রোববার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫, ঢাকা

সি-বিচে ‘ক্যামেরাম্যান’ আতঙ্ক: ব্ল্যাকমেইলসহ লাঞ্ছনার শিকার পর্যটক

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:২৩ এএম

শেয়ার করুন:

loading/img

ঈদের খুশিতে দুই বান্ধবিকে নিয়ে পতেঙ্গা সি-বিচে ঘুরতে গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম মহানগরীর এক বেসরকারি কলেজের অনার্স পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থী আয়াতুল্লাহ আহাদ ও আদনান। পড়ন্ত বিকেলে বিচের পাথরে বসে উপভোগ করছিলেন সুর্যাস্ত আর সাগরের বড় বড় ঢেউয়ের জলখেলি। এ সময় ক্যামেরা হাতে একজন এসে বলেন, ছবি তুলে দিই। না, বলার পরও ছবি তুলেন তিনি। একপর্যায়ে সিনক্রিয়েট করে তিনি বলেন, আমরা নাকি অসামাজিক কার্যকলাপ করতেছি। এ নিয়ে আমাদের নানারকম করুচিপূর্ণ কথাবার্তা বলতে শুরু করেন।

এরপর তিনি আরও চার সহযোগী ক্যামেরাম্যানকে ডেকে নিয়ে আসেন। তারা আমাদের দু’জনকে মারধর করে পকেটে থাকা টাকা ও মোবাইল কেড়ে নেন। বান্ধবিদেরও লাঞ্ছিত করে মোবাইল ছিনিয়ে নেন। জানাজানি হওয়ার ভয়ে বিষয়টি আমরা চেপে যাই।


বিজ্ঞাপন


রোববার (৬ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগরীর সেই কলেজের সামনে এসব কথা বলেন আয়াতুল্লাহ আহাদ ও আদনান। তারা আক্ষেপ করে বলেন, শুধু পতেঙ্গা সি-বিচে নয়, আনোয়ারা পারকি সি-বিচ, সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী ও বাঁশবাড়িয়া সি-বিচ, মিরসরাইয়ের শিল্পনগর সি-বিচ, বাঁশখালী সি-বিচ, কক্সবাজার সি-বিচ, ইনানী থেকে শুরু করে টেকনাফ এবং সেন্টমার্টিনেও দীর্ঘদিন ধরে এমন সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে ক্যামেরাম্যান চক্র। অথচ প্রশাসন কোনো সময় তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

তবে আশার কথা হচ্ছে, গত শুক্রবার (৪ এপৃল) এক নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে কক্সবাজার সি-বিচে প্রথমবারের মতো অভিযান চালিয়ে ১৭ জন ক্যামেরাম্যানকে আটক করে তাদের ক্যামেরা জব্দ করেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থাও। তাদের দাবি, এমন ব্যবস্থা যেন পতেঙ্গা সি-বিচসহ সবগুলো বিচে নেওয়া হয়।

thumbnail_Sea_beac-07.04_(3)

বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ট্যুরিস্ট পুলিশের চট্টগ্রাম বিভাগীয় অতিরিক্ত ডিআইজি বিধান ত্রিপুরা পিপিএম। তিনি বলেন, কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের সবকয়টি সি-বিচে ফটোগ্রাফার বা ক্যামেরাম্যানদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত অর্থ আদায় ও জোরপূর্বক ছবি চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।


বিজ্ঞাপন


ব্ল্যাককমেইল করে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। এমনকি পর্যটকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও লাঞ্ছিত করার অভিযোগও রয়েছে। ফলে গত শুক্রবার (৪ এপৃল) বিকেলে কক্সবাজার সি-বিচে অভিযান চালিয়ে এমন ১৭ জন ক্যামেরাম্যানকে আটক করে তাদের ক্যামেরা জব্দ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজারে ঘুরতে আসা এক নারী পর্যটক অভিযোগ করেন, ২০-৩০টি ছবি তোলার নামে ৬০০ ছবি তোলার দাবি করে ক্যামেরাম্যান দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন। গত কয়েকদিনে পর্যটকদের কাছ থেকে এমন একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে ট্যুরিস্ট পুলিশ কঠোর অবস্থানে যায়।

