ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলা সদরের মৃধাডাঙ্গি গ্রামের পদ্মার চরে ফসলি জমি থেকে মাটি ও বালি কেটে বিক্রি করছে সংঘবদ্ধ চক্র। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও সাহস পায় না সাধারণ মানুষ। তবে বছরের পর বছর এভাবে ফসলি জমির মাটি কেটে বিক্রি করার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ কৃষকরা। চলাচলের রাস্তা নষ্ট হয়ে গেছে। মাটি টানা গাড়ির চাপায় দুর্ঘটনায় মৃত্যুও হয়েছে। বাসাবাড়িতে ধুলাবালির স্তুপ জমে গেছে।
সাধারণ কৃষকেরা জানান, পাশের জমি থেকে এভাবে প্রতি বছর মাটি কেটে নেওয়ায় তাদের জমির ফসলও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বললেও কাজ হচ্ছে না। অপরদিকে বছরের পর বছর এভাবে পদ্মার চরের বালি ও মাটি লুটের ঘটনা ঘটলেও স্থানীয় প্রশাসন বলছেন, বিষয়টি তাদের জানা ছিল না।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে মৃধাডাঙ্গি গ্রামের পদ্মার চরে পৌঁছে দেখা যায়, উপজেলা সদরের বাজার থেকে এলজিইডির আঞ্চলিক পাকা সড়ক হয়ে মাত্র ২ কিলোমিটারের মতো দূরত্ব এই গ্রামের। পাকা সড়ক থেকে একটি মাটির রাস্তা নেমে গেছে সোজা চরের বুকে। নদী ভাঙনে পদ্মার এই চরের বাসিন্দারা প্রায় ৯ বারের মতো নদীভাঙা হয়ে এখন উপজেলা সদরের একেবারে কাছে এসে বসতি গেড়েছেন। চরের সাথেই মরা পদ্মা। শুকনো মৌসুমে পণ্যবাহী কার্গো এসে আটকে যায় নদীর বুকে। অন্যদিকে, চরের জেগে ওঠা জমির নতুন মাটিতে বাদাম, ভুট্টা, ধান ও কলইসহ নানা শষ্য আবাদ করা হয়েছে।
মৃধাডাঙ্গির চরের মাটির রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যেতেই ফসলি জমির মাঝ বরাবর মিলল একে একে পাঁচটি মাটি ও বালিভর্তি গাড়ি। শ্যালোইঞ্জিন দিয়ে স্থানীয়ভাবে বানানো লড়ির মতো দেখতে এসব গাড়ির কোনো বৈধতা নেই। তবে এখানে বালি ও মাটি টানার কাজে দেদারসে ব্যবহার চলছে। আর ভালো লাভ থাকায় অনেকে এভাবে গাড়ি তৈরি করে লগ্নিও খাটাচ্ছে এই অবৈধ ব্যবসায়।
এদিকে মাটি কাটার খবর সংগ্রহের জন্য সেখানে পৌঁছানোর পর মাটি ভর্তি গাড়ি ও মাটি কাটার বেলচা-কোদাল ফেলেই সেখান থেকে পালিয়ে যায় শ্রমিকেরা। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরেও তারা ফিরে আসেনি। সেখানে উপস্থিত লিটন মৃধা (৪৫) নামে একজন কৃষক জানালেন, জমির মালিকেরা এই মাটি বিক্রি করে দিয়েছে। আর মাটির ব্যবসায়ীরা এসব শ্রমিক দিয়ে কেটে গাড়ি ভর্তি করে বিক্রি করছে। এসব শ্রমিকদের কেউই স্থানীয় নন। তিনি জানান, প্রতিদিন আট-দশটি গাড়ি ভর্তি করে কয়েকশো গাড়ি বালি ও মাটি বিক্রি করা হয়।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় কৃষক সামসুল হক বলেন, তারা এই চরে ফসল বুনেন। তবে পাশের জমির মালিকেরা চুক্তি দিয়ে জমির মাটি বিক্রি করে দেয় প্রতিবছর। গত পাঁচ সাত বছর এভাবে মাটি বিক্রি করছে। এরমধ্যে মাটি টানা গাড়িতে একটা বাচ্চা মারাও গেছে। তিনি বলেন, এভাবে জমির মাটি বিক্রি করায় তাদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। সামসুল হকের ভাষায়, ‘রাস্তাগুলাতো থুইলোই না। পাকা রাস্তাও নষ্ট কইর্যা দিছে।’
ইসহাক বেপারী (৬১) নামে স্থানীয় একজন কৃষক বলেন, তিনি এখানে নিজেদের জমিতে বাদাম লাগিয়েছেন। নদীর চরের নতুন মাটিতে দারুণ ফসল হয়েছে। কিন্তু পাশের জমি থেকে মাটি কেটে নিচ্ছেন খোকন মোল্যারা। তিনি অভিযোগ করেন— তার ফসলি জমি থেকে দুই হাত রেখে তিনি তাদের মাটি কাটতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তাতে তারা কর্ণপাত করেনি। এখন তার জমির সাথে ঘেঁষে যেভাবে তারা মাটি কাটছে সেখানে তার ফসলি জমিও ভেঙে পড়ে যাবে।
আ. গফুর মৃধার ডাঙ্গি জামে মসজিদে নামাজ পড়তে আসা আব্দুল মান্নান (৫২) নামে একজন মুসুল্লি বলেন, এভাবে মাটি ও বালি টানার ফলে এলাকার রাস্তাঘাটের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। বাড়িঘরেও থাকা যায় না। ছেলে-মেয়েরা স্কুলে গেলে একটা টেনশনে থাকতে হয়। তিনি বলেন, বছরের বেশিরভাগ সময়ই এসব জমিতে ফসল হয়। আমরা চাই এভাবে যাতে মাটি বিক্রি বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন জোরদার ব্যবস্থা নেয়।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের একাধিক জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা বিষয়টি অন্যায় হিসেবে স্বীকার করলেও ভোটের রাজনীতির কারণে সাংবাদিকদের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এলাকাবাসী জানান, এই বালি ও মাটি লুটের সাথে জড়িতরা বড় গোষ্ঠীর। তাদের বিরুদ্ধে বলতে গেলে হামলার শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চরভদ্রাসন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানজিলা কবির বলেন, মৃধাডাঙ্গি গ্রামে এভাবে মাটি কেটে নেওয়ার বিষয়টি আমার জানা ছিল না। আপনাদের মাধ্যমেই জানলাম। দ্রুতই সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।
প্রতিনিধি/এইউ