পরীক্ষা ও মুখস্ত নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে আগামী বছর থেকে শুরু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। প্রথম বছরই প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হবে। শিক্ষাক্রমে প্রথাগত পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে নতুন এই শিক্ষাক্রমকে শিক্ষাবিদরা যেমন ইতিবাচকভাবে দেখছেন ঠিক তেমিন এই শিক্ষাক্রম কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করছেন।
তারা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মূল ভূমিকায় থাকবেন শিক্ষকেরা। অথচ এখন পর্যন্ত দেশে শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। আবার শিক্ষকদের একটি বড় অংশের দক্ষতারও ঘাটতি রয়েছে। একই সঙ্গে দেশের ৩৩ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একই কাঠামোর মধ্যে আনা, সব শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলাসহ শিক্ষা সহায়ক উপকরণ ও বাজেট ঘাটতিসহ নানা কারণে শিক্ষাক্রমটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন বেশ চ্যালেঞ্জের।
এছাড়াও নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নপদ্ধতি বদলে যাবে বলে জানিয়েছেন সরকার। এতে পাল্টে যাবে প্রশ্নের ধরণও। তবে এই বদলে যাওয়া প্রশ্নের ধরন কী হবে, তা এখনো ঠিক করতে পারেনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। তবে শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা দাবি করছেন, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রশ্নের ধরন চলতি মাসেই ঠিক করা হবে। নভেম্বর নাগাদ পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শিক্ষাক্রম চলা বিদ্যালয়গুলোতে তা তারা পাঠাতে পারবেন। আর ডিসেম্বরে অন্য শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন এই শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রথমদিকে ১০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আরও ১০০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বাছাই করে ২০০টি স্কুলে নতুন কারিকুলাম পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে তা শুরু হয়নি। তথ্যমতে, পরীক্ষামূলক ছাড়াই আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে নতুন শিক্ষাক্রম সরাসরি বাস্তবায়ন শুরু করবে। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, আগামী বছর চালুর পর যদি কোনো ভুলত্রুটি ধরা পড়ে, তাহলে তখন তার আলোকে পরিমার্জন করা হবে।
এনসিটিবি কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের নতুন এই শিক্ষাক্রম আগামী বছর থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্রেণিতে পুরোপুরি চালু হবে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হবে। ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হবে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে চালুর মধ্য দিয়ে পুরোপুরিভাবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা আছে।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থী মূল্যায়নে বড় রকমের পরিবর্তন আসবে। প্রথাগত পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রথাগত কোনো পরীক্ষা হবে না। নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চলাকালে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক ভিত্তিতে সারা বছর ধরে মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে। আর প্রথম সাময়িকী, দ্বিতীয় সাময়িকী বা অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে যে মূল্যায়ন হয়, সেটাকে সামষ্টিক মূল্যায়ন বলা হয়; যা অপেক্ষাকৃত গতানুগতিক ও সহজ।
এই শিক্ষাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ৬০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। বাকি ৪০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে প্রথাগত পরীক্ষার ভিত্তিতে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ৬০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। ৪০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে পরীক্ষার ভিত্তিতে।
নবম ও দশম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ৫০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। বাকি মূল্যায়ন হবে পরীক্ষার মাধ্যমে। চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির অন্যান্য বিষয়ে পুরো মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। তবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে গিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়নে বেশি জোর দেওয়া হবে। এই স্তরে ৭০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে পরীক্ষার মাধ্যমে। বাকি ৩০ শতাংশের মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন।
বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নপত্র ও বহুনির্বাচনি প্রশ্নে (এমসিকিউ) পরীক্ষা হয়। সৃজনশীল পদ্ধতিতে একটি প্রশ্নকে চার ভাগে ভাগ করে উত্তর জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে বিদ্যমান কাঠামোয় প্রশ্নপত্র হবে না বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা। তাহলে ঠিক কেমন প্রশ্নে মূল্যায়ন হবে, তার কোনো উত্তর এখন পর্যন্ত জানাতে পারছে না এনসিটিবি।
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘এ বিষয়ে কিছু কাজ হয়েছে, হচ্ছে। আরও কিছু সময় নিয়ে এগুলো প্রকাশ করা হবে। নভেম্বর মাসেই পরীক্ষামূলকভাবে চলা বিদ্যালয়গুলোতে প্রশ্নের ধরন কেমন হবে, তা জানা যাবে। যাতে বার্ষিক পরীক্ষায় সেভাবেই মূল্যায়ন হয়। ডিসেম্বরে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষকদের পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ হবে। এই পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণের মধ্যে এক দিন বরাদ্দ থাকবে শুধু মূল্যায়ন নিয়ে।’
নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন বেশ চ্যালেঞ্জের দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, এটি বাস্তবায়নের প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, যে লক্ষ্য নিয়ে নতুন কারিকুলাম করা হলো সে লক্ষ্য অর্জন করতে অনেক শিখনসামগ্রী দরকার। এর প্রথম হলো পাঠ্যবই। তারপর শিখন উপকরণ, শিক্ষকদের ট্রেনিং ম্যাটেরিয়ালস। এমন বই লেখার যোগ্যতাসম্পন্ন লেখকের অভাব রয়েছে দেশে। বই লেখা, শিখন উপকরণ তৈরি, ট্রেনিং ম্যাটেরিয়ালস তৈরি করাটাও বড় চ্যালেঞ্জ। কারিকুলাম পাইলটিংয়ের জন্য যে বই লেখা হয়েছে সেখানে কনসেপ্টের বড় বড় ভুল রয়েছে। অল্প কয়েকটি বইয়েই যদি এত ভুল হয় আগামীতে এতগুলো বই লিখতে কত ভুল হতে পারে? এসব বই দিয়ে নতুন কারিকুলামের লক্ষ্য অর্জন করা বড় চ্যালেঞ্জ।
ড. ছিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ২০২৩ সাল দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি জাতীয় নির্বাচনের বছর। এ কারিকুলাম চালু করতে গিয়ে শিক্ষকরা যদি বাস্তবায়ন করতে না পারেন, সারা দেশে যদি এ নিয়ে নেতিবাচক পরিস্থিতি বা হইচই পরিস্থিতির তৈরি হয় তবে সেটি সরকারের জন্য বিব্রতকর হতে পারে। তাই এটি বাস্তবায়ন করা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে।
চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইলটিং করা যতটা সহজ, ৩৩ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেটি বাস্তবায়ন করা সহজ নয়, কারণ এতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে বর্তমানে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইলটিং (পরীক্ষামূলক) চলছে তার ফিডব্যাক অনেক ভালো।
এসএএস/এএস