তিনি বলেন, যেসব ক্যামেরাম্যান পর্যটকদের হয়রানি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১৭ জন ক্যামেরাম্যানের ক্যামেরা জব্দ করা হয়েছে এবং তাদের পরিচয়পত্র (কার্ড) বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যারা প্রকৃত ক্যামেরাম্যান নন এবং যাদের বৈধ কার্ড নেই, তাদের সৈকতে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে না বলেও তিনি জানান।

এদিকে, কক্সবাজার সমূদ্র সৈকতে অভিযান চালালেও চট্টগ্রামে পতেঙ্গা-আনোয়ারাসহ অন্য সমুদ্র সৈকতগুলোতে ক্যামেরাম্যান চক্রের দৌরাত্ন নিয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশ কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন সেই প্রশ্ন তুলেছেন পর্যটক ও সি-বিচগুলোর পরিচালকরা।

তাদের মতে, মিরসরাই থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ২৮৫ কিলোমিটার সমূদ্র সৈকতের অন্তত ১০টি স্পটে শত শত ক্যামেরাম্যান ছবি তোলে ব্ল্যাকমেইল করার মতো নানা অপরাধ কর্মকান্ডে লিপ্ত। এদের আবার সৈকতে ছবি তোলার কাজ করার সুযোগ দিয়েছেও প্রশাসন। তাদেরকে কার্ড দিয়ে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের সহযোগিতাকে পুঁজি করে ক্যামেরাম্যানরা নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে।

ঈদের ছুটিতে নিজের বোনকে নিয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর খুলশী এলাকা থেকে কক্সবাজার বেড়াতে যান গিয়াস উদ্দিন স্বপন। তিনি বলেন, শুক্রবার বিকেলে আমরা ভাই-বোন সৈকতে ঘুরে-ফিরে আনন্দ উপভোগ করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একজন ক্যামেরাম্যান আমাদের ডেকে নানারকম কুরুচিপূর্ণ কথা বলতে শুরু করেন। আমরা ভাই-বোন পরিচয় দেওয়ার পরও তারা আমার বোনকে গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি পোস্ট করার হুমকি দেন।

কিসের ছবি জানতে চাইলে তারা আমাদের উলঙ্গ ছবি দেখান। ছবি দেখে আমরা তাজ্জব বনে যায়। সৈকতে তো আমরা উলঙ্গ ছিলাম না। এটা কিভাবে হলো বুঝতে পারছিলাম না। পরে বুঝতে পারলাম এটা সফটওয়্যারের কারসাজি। এই ছবি পোস্ট না করার জন্য তারা আমাদের কাছে এক লাখ টাকা দাবি করেন। পরে ইজ্জত রক্ষার্থে ১০ হাজার টাকা দিয়ে মুক্তি পাই।

thumbnail_Sea_beac-07.04_(2)

গত শনিবার ঈদের পঞ্চম দিনে আনোয়ারা পারকি সি-বিচে বেড়াতে গিয়ে ক্যামেরাম্যানদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার কথা জানান রাঙ্গুনিয়া উপজেলার একদল স্কুল শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে উপজেলার ঘাটচেক উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহীন সৈকত বলেন, আমাদের কছে ক্যামেরা থাকা স্বত্বেও, পারকি বিচে কয়েকজন ক্যামেরাম্যান এসে বলেন ছবি তুলতে।

ক্যামেরা থাকার কথা বলায় তারা বলেন, ছবি না তুললে বিচ ছেড়ে চলে যেতে। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডার পর তারা আমাদের তিনজনের হাতের মোবাইল কেড়ে নিয়ে সাগরের জলে ফেলে দেয়। এমনকি আমাদের কয়েকজনকে গলাধাক্কা দিয়ে চর-থাপ্পড়ও মারে।

পর্যটকদের অভিযোগ, সৈকতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরাম্যানরা ছবি তোলার কথা বলে। একই পোজ ও একই ছবি ১০-২০টি তোলে তারা ১০০-২০০ কপি দেখায়। পরে প্রতিটির জন্য ৫ টাকা করে আদায় করে। এছাড়াও অযথা ছবি তুলে তা নিতে বাধ্য করা হয়, রাজি না হলে কয়েকজন একত্র হয়ে পর্যটকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। এমনকি ছবি নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে। ফলে সৈকতে ক্যামেরাম্যানরা এখন পর্যটকদের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভুক্তভোগী পর্যটক বা দর্শনার্থীদের ভাষ্য, সি-বিচে মানুষ ছুটে চলে একটু প্রশান্তির আশায়। কর্মজীবন শেষে মানসিক জঠিলতা থেকে মুক্তির উত্তম প্রয়াস এটি। কিন্তু সেই সি-বিচেও শান্তি যেন হারিয়ে গেছে। এই অশান্তির মূলে এখন সংঘবদ্ধ ক্যামেরাম্যান চক্র। যারা সি-বিচগুলোতে এখন পর্যটকদের জন্য আতঙ্কের।

তাদের অভিযোগ, চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে কক্সবাজার-টেকনাফ পর্যন্ত দীর্ঘ সমূদ্র সৈকতের বিভিন্ন স্থানে সক্রিয় এই সংঘবদ্ধ ক্যামেরাম্যান চক্র। যারা ক্যামেরা নিয়ে সৈকত এলাকায় অবাধে ঘুরাঘুরি করে। সুযোগ বুঝে পর্যটকদের সুন্দর-সুন্দর ছবি তুলে দেওয়ার লোভ দেখায়। পরে শত শত ছবি তোলার কথা বলে হাতিয়ে নেয় মোটা অঙ্কের টাকা। তাদের দাবির হেরফের হলে হতে হয় লাঞ্ছনার শিকার। এক্ষেত্রে ক্যামেরাম্যান চক্র একজোট হয়ে নানা ধরনের কটূক্তি, এমনকি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে।

শুধু তাই নয়, ক্যামেরা নিয়ে বিচরণের সময় অবস্থা বুঝে তারা পর্যটক টার্গেট করে গোপনে ছবি তুলে। পরে তা দেখিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে। এভাবে প্রতিনিয়ত ব্ল্যাকমেইলের শিকার হচ্ছেন পর্যটকরা।

জানতে চাইলে কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্টহাউজ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার এ প্রসঙ্গে বলেন, সি-বিচে ক্যামেরাম্যানদের অপতৎপরতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না প্রশাসন। এর প্রভাব আমাদের হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ও পড়ছে। তবে সম্প্রতি কক্সবাজার সি-বিচে প্রথমবারের মতো ট্যুরিস্ট পুলিশের অভিযান আশার সঞ্চার করছে।

পতেঙ্গা সি-বিচের তত্ত্বাধায়ক চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, শুধু কক্সবাজার নয়, পতেঙ্গাসহ চট্টগ্রামের সবকটি সমুদ্র সৈকতে ক্যামেরাম্যানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। মূলত সৈকতে এখন ক্যামেরাম্যানের দরকার নেই। ডিজিটাল যুগে সবার হাতে হাতে এখন উন্নত প্রযুক্তির মোবাইল রয়েছে। যেগুলোর রেজ্যুল্যাশন ডিএসএলআর ক্যামেরার চেয়েও কম নয়।

এরপরও যারা প্রকৃত ক্যামেরাম্যান নন এবং যাদের বৈধ কার্ড নেই, তাদের সৈকতে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত না। ট্যুরিস্ট পুলিশ এখন সেটা ভাবছে। আশা করি, এই উদ্যোগে বিচে হয়রানির মাত্রা কমবে পর্যটকদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসবে। পর্যটকরা নির্বিঘ্নে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।

প্রতিনিধি/টিবি

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন