক শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য

একসময় বছরে দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ জলাতঙ্কে মারা যেত। তবে ধীরে ধীরে জলাতঙ্ক রোগীদের বিনামূল্যে টিকাদানসহ নানা উদ্যোগে কমে আসতে শুরু করে মৃত্যু। যদিও রোগটিতে মৃত্যু শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনে সরকারের টার্গেট পূরণ এখনো অধরা। কারণ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রোগটিতে মারা গেছে ২৭ জন। আর সবমিলিয়ে গত এক যুগে দেশে জলাতঙ্ক হয়ে প্রাণ ঝরেছে ৭৫১ জনের।

চিকিৎসকরা বলছেন, এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে মৃত্যু অনিবার্য। তবে সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা তথা টিকা গ্রহণ করলে এ রোগ শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য।

যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা নীরবে প্রাণ কেড়ে নেওয়া এই রোগে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বহুলাংশেই কমে এসেছে। গতবছর কুকুরের কামড়-আঁচড়ে আক্রান্ত প্রায় সাড়ে চার লাখেরও বেশি রোগী সরকার কর্তৃক বিনামূল্যে দেওয়া জলাতঙ্কের টিকা নিয়েছেন। অন্যদিকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ২ লাখ ৫৬ হাজার ৮০১ জন এই টিকা নিয়েছেন।


বিজ্ঞাপন


 

আরও পড়ুন

পথেঘাটে কামড়াচ্ছে কুকুর, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ভিড়

যেখানে ২০২২ সালে জলাতঙ্কের টিকা নিয়েছেন ৪ লাখ ৫১ হাজার ৮৯৮ জন। আর ওই বছরে রোগটি ৪৫ জন মারা গেছেন।

 

তবে জলাতঙ্কে মৃত্যু শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত। আর এরমাঝেই অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) পালিত হয়েছে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস।

কীভাবে ছড়ায় জলাতঙ্ক

কুকুরের কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে জলাতঙ্ক ছড়ায়- অনেকের এমন ধারণা থাকলেও বিষয়টি তেমন নয়। কুকুরের পাশাপাশি বিড়াল, শিয়াল, বেজী, বানর, বাদুড়ের মাধ্যমেও জলাতঙ্ক ছড়াতে পারে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সঙ্গে অধিদফতরের পক্ষ থেকে এই ধরনের কোনো প্রাণির কামড় বা আঁচড়ের পর কত সময়ের মধ্যে টিকা নেওয়া হলে বিপদমুক্ত থাকা যায় তাও জানানো হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছর আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ শুধু কুকুরে কামড়ের চিকিৎসা নেন।

Vaccine2
দেশে প্রতি বছর আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ শুধু কুকুরে কামড়ের চিকিৎসা নেন। ফাইল ছবি

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ, লাইন ডাইরেক্টর সিডিসি) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম জানিয়েছেন, জলাতঙ্ক একটি মরণব্যাধি, যা কুকুরের কামড় বা আঁচড়ে সংক্রমিত হয়। এছাড়াও বিড়াল, শিয়াল, বেজি, বানর, বাদুড় এর মাধ্যমে ছড়াতে পারে। এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে মৃত্যু অনিবার্য। তবে সময়মত সঠিক ব্যবস্থা তথা টিকা গ্রহণ করলে এ রোগ শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য।

কীভাবে ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায় এর পরামর্শ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, কুকুর, বিড়াল, বানর, বেজি ও শিয়ালের কামড় বা আঁচড় দিলে সঙ্গে সঙ্গে ক্ষারযুক্ত সাবান পানি দিয়ে আক্রান্ত স্থান কমপক্ষে ১৫ মিনিট ধৌত করতে হবে। এরপর যথাসময়ে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা নিলে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

তিন ক্যাটাগরিতে দেওয়া হয় জলাতঙ্কের চিকিৎসা

দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, কুকুর বা প্রাণির কামড়ের শিকার ব্যক্তিকে ক্ষতের ধরণ অনুযায়ী তিন ক্যাটাগরিতে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

ক্যাটাগরি-১: অক্ষত চামড়ার লেহন, প্রাণির সংস্পর্শ কিন্তু কোনো আঁচড় বা ক্ষতের চিহ্ন থাকবে না। এ ক্ষেত্রে টিকা দিতে হবে না।

ক্যাটাগরি-২: আঁচড় বা ক্ষতের চিহ্ন আছে কিন্তু রক্তক্ষরণ নেই। এ ক্ষেত্রে অ্যান্টি র‍্যাবিস ভ্যাকসিন (এআরভি) দিতে হবে।

3
প্রতীকী ছবি

ক্যাটাগরি-৩: এক বা একাধিক রক্ত প্রবাহযুক্ত ক্ষত থাকলে, গলা, ঘাড় বা মাথার যেকোনো অংশে রক্তক্ষরণবিহীন ক্ষতের চিহ্ন থাকলে রোগীকে অ্যান্টি র‍্যাবিস ভ্যাকসিন ও র‌্যাবিস ইমিউনোগ্লোবুলিন-আরআইজি দিতে হবে।

একযুগে জলাতঙ্কে আক্রান্ত-মৃত্যুর পরিসংখ্যান কি বলছে?

স্বাস্থ্য অধিদফতরের জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের বুধবারের (২৭ সেপ্টেম্বর) তথ্যমতে, ২০১২ ও ২০১৩ সালে মারা গেছেন ৮২ জন করে। এই বছরে যথাক্রমে টিকা নিয়েছেন ১ লাখ ২৯ হাজার ৪৪৪ ও ২ লাখ ৫২ হাজার ২৭৫ জন।

পাশাপাশি ২০১৪ সালে জলাতঙ্কে মারা গেছেন ১০৬ জন। এই বছরে টিকা নিয়েছেন ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬২১ জন। আর ২০১৫ সালে মারা যান ৮৩ জন এবং টিকা নিয়েছেন ২ লাখ ৫১ হাজার ৩০১ জন।

এদিকে, ২০১৬ তে ৬৬ মারা যান জন এবং টিকা নেন ২ লাখ ৯৮ হাজার ৭৭২ জন। পরের বছর (২০১৭) রোগটি আক্রান্ত হয়ে মারা যান ৮০ জন। আর ওই বছরে জলাতঙ্কের টিকা নেন ২ লাখ ৫৮ হাজার ৪৪৫ জন।

Vaccine1

অন্যদিকে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ৫৭ জন হারান। পাশাপাশি এই দুই বছরে টিকা নেন যথাক্রমে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৪০৯ ও ২ লাখ ৫৩ হাজার ৮৬১ জন।

এছাড়াও ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে রোগটিতে মারা গেছেন ২৬ জন। সেই সঙ্গে ওই বছর জলাতঙ্কের টিকা নেন ১ লাখ ৫২ হাজার ১৪ জন। পাশাপাশি ২০২১ সালে জলাতঙ্কে ৪০ জন মারা যান এবং টিকা নেন ৪ লাখ ১৩ হাজার ৮৯৮ জন। এছাড়া ২০২২ সালে রোগটিতে মারা যান ৪৫ জন এবং টিকা নিয়েছেন ৪ লাখ ৫১ হাজার ৮৯৮ জন। এই হিসেবে গতবছর গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

আর চলতি বছর জুন পর্যন্ত ২৭ জন রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আর টিকা নিয়েছেন ২ লাখ ৫৬ হাজার ৮০১ জন। এরমধ্যে শিশু ও বয়স্করাও আছেন।

জলাতঙ্কের লাগাম টানতে সরকারের উদ্যোগ

২০১০ সাল থেকে সরকার জলাতঙ্ক রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হিসাবে গ্রহণ করে। স্বাস্থ্য বিভাগ, প্রাণিসম্পদ ও স্থানীয় সরকার বিভাগের যৌথ উদ্যোগে ২০১১-১২ সাল থেকে জলাতঙ্ক রোগ নির্মূল কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এছাড়াও জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে   জাতীয় কৌশলপত্র প্রস্তুত করে তা বাস্তবায়নে রোডম্যাপ তৈরি করা হয়। যা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের জুনোটিক ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা।

অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে সকল জেলা সদর হাসপাতাল ও ৩৩৮টির অধিক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমের দেশের সকল উপজেলায় জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।

অন্যদিকে মহাখালীতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও ঢাকার পাঁচটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে জলাতঙ্কের আধুনিক চিকিৎসা কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে।

এর বাইরে কুকুর বা অন্যান্য প্রাণির কামড়ের ঘটনায় এসব কেন্দ্রসমূহে আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্নভাবে বিনামূল্যে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা ইনজেকশন অ্যান্টি-র‌্যাবিস ভ্যাকসিন (এআরভি) ও কামড়ের ধরন অনুযায়ী ইনজেকশন র‌্যাবিস ইমুনোগ্লোবুলিন (আরআইজি) প্রদান করা হচ্ছে।

সবমিলিয়ে ইতোমধ্যে দেশের ৬৪টি জেলায় ১ম রাউন্ড, ৩৭টি জেলায় ২য় রাউন্ড এবং ৮টি জেলায় ৩য় রাউন্ড ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমের মাধ্যমে কুকুরকে প্রায় ২৭ লক্ষ ৭০ হাজার ডোজ জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকা দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

কুকুরের কামড়-আঁচড়ে ৯৯ ভাগ জলাতঙ্ক সংক্রমিত হয় জানিয়ে মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিটি রোগীকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। যারা মারা যাচ্ছে তাদের ডেথ রিভিউ করতে হবে। কোন কারণে মারা গেল, কেন জলাতঙ্কে আক্রান্ত হলো- তা বের করতে পারলে দেশকে জলাতঙ্ক মুক্ত করা সম্ভব।

বিইউ/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